![রাজনীতিতে কী হচ্ছে সামনে!](uploads/2023/12/15/1702614706.Politics.jpg)
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের দিন ঘনিয়ে আসছে। আগামী ৭ জানুয়ারি এ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হবে। ওই দিন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্বাচনে অংশ নেওয়া দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোটের মাঠে নামার প্রক্রিয়ায় আছেন। ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তাদের সতীর্থরাও আছে নির্বাচনী দৌড়ে। তবে এর উল্টো দিকে নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো আছে ধারাবাহিক আন্দোলনে। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে জোটবদ্ধ ও সতীর্থরা দফায় দফায় অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি পালন করছে।
রাজনীতির এই দ্বিমুখী অবস্থানের প্রভাবে প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় চলছে নানা ধরনের সহিংস ঘটনা। বাসে আগুন, রেললাইন কেটে ফেলাসহ সংঘাত-সংঘর্ষও চলছে বিভিন্ন এলাকায়। সরকারি দল থেকে যেমন নির্বাচন বানচালের দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্তের অভিযোগ তুলছে, তেমনি নির্বাচন বর্জনকারীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে নিপীড়ন-নির্যাতন, হামলা-মামলা, জেল-জুলুমের। প্রতিদিনই আদালতে পুরোনো মামলায় সাজা দেওয়া হচ্ছে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের। ধরপাকড়ও চলছে। গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে এমন সহিংস ঘটনায় পুলিশসহ এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কয়েক শ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সামনে ‘ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে’। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘বিএনপি সন্ত্রাস করলে আমরা হাত গুটিয়ে ঘরে বসে থাকব না।’ আরেক দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৮ ডিসেম্বর থেকে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ছাড়া নির্বাচনী কাজে বাধা হতে পারে বা ভোটাররা ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন এ ধরনের কোনো সভা-সমাবেশ বা অন্য কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না করতে বলা হয়েছে। বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হচ্ছে শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কথা। এমন পরিস্থিতিতে সামনে কী হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে। নির্বাচন ঘিরে সামনের দিনগুলোতে পরিবেশ কী শান্তিপূর্ণ থাকবে নাকি ২০১৪ সালের মতোই সহিংস পথে যাবে দেশ সেই শঙ্কাও দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।
এদিকে বুধবার গাজীপুরের রেললাইনের স্লিপার কেটে ফেলার বিষয়টি নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। ভোটের আগে এই ধরনের আরও ঘটনা ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কা করছে তারা। তবে তারা সহিংসতা রোধে কাজ করছে। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে এক পুলিশ সদস্যসহ ছয়জন নিহত হয়েছেন। আর ২৮ অক্টোবর থেকে গত ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৩৭৬টি গাড়িতে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। পাশাপাশি এ সময় দুর্বৃত্তরা ২৪১টি যানবাহন ভাঙচুর করেছে। এই সময়ে প্রায় ৬৪৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের আশঙ্কা, নির্বাচনকে ঠেকানোর নামে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আরও বেশি সক্রিয় হবে। এতে বাড়বে আরও সহিংসতা।
এ বিষয়টি মাথায় রেখে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঢাকা ও সারা দেশে ত্রিমুখী নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলছে। তিন দিন আগে পুলিশ সদর দপ্তরে মাসিক অপরাধ সভায় আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন জেলার এসপিদের বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। তাদের জেলা শহর থেকে শুরু করে থানা শহরের প্রত্যেক মোড়ে টহল বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির সূত্র থেকে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবরের পর এ পর্যন্ত ১১ দফায় ২৩ দিন অবরোধ এবং তিন দফায় চার দিন হরতাল করেছে বিএনপি। এ ছাড়া ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে মহাসমাবেশের চার-পাঁচ দিন আগে থেকে আজ পর্যন্ত মোট ২১ হাজার ৬১৫ জনের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, মোট মামলা ৬১৪টি, এ সময়ে ২১ জনের (সাংবাদিক ১ জন) মৃত্যু ও ৬ হাজার ২৩৩ জনের বেশি নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন বলে দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
আদালতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত দেড় মাসে ঢাকার আদালতে বিএনপির অন্তত ৯২৫ জনের বিরুদ্ধে কারাদণ্ডের রায় আসে। মোট ৭২টি মামলায় এই রায় হয়। এসব মামলার প্রায় সবগুলোই একাদশ ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় করা হয়।
এদিকে গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আবদুল মঈন খান বলেছেন, ‘সরকার হয়তো পুলিশ দিয়ে, বোমা দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্ষমতায় থাকবে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, আগামী প্রজন্মের কাছে আপনারা কোন বাংলাদেশ রেখে যাচ্ছেন? আসুন, সংঘাতের রাজনীতি পরিহার করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি ব্যবহার নিশ্চিত করি। তা না হলে বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে।’
আওয়ামী লীগের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে আওয়ামী লীগের প্রায় ২৫০ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। ২৮ অক্টোবরেই শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৫ জন যুব মহিলা লীগ ও মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী রয়েছেন। ২৯ অক্টোবর বিএনপির হরতালের দিন লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া- পাল্টাধাওয়ায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা জাহাঙ্গীর আলম নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ১০ জন।
সামনের দিনগুলোতে বিএনপি কঠোর কর্মসূচি দিলে দলীয় অবস্থান কী হবে- এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি দলীয় কর্মসূচি পালন করতেই পারে। তবে তাদের কর্মসূচি যদি মানুষ পোড়ানো হয়, মানুষকে লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ হয়, বাস পোড়ানো হয়, মানুষের জানমালের ক্ষতির কারণ হয়, তারা যদি সহিংসতা-সন্ত্রাস করে, তাহলে সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ হাত গুটিয়ে ঘরে বসে থাকবে না। দলের সব নেতা-কর্মী সতর্ক থাকবেন। আগুন সন্ত্রাসকারীদের দেখলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেবেন।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব হাবিবুল হাসান স্বাক্ষরিত ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ১৮ ডিসেম্বর থেকে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ছাড়া নির্বাচনীকাজে বাধা হতে পারে বা ভোটাররা ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন এমন কোনো সভা-সমাবেশ বা অন্য কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা থেকে সবাইকে বিরত রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন গতকাল সন্ধ্যায় খবরের কাগজকে জানান, নির্বাচন ঘিরে যাতে দেশে সহিংসতা না বাড়ে এ জন্য পুলিশ কাজ করছে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে টহল টিমকে আরও জোরদার ডিউটি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, যারা নাশকতার সঙ্গে জড়িত, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এ ছাড়া নাগরিকরা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, সে জন্য কাজ করছে পুলিশ।
অবরোধের কারণে ঢাকাসহ সারা দেশে বাসে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এতে পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে গত ৭ নভেম্বর এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয় যে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচির মধ্যে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগকারীদের ব্যাপারে তথ্য দিলে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। তথ্য প্রদানকারীর পরিচয় গোপন রাখা হবে বলেও পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকেও এমন ঘোষণা দেওয়া হয়। ডিএমপি কমিশনার বাসে আগুন দেওয়া দুর্বৃত্তদের ধরার জন্য কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে পুরস্কার দিয়েছেন। তবে সামগ্রিকভাবে দেখা গেছে, ঢাকাসহ সারা দেশে বাসে আগুন ও বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। এতে চারদিকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। গত বুধবার ঢাকায় তিনটি গাড়িতে আগুন লেগেছে। ওই দিনই গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইনের একটি অংশ কেটে ফেলে দুর্বৃত্তরা। ওই পথে যাওয়ার সময় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস নামে একটি ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। এ ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় পাঁচজন।
এমন পরিস্থিতিতে ঢাকাসহ সারা দেশের থানাগুলোকে আরও সতর্ক হতে বলেছে পুলিশ সদর দপ্তর। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে দেশের প্রতিটি থানায় কুইক রেসপন্স টিম গঠন করতে বলা হয়েছে। সহিংসতার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতে দ্রুতই ঘটনাস্থলে যাওয়া যায়, এ জন্য পুলিশকে বহুমুখী নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে।
অতি প্রয়োজন ছাড়া পুলিশের ছুটি দেওয়া থেকে এসপিদের মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সহিংসতাকারীরা যাতে কেপিআইভুক্ত এলাকায় কোনো ধরনের সহিংসতা চালাতে না পারে সে জন্য কাজ করছে পুলিশ। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে পার্বত্য এলাকা পরিস্থিতি যাতে উত্তপ্ত না হতে পারে সেই দিকে নজর রাখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
অন্যদিকে জানতে চাইলে বিএনপির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদিন মেসবাহ খবরের কাগজকে বলেন, প্রতিদিন নেতা-কর্মীদের সাজা হচ্ছে, যার সংখ্যা এখন পর্যন্ত এক হাজারের ঊর্ধ্বে। নিম্ন আদালতে বিচারের ক্ষেত্রে এ রকম চলতে থাকলে বিচারপ্রার্থীরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। দেশের মানুষের নিম্ন আদালতের প্রতি আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে।