নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী নারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৫৯ জন। এরপর দশম সংসদ নির্বাচনে তা দাঁড়ায় ২৯ জনে। পরবর্তী সময়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ৬৯ নারী প্রার্থী বিভিন্ন প্রতীকে নির্বাচন করেছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৭ জনে, যা মোট প্রার্থীর ৫ শতাংশেরও কম। সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব এখনো সীমিত হলেও ধীরে ধীরে বাড়ছে নারীদের অংশগ্রহণ। যদিও সংসদ নির্বাচনের আইন বা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক অধ্যাদেশে প্রতিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বিধান করা হয়, যা পূরণ হয়নি এখনো।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বাড়ানোর জন্য সংসদে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ানো দরকার- এ কথা আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। সে অনুযায়ী আমরা দলগুলোর সব ধরনের কমিটিতে ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ নারী সদস্যের অংশগ্রহণ চেয়েছি। সেটা যদি থাকত, তা হলে হয়তো আমরা এই নির্বাচনে আরও বেশি নারী প্রার্থীর অংশগ্রহণ দেখতাম। নারীরা যে এখনো ক্ষমতায়নে অনেক পিছিয়ে আছেন এটা তার প্রমাণ।’
অন্যদিকে নারী অধিকারকর্মী রেখা সাহা খবরের কাগজকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ খুবই কম। এটা আমাদের হতাশ করেছে। কারণ এটা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। কারণ সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়লে সেখানে নারীর অধিকারের কথাগুলো তারা তুলে ধরতে পারবেন, নারীর পক্ষে কথা বলতে পারবেন। কিন্তু যদি নারীর অংশগ্রহণই কম থাকে, তবে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারীর ক্ষমতায়নকে এগিয়ে নিতে আরও সময় লাগবে।’
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ১২৮ জন নারী রিটার্নিং অফিসারদের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন। যাচাই-বাছাইসহ সব প্রক্রিয়া শেষে প্রতিদ্বন্দ্বী নারী প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৭ জন, যা অন্য যেকোনোবারের তুলনায় বেশি। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নারী প্রার্থী ২৩ জন, যা তাদের মোট প্রার্থীর ৮ শতাংশ। এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ছিলেন ১৮ জন।
এবারের ২৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৭ জন বর্তমান সংসদ সদস্য। বাকি ছয়জনের মধ্যে তিনজন এবারই প্রথম দলের মনোনয়ন পেয়েছেন, অন্য তিনজন এর আগেও সংসদ সদস্য অথবা সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন ২১ জন। অন্য দলগুলোর মধ্যে জাতীয় পার্টি ১২টি আসনে নারীদের মনোনয়ন দিয়েছিল। তাদের সব প্রার্থীই বাছাইয়ে টিকেছেন। একইভাবে জাকের পার্টি ৬, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ৬ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৩টি আসনে নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছিল। তারা সবাই বাছাইয়ে টিকেছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ কংগ্রেসের ৯ জনের মধ্যে ৬, তৃণমূল বিএনপির ৮ জনের মধ্যে ৫ জনের প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সুপ্রিম পার্টির ৫ জনের মধ্যে ৪, মুক্তিজোটের ৩ জনের মধ্যে ২ জনের প্রার্থিতা টিকেছে। প্রার্থিতা টিকে যাওয়া বাকি দলগুলোর মধ্যে রয়েছে বিএনএফ, গণফ্রন্ট, জাতীয় পার্টিসহ (জেপি) আরও কয়েকটি দল।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার কেবল গোপালগঞ্জ-৩ আসন থেকেই নির্বাচন করবেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মতোই যথাক্রমে রংপুর-৬ এবং চাঁদপুর-৩ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন দলের। শেরপুর-২ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী। এই আসনের পাঁচবারের সংসদ সদস্য তিনি।
এ ছাড়া গাজীপুরের তিনটি আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন নারীরা। এর মধ্যে গাজীপুর-৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন (রিমি) আবারও মনোনয়ন পেয়েছেন। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের সন্তান রিমি এই আসনে টানা দুবারের সংসদ সদস্য। গাজীপুর-৫ আসনে চতুর্থবারের মতো মনোনয়ন পেয়েছেন মেহের আফরোজ চুমকি। গাজীপুর-৩ আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য মুহাম্মদ ইকবাল হোসেনের পরিবর্তে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে রুমানা আলীকে। এর আগে তিনি সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন।
রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রথম পদক্ষেপ রাজনৈতিক দলগুলোর তৃণমূল পর্যায় থেকেই আসতে হবে বলে মনে করেন রেখা সাহা। খবরের কাগজকে তিনি বলেন, হাজার হাজার নারী এখন রাজনীতিতে আসতে চান। তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আসছেন, নির্বাচিতও হচ্ছেন। কিন্তু তাদের শুরুটা তো দলকেই করে দিতে হবে। জাতীয় নির্বাচনে তাদের আসার জায়গাটাও দলকেই করে দিতে হবে।
তাদের রাজনীতির নেতৃত্বের দক্ষতা, যোগ্যতা বাড়াতে এবং তাদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব বাড়াতে দলগুলোকে কাজ করতে হবে।
তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়ে ফওজিয়া মোসলেম খবরের কাগজকে বলেন, কেবল কমিটিতে নারীকে রেখেই রাজনৈতিক পরিবর্তন বা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। নারীর ক্ষমতায়নে নারীর সম্পদের অধিকার দেওয়া, রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন এবং দলগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
জাতীয় সংসদের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সরাসরি ভোটে লড়েছিলেন মাত্র দুজন নারী। তা-ও প্রধান দল থেকে নয়। তারা জয়লাভ করতে পারেননি। দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনে ১৩ নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। সে সময় ক্ষমতাসীন দলে একজনও নারী প্রার্থী ছিলেন না। ওই নির্বাচনে তিন নারী প্রার্থী উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোট পেলেও জিততে পারেননি। পরে মুসলিম লীগের খান এ সবুরের একটি অতিরিক্ত আসন খুলনা-১৪-এর উপনির্বাচনে একই দল থেকে নির্বাচিত হন সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ। এ হিসেবে তিনিই প্রথম নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য। নারীরা সরাসরি নির্বাচনে সফলতা লাভ করেন তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনে।
এ নির্বাচনে বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনাসহ তিনজন নারী প্রার্থী নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনা নির্বাচিত হন তিনটি আসন থেকে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন নারী সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর পঞ্চম সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন খালেদা জিয়া। পরের ৩২ বছরের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়াই বছর বাদ দিয়ে বাকি সময় দেশের প্রধান নির্বাহী তথা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে নারীরাই রয়েছেন।