প্রস্তাবিত ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের অন্তর্গত থানা ও ওয়ার্ড কমিটিতে ‘মাইম্যান’ তৈরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। দলের দুর্দিনের ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের বাদ দিয়ে পদ-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে মহানগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বিরুদ্ধে।
সম্ভাব্য কমিটির বিষয়ে জানাজানি হলে ক্ষোভ ও সমালোচনার সৃষ্টি হয় খোদ মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে। মহানগরের শীর্ষ নেতাদের এমন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখার জন্য কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের হস্তক্ষেপ চান পদবঞ্চিত নেতারা।
২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। সম্মেলনে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন শেখ বজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক হন এস এম মান্নান কচি। অন্যদিকে দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী ও সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবির। মহানগরের বর্তমান এই কমিটির মেয়াদ ২০২২ সালে শেষ হয়েছে। মহানগরের নেতারা ২০২১ ও ২২ সালে উত্তরের ২৬টি থানা ও ৬৪টি ওয়ার্ড এবং দক্ষিণের ২৪টি থানা ও ৭৫টি ওয়ার্ডের সম্মেলন দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের চাপে পড়ে গত মে মাসে ঢাকা মহানগর উত্তর ও চলতি মাসে মহানগর দক্ষিণের অন্তর্গত থানা ও ওয়ার্ডের খসড়া কমিটি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে হস্তান্তর করেন নেতারা। কেন্দ্রের যাচাই-বাছাইয়ের পর খোদ দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের পর ওই কমিটিগুলো প্রকাশ করা হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকা বিভাগের আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মির্জা আজম খবরের কাগজকে বলেন, বিতর্কিত কেউ কমিটিতে থাকলে নিশ্চয়ই তা যাচাই-বাছাই করা হবে। প্রমাণ মিললে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মহানগর দক্ষিণ নেতাদের অভিযোগ, থানা ও ওয়ার্ড কমিটিতে দলের যোগ্য নেতাদের বাদ দিয়ে পছন্দের লোক কমিটিতে রাখা হয়েছে। মাইম্যান (নিজস্ব বলয়) তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার কোথাও হচ্ছে কমিটি-বাণিজ্য।
মহানগর দক্ষিণের থানা-ওয়ার্ড পদপ্রত্যাশীদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, রাজধানীর মতিঝিল থানার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নাম প্রস্তাব করা হয়েছে ওয়াহিদুর রহমান চৌধুরী ওয়াহিদের। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মন্নাফীর ছেলে আহমেদ ইমতিয়াজ আহমেদ গৌরবের বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়ী অংশীদার। ওয়াহিদ মতিঝিল থানার অন্তর্গত ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা।
স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন, এই ওয়ার্ডে অনেক ত্যাগী এবং ক্লিন ইমেজের নেতা থাকা সত্ত্বেও ওয়াহিদকে বসানো হচ্ছে। আর এই ওয়াহিদের বিরুদ্ধে একাধিক জায়গা দখল ও মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। মতিঝিলসংলগ্ন দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় ক্যাফে সিদ্দিকী নামের একটি রেস্টুরেন্টের পেছনের কিছু অংশ বছরের পর বছর দখল করে রেখেছেন তিনি। তবে তিনি আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান। বিভিন্ন কারণে তিনি বিতর্কিত। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি পদে প্রস্তাব করা হয়েছে শাহিনুর রহমান শাহীনের নাম। যিনি বিএনপি পরিবারের সন্তান। তার বড় দুই ভাই মজনু ও লাভলু বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। মহানগর আওয়ামী লীগের একজন সদস্যের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে মতিঝিলপাড়ার ঐতিহ্যবাহী দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন বেশ কিছুদিন আগে। শাহিনের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে। ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গেও তার সম্পৃক্ততা ছিল।
সূত্রে জানা গেছে, শাহবাগ থানার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটিতে সভাপতি পদে মকবুল হোসেনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে সক্রিয় না থাকলেও এক কাউন্সিলরের ‘কাছের লোক’ বলে তাকে কমিটিতে রাখা হয়েছে। একই ওয়ার্ডে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে শাওনের নাম। যার বিরুদ্ধে দলের নাম ভাঙিয়ে নানা ‘অপরাধ’ করার অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টাকার বিনিময়ে বিএনপি পরিবারের সদস্য হলেও আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটির জন্য নাম প্রস্তাব করা হয়েছে কয়েকজনের। এদের মধ্যে রয়েছেন ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের আরিফুল ইসলাম আরিফ। এ ছাড়া ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি গিয়াসউদ্দিন গেসু আবারও সভাপতি হতে টাকা দিয়েছেন।
প্রস্তাবিত কমিটিগুলোতে বিতর্কিতদের নাম রাখা হয়েছে- এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এসব প্রস্তাবিত কমিটি আমরা দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে জমা দিয়েছি। এসব প্রস্তাবিত কমিটি আমাদের দলের দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী যাচাই-বাছাই করে তারপর চূড়ান্ত করবেন। এতে বহু পরিবর্তন আসবে।’ অর্থ লেনদেনের বিষয়ে কিছু জানা নেই বলেও জানান হুমায়ুন।
এদিকে মহানগর উত্তরের কমিটি জমা দেওয়ার পর পরই আওয়ামী লীগের উত্তরের তৃণমূল নেতারা দাবি করেছেন, থানা ও ওয়ার্ড কমিটিতে কারা আসছেন তা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ‘গ্রিন সিগন্যালের’ মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। যোগ্য নেতাদের বাদ দিয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত থানা ও ওয়ার্ড কমিটিতে মামলার আসামি, বিএনপিপন্থি এবং টাকার বিনিময়ে পদ দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগও রয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমানের ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে পদ-বাণিজ্যের একটি ‘কল রেকর্ড’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ‘আ.লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের কমিটি- সভাপতি বজলুর অর্থ লেনদেনের অডিও ফাঁস’ নামে খবরের কাগজ গত ২৬ জুন একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। কমিটির সভাপতির এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের নেতারাও। ২ মিনিট ২০ সেকেন্ডের কল রেকর্ডটিতে দেখা যায়, ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের শীর্ষ পদ পেতে আকবর আলী নামের এক নেতা মহানগর উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমানের মোবাইলে ফোন করেন। সেখানে ওয়ার্ডের সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক পদে থাকার জন্য আকবর আলী নগর নেতা বজলুর রহমানকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছেন বলে শোনা গেছে।
এ ছাড়া চলতি মাসের শুরুতে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অন্তর্গত তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই নানা অভিযোগ তুলে ক্ষোভ জানিয়েছেন ওই থানার বাকি পদপ্রত্যাশী নেতারা। তারা কেন্দ্রীয় নেতা এবং মহানগর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে এ বিষয়ে ক্ষোভও জানিয়েছিলেন। পদপ্রত্যাশী একাধিক নেতা জানান, প্রস্তাবিত তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের কমিটিতে সভাপতি হিসেবে আছেন নুরুল ইসলাম মোল্লা সুরুজ ও সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন মুহিবুল হাসান। দুজন একই মহল্লায় থাকেন। তারা দুজন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচির অনুসারী বলেও স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে।
৫৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নাসির উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, “আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এখানে ওয়ার্ড হওয়ার আগেই ‘ইউনিয়ন’ আমলে আওয়ামী লীগের নেতা ছিলাম। এখন আমাকে আউট করে থানা কমিটি দেওয়া হচ্ছে বলে শুনতে পেয়েছি। যাদের দেওয়া হচ্ছে, তারা অযোগ্য। স্থানীয় নেতাদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা তাদের একদমই নেই। থানা কমিটি সামলানোর সক্ষমতাও তাদের নেই।’
ওয়ার্ড ও থানার প্রস্তাবিত কমিটিতে বিতর্কিতদের বিষয়ে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, এসব বিষয়ে অনেক অভিযোগ আছে। এ জন্য হয়তো আমাদের আগামীতে কেন্দ্র থেকে ডাকা হতে পারে। তবে এখনো ডাকা হয়নি। তখন হয়তো কমিটিতে সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা এসব প্রস্তাবিত কমিটি করেছি ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে। আমরা সেখানে রাজপথের যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের রাখার চেষ্টা করেছি। এখন হয়তো অনেক এমপি সাহেবের সেই নামগুলো পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু যেহেতু দলীয় প্রধান নিজে খতিয়ে দেখে কমিটি করবেন, তাই এর পরই ওই কমিটিগুলো ঘোষণা করা হবে।”