রমজানের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ সদকাতুল ফিতর। এটি ঈদুল ফিতরের নামাজের আগে আদায় করতে হয়। সদকাতুল ফিতর মূলত জাকাতেরই একটি প্রকার। আমাদের এ অঞ্চলে সদকাতুল ফিতর ‘ফিতরা’নামে অধিক পরিচিত। এই ইবাদতের দুটি হিকমত ও তাৎপর্য রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘সদকাতুল ফিতর হচ্ছে রোজাদারের জন্য পবিত্রতা এবং মিসকিনদের জন্য খাদ্য। আর যে তা ঈদের নামাজ আদায় করার আগে আদায় করে, তা কবুল করা হয়। আর যে তা ঈদের নামাজ আদায় করার পর আদায় করে, তা সদকাতুল ফিতর না হয়ে সাধারণ সদকা হিসেবে আদায় হয়ে যাবে।’ (ইবনে মাজাহ, ২৭২৫)
হাদিসে সদকাতুল ফিতর আদায়ের বিশেষ পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। দুটি মাপকাঠি দ্বারা আদায় করতে হবে। তা হলো—১. আধা সা (১ কেজি ৬৩৫ গ্রাম) গম বা তার সমমূল্য। ২. এক সা (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম প্রায়) খেজুর, কিশমিশ, পনির ও যব বা তার সমমূল্য। যব, খেজুর, পনির ও কিশমিশ দ্বারা আদায় করলে এক সা এবং গম দ্বারা আদায় করলে আধা সা প্রযোজ্য হবে। আবু সাইদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘আমরা সদকায়ে ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্য দ্বারা অথবা এক সা যব অথবা এক সা খেজুর কিংবা এক সা পনির বা এক সা কিশমিশ দ্বারা। আর এক সা এর ওজন ছিল নবি (সা.)-এর সা অনুযায়ী।’ (মুয়াত্তা মালেক, ১২৪)
তবে সাহাবায়ে কেরাম সাধারণত খেজুর দ্বারাই সদকাতুল ফিতর আদায় করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) সারা জীবন খেজুর দ্বারাই সদকা ফিতর আদায় করেছেন। তিনি একবার মাত্র যব দ্বারা আদায় করেছেন। (আল ইসতিজকার, ৫৯০)
সদকাতুল ফিতর সম্পর্কিত হাদিসগুলো পর্যালোচনা করলে এ বিষয়ে মোট পাঁচ প্রকার খাদ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়—যব, খেজুর, পনির, কিশমিশ ও গম।
সদকাতুল ফিতর ঈদুল ফিতরের ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়াজিব হয়। কাজেই সেদিন ভোরের আগে যে জন্ম নিয়েছে, সে যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাকেও এই সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। কেউ যদি সেদিন ভোরের আগে মারা যায়, তার ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। আবার ভোর হওয়ার পর কেউ জন্ম নিলে তার পক্ষ থেকেও আদায় করা ওয়াজিব নয়। এক ব্যক্তির ফিতরা একজন মিসকিনকে দেওয়াই উত্তম। তবে একাধিক মিসকিনকে দেওয়া জায়েজ আছে। একজন লোকের ওপর যে ফিতরা ওয়াজিব তা একজন মিসকিনকে দেওয়াও জায়েজ আছে।
আমরা অনেকেই ফিতরা দিই। তবে যদি একটু চিন্তা করে দিই, তাহলে তা অনেক সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যাবে। যেমন আমরা যদি পাঁচ থেকে সাতজন লোকের পরিবারের ফিতরা একটা পরিবারকে দিয়ে দিই, তাহলে হয়তো তার ঈদের বাজার হয়ে যাবে। এতে পরিবারটির ছেলেমেয়ের পোশাক হয়ে যাবে। আনন্দের সঙ্গে ঈদ কাটাবে। তাই যেন আমরা ঈদের আগে এটি দেওয়ার চেষ্টা করি।
আমরা শুধু আটার দামে ফিতরা দিই, কিন্তু খেজুর বা কিশমিশের দামে দিই না কেন? কারণ এগুলোর দাম বেশি। উচিত হচ্ছে সাধ্যমতো দেওয়া।
ফিতরা টাকা দ্বারা আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে। জুহাইর (রহ.) বলেন, আমি আবু ইসহাক (রহ.) থেকে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘আমি সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-কে এই অবস্থায় পেয়েছি যে, তারা রমজানে সদকাতুল ফিতর খাবারের বিনিময়ে টাকা দ্বারা আদায় করতেন।’ ( ইবনে আবি শায়বা, ১০৩৭১)
মোটকথা, হাদিসে মোট পাঁচ ধরনের খাদ্যদ্রব্যের কথা বলা হয়েছে এবং দুটি পরিমাপের কথাও বলা হয়েছে। তার মাঝে গম দিয়ে আদায় করলে আধা সা অর্থাৎ ১ কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি আর খেজুর, পনির, কিশমিশ ও যবের দ্বারা আদায় করলে এক সা অর্থাৎ ৩ কেজি ৩০০ গ্রামের কিছু বেশি দিতে হবে। এই দুই ধরনের খাদ্যদ্রব্য বা তার বাজারমূল্য যেকোনোভাবেই হোক তা আদায় হয়ে যাবে।
এখানে একটি কথা মনে রাখা জরুরি, সাহাবা, তাবেয়ি ও তাবেয়িনের কোনো যুগে সবাই মিলে আধা সা গম দ্বারাই সদকাতুল ফিতর আদায় করেছেন বলে কোনো দুর্বল প্রমাণও পাওয়া যায়। আমাদের দেশে সবাই হাদিসে বর্ণিত সব দ্রব্যের সবচেয়ে নিম্নমূল্যের গম দ্বারা আদায় করে থাকে। বাকিগুলো দিয়ে কেউ আদায় করে না। অথচ নিয়ম হলো—প্রত্যেকে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী বেশি মূল্যমানের দ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করবে। নবি (সা.)-কে সর্বোত্তম দান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘দাতার কাছে যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি’। (বুখারি, ৩/১৮৮)
সাহাবায়ে কেরাম সর্বোচ্চ মূল্যের জিনিস দ্বারাই দান-সদকা করতেন। এমনকি চার মাজহাবের সবাই উত্তম সদকা বলতে সর্বোচ্চ মূল্য গ্রহণ করেছেন।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক