![স্বাধীনতার লড়াই এখনো চলছে](uploads/2024/03/26/1711439463.sukhoronjon-photo.jpg)
গত শতকের ’৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। তিনি সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিকে কিছু কর্মসূচি দিয়ে গিয়েছিলেন। যেমন সরকারি কর্মচারীরা অর্ধেক দিন কাজ করবেন। ব্যাংক অর্ধেক দিন কাজ করবে। আরও অনেক কিছু। তার ওই ঘোষণার পরই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গ্রামগঞ্জ, শহরে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তৈরি হয়েছিল মুক্তিবাহিনী, মুজিব বাহিনীসহ আরও কয়েকটি বাহিনী।
ঠিক ১৮ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে যখন সামরিক বাহিনী গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। তিনি যে গ্রেপ্তার হবেন একথা ভারত সরকার এবং বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতারা জানতেন। জিয়াউর রহমান তখন পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনীর একজন সদস্য। ওদিকে আইএসআই-এর প্রধান জিয়াউর হক। বাঙালি জিয়াউর রহমান প্রতিদিন পাকিস্তানি আইএসআই-প্রধান জিয়াউল হককে রিপোর্ট করতেন। বাংলাদেশের জনগণের ওপর অত্যাচারের মাত্রাও বাড়তে থাকে।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী ও যুবলীগের কর্মীরা বিভিন্ন জেলায় গিয়ে সংগঠন গড়তে থাকেন। তখন হাজার হাজার লোক গ্রাম ছেড়ে ভারতের দিকে রওনা দেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁওয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এই খবর পেয়েই আওয়ামী লীগের নেতারা একে একে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন। বঙ্গবন্ধু আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও তৈরি করে রেখেছিলেন। আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা আমিরুল ইসলামের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম রেডিও থেকে ঘোষণা করার কথা ছিল।
তারপর যা হওয়ার তাই হলো। গ্রামগঞ্জ থেকে পাকিস্তানের অত্যাচারের খবর আসতে থাকে। এক মাসের মধ্যে প্রায় ১ কোটিরও বেশি লোক পশ্চিমবঙ্গের দিকে আসতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে তখন কংগ্রেস ও বাংলা কংগ্রেসের জোট সরকার। মুখে মুখে রটে যায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। মেজর জিয়াউর রহমান তখন চট্টগ্রামে ছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণাটি তিনি রেডিওতে প্রথমে নিজের নামে ঘোষণা দেন। পরক্ষণেই ভুল বুঝতে পেরে ঘোষণাটি বঙ্গবন্ধুর নামে আবার পাঠ করেন।
তাজউদ্দিন সাহেব কুষ্টিয়া থেকে মেহেরপুর হয়ে কলকাতা পৌঁছান। কামারুজ্জামান সাহেব একটি বড় পানসি নৌকায় দুই ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ভারতের দিকে যাত্রা করেন। সেই যাত্রার বিবরণ আমি কামারুজ্জামানের কাছে শুনেছি। পদ্মা নদীর ওপর নৌকায় একটি পাকিস্তানি পতাকা লাগানো ছিল। পদ্মা ছড়িয়ে গঙ্গার দিকে নৌকা ঢোকার সময় তারা পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ভারতের পতাকা তুলে দেন। সেই পতাকা দেখে সিগন্যাল দেয় ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। মুর্শিদাবাদ জেলার একটি ঘাট থেকে তাদের নিয়ে আসেন বিএসএফ-এর অফিসার এবং জওয়ানরা।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সড়কপথে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। একে একে পাকিস্তান সংসদ ও পূর্ব পাকিস্তান বিধানসভার সদস্যরা ভারতে আসতে থাকেন। যারা এসেছেন তারা অনেকেই নৌকা, স্টিমার কিংবা হেঁটে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন।
কলকাতা শহরে তখন কয়েক হাজার গাড়ি (পূর্ব পাকিস্তানের নম্বর প্লেট লেখা) জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে, বন্দুক উঁচিয়ে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সামনে জড়ো হয়। মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জির কাছে তারা দাবি জানান, তাদের অর্থ, অস্ত্র দিতে হবে। তাদের দেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। অজয়বাবু সঙ্গে সঙ্গে তার ডেপুটি বিজয় সিং নাহারকে ডেকে পাঠান। তারা ইন্দিরা গান্ধীকে টেলিফোনে গোটা বিষয়টি অবহিত করেন।
ইন্দিরা গান্ধী বিজয় সিং নাহারকে নির্দেশ দেন যারা আসছে তাদের বাসস্থান, খাবার, ওষুধপত্র দাও। আমি রসদ পাঠাচ্ছি। তোমরা কাজ চালিয়ে যাও। কাউকে ফেরত পাঠাবে না। আমি বর্তমানে যেখানে থাকি, সল্টলেক, সেটাও তখন খালি ছিল। অস্থায়ী শিবিরগুলোতে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করেন বিএসএফ-এর তখনকার ডিরেক্টর জেনারেল গোলক মজুমদার। জয়েন্ট ডিজি ছিলেন শরদিন্দু মুখার্জি।
মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে জিয়া এক চাল চেলেছিলেন। নিজের নামেই অর্থাৎ জিয়াই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, সেটা প্রকারান্তরে প্রচার করে দেওয়া।
চট্টগ্রামের যুবলীগের নেতা-কর্মীরা জিয়ার সেই ঘোষণা মেনে নেননি। তারা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের বড়মাপের নেতা জহুরউদ্দিন সাহেবকে ধরে নিয়ে এসে তাকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করান।
সেদিন আমি কোথায় ছিলাম, তা একটু সংক্ষেপে বলছি। আগের দিন বিকালে মুক্তিবাহিনী ও কাদের বাহিনীর প্রায় ২০ জন যুবক আমার কাছে এসে বলেন, তাদের সঙ্গে বগুড়া যেতে হবে। বগুড়া থেকে ফেরার কথা ছিল রাত ৮-৯টার মধ্যে। কিন্তু ওই যুবকরা পথ ভুল করায় বালুরঘাট সার্কিট হাউসে পৌঁছলাম সকাল ৮টায়। আমি বগুড়ার কপি লিখতে বসেছি। সে সময় ১০-১২ জন যুবক (হাতে বন্দুক) বললেন, স্যার আমাদের দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। জিয়া সাহেব ঘোষণা করেছেন।
আমি জানতে চাইলাম জিয়া কে? আমি তো তার নাম শুনিনি। এই কথাবার্তার মাঝখানে আরও ১০-১৫ জন ছেলে আমার ঘরে ঢুকল। তারা বলল, স্যার জিয়া কেউ না। আমরা জহুর ভাইকে দিয়ে নতুন করে ঘোষণা করিয়েছি। জিয়াকে আমরা ত্রিপুরা সীমান্তের দিকে ঠেলে দিয়েছি।
খবরটি পেয়ে আমি কলকাতার অফিসে ফোন করলাম। তখন সন্তোষ কুমার ঘোষ ছিলেন আমার বস। সন্তোষ বাবু খবরটা শুনে বললেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র কার কাছে পাওয়া যাবে? আমি বললাম, তাজউদ্দিন সাহেবের কাছে।
সন্তোষবাবু বললেন, এখনই কলকাতা চলে এসো। আমি বললাম, আমার পৌঁছতে মধ্যরাত হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে আভাস পাচ্ছিলাম, সার্কিট হাউসের বাইরে প্রায় ৩ হাজার লোক জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছে। তারা আমাকেও জোর করে স্লোগান দেওয়ালো।
এদিকে কলকাতায় তাজউদ্দিন সাহেবকে ফোন করতেই তিনি বললেন, এখনই আমি তোমাদের পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র পাঠিয়ে দিচ্ছি। তাই করলেন তিনি। সন্তোষ বাবু আবার আমাকে ফোন করে বললেন, তোমাকে আর কলকাতায় ফিরতে হবে না। তুমি ওখানেই থেকে রিপোর্ট পাঠাও।
তখনো ওই চার নেতা ছাড়া অন্য কোনো বড় নেতা কলকাতায় আসেননি। চার নেতাকে রাখা হয়েছিল বিএসএফ-এর সদর দপ্তরের এক তলায়। আমি সীমান্তে শুনে এসেছিলাম, বড় নেতারা কলকাতায় পৌঁছে গেছেন। বিএসএফের ডিজি গোলক মজুমদারের সঙ্গে আমার এক ঘণ্টা কথা হয়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, নেতারা কোথায় আছেন। তিনি আমাকে বললেন, আমি জানি না। তোমার কী দরকার ওরা কোথায় আছে।
আমি সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় লক্ষ্য করি এক তলার একটি ঘর থেকে কথা ভেসে আসছে। দরজা খুলে ঢুকবেই ভেতর থেকে প্রশ্ন এল- আপনি কে? কোথা থেকে এসেছেন? আমার পরিচয় দিতেই দিনাজপুরের ইউসুফ আলী বললেন, আপনি বসুন। আপনি আমার জেলা নিয়ে লিখেছেন।
তখনো মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়নি। খন্দকার মোশতাক ও তার পরিবার ঢাকা থেকে করাচি, দুবাই, বোম্বে হয়ে কলকাতায় আসেন। মোশতাকের সেক্রেটারি মাহবুব আলম চাষী কলকাতায় এলেন। তিনি গোলক মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করে চার নেতা যেখানে ছিলেন সেখানেই তার থাকার ব্যবস্থা হলো।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন- এই খবরে গোটা বিশ্বে তোলপাড় পড়ে যায়। পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান বেরিয়ে গেছে। তার নেতা মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এই ঘোষণায় এক এক করে পাকিস্তান অ্যাম্বাসি থেকে অফিসাররা পদত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসেন।
ওই বছরই ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠিত হওয়ার আগে লেকটাউনের জয়া সিনেমা হলে সংসদ ও বিধায়কদের এক সভা হয়। সেখানে স্থির হয় চার-পাঁচজনের একটি সরকার গঠিত হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে পরে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তার অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী হোন তাজউদ্দিন আহমেদ। অতঃপর অস্থায়ী সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করে। নয় মাসের যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের ৫২ বছর পরও জিয়াউর রহমানের লোকেরা থেমে নেই। তারা নানাভাবে চেষ্টা করছে বাংলাদেশকে আবারও বিপদের মুখে ফেলার। এখন সেই লড়াই লড়ছেন বঙ্গবন্ধুতনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক