“আমার আব্বার শরীর ছিল বেশ রোগা। তাই আমার দাদি সব সময় ব্যস্ত থাকতেন কীভাবে তাঁর খোকার শরীর ভালো করা যায়। আদর করে দাদা-দাদিও খোকা বলেই ডাকতেন। আর ভাইবোন ও গ্রামবাসীর কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘মিয়া ভাই’ বলে।” আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি সম্পর্কে এভাবেই মন্তব্য করেছেন তার ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইয়ে।
টুঙ্গিপাড়াবাসীর সেই ‘মিয়া ভাই’ ৩২ বছর বয়সে (১৯৫২ সালে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন) হাল ধরেন আওয়ামী লীগের, যখন সংগঠনটির বয়স মাত্র তিন বছর। এরপর ধৈর্য আর কঠোর পরিশ্রম করে গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগকে। টানা ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার পর নির্বাচিত হন সভাপতি হিসেবে। এই দলের নেতৃত্বে সব মানুষকে এক করে ছিনিয়ে আনেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাই জনতার ভালোবাসায় প্রথমে ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং পরবর্তী সময়ে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাকশাল গঠনের আগ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। আর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিহত হওয়ার ২৯ বছর পর হয়ে ওঠেন আরও শক্তিশালী এবং জনপ্রিয় নেতা, স্বীকৃতি আসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে।
২০০৪ সালে লন্ডনভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’-এর আয়োজন করে। বিষয় ছিল সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? ৩০ দিনের চালানো ওই জরিপে শ্রোতাদের মনোনয়নে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
“বিবিসি বাংলার জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি: শেখ মুজিবুর রহমান - ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির মাধ্যমে যিনি হয়ে উঠেছিলেন জনগণের অবিসংবাদিত নেতা”- শিরোনামের এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক এই গণমাধ্যম (বিবিসি) উল্লেখ করে, শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠ ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে মুক্তি ও স্বাধীনতার পথনির্দেশনা দিয়েছিল। ২০২০ সালের ১৭ মার্চের ওই প্রতিবেদনে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ‘...মনে রাখবা- রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক জনসভায় এই বজ্রঘোষণার মাধ্যমে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।’
শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে কেন মনোনীত করেছেন- জবাবে জাপানের নাগাসাকি শহর থেকে একজন শ্রোতা মনিকা রশিদ বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আজ আমরা সারা বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যে যেখানেই বসে যা কিছু করছি, যা বলছি এর কোনোটাই সম্ভব হতো না যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়টাতে না পেতাম। তিনিই বাঙালি জাতিকে প্রথম বোঝাতে সক্ষম হন যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি- সর্বোপরি বাঙালি জাতি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইলে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে হবে। মৃত্যুভয় বা ক্ষমতার লোভ কোনো কিছুই তার দীর্ঘ সংগ্রামী মনোভাবকে দমাতে পারেনি।’
বঙ্গবন্ধুর জীবনী বর্ণনা করতে গিয়ে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ বিবিসি বাংলা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় ১৯৩৯ সালে স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত বাঙালি মুসলিম নেতা সোহরাওয়ার্দী পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। ১৯৪২ সালে এন্ট্রান্স পাস করার পর শেখ মুজিব ভর্তি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে, যেটির বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজটি তখন বেশ নামকরা ছিল। এই কলেজ থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন। তবে স্কুলজীবন থেকেই তিনি তাঁর নেতৃত্ব দেবার দক্ষতা প্রমাণ করেছেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রয়াত ড. আবদুল মতিন চৌধুরী তার ‘আমার স্মৃতিতে ভাস্বর যে নাম’ শীর্ষক প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাংগঠনিক দৃঢ়তা ও আপসহীন নেতৃত্বের কথা উল্লেখ করে লেখেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বঙ্গবন্ধু প্রথম পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া পূরণের জন্য পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্নে। তারপর ১৯৪৮-এ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র থাকাকালীন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর (পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল) মুখের ওপর প্রথম কার্জন হলের সমাবর্তন সভায় বঙ্গবন্ধু এবং টাঙ্গাইলের শামসুল হক (আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক) প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘না উর্দু নয়, বাংলাই হবে রাষ্ট্রভাষা’ যার জন্য তাঁকে সে সময় কারাবরণ করতে হয়েছিল। সরকার থেকে বলা হয়েছিল, ‘যদি ভবিষ্যতে রাজনীতি করবে না মর্মে মুচলেকা দিয়ে লিখে দেয়, তবেই তাকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং তিনি আইন পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবেন।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে মুচলেকায় স্বাক্ষর দিতে সম্মত না হওয়ায় তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।’
তারপর দ্রুতই বাঁক বদলে যাচ্ছিল। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক বিশাল জনসভায় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নির্বাচনি প্রচারণায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টিকে মূল বক্তব্য হিসেবে তুলে ধরেন এবং ছয় দফার পক্ষে জনমত তৈরি করে ছিনিয়ে এনেছিলেন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়। পরবর্তী সময়ে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আর এই দলটির নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে তার সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, নির্বাচনের সিদ্ধান্ত, নির্বাচনের ফলাফল স্পষ্টই প্রমাণ করেছিল যে বাঙালির তিনি (শেখ মুজিবুর রহমান) একমাত্র মুখপাত্র। এটা তার রাজনৈতিক ভিত্তিকে অনেক শক্ত করে দিয়েছিল।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্য, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের তিনটি বড় গুণ ছিল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, দৃঢ়চেতা এবং আপসহীন।