ঢাকা ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪

কারারক্ষীদের মাদক কারবার: লঘুদণ্ডে কমছে না অপরাধ

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:৩৩ পিএম
আপডেট: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:৫৩ পিএম
কারারক্ষীদের মাদক কারবার: লঘুদণ্ডে কমছে না অপরাধ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন একাধিক কারারক্ষী। মাদকসহ আটক হওয়ার পরও নানা অজুহাত ও মুচলেখায় পার পেয়ে যাচ্ছেন অনেকে। অসাধু একাধিক কর্মকর্তার গাফিলতি, যথাযথ দায়িত্বে অবহেলা এবং ধরা পড়ার পর লঘুদণ্ডের কারণে কারারক্ষীরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এ ছাড়া বিভাগীয় মামলার পর তদন্তের নির্দিষ্টসীমা না থাকা এবং তদন্ত চলাকালে উচ্চ মহল দিয়ে সুপারিশ ও অপরাধ প্রমাণ হলে আপিলের বিধান থাকায় কারাগারে মাদকের অপরাধ বাড়ছে। 

কারা সূত্র জানায়, কারারক্ষীরা মাদক কারবারে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরও যে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা নামমাত্র। জড়িতদের বরখাস্ত, বেতন ও পদোন্নতি না দেওয়া, চাকরিচ্যুত করা বা দূরবর্তী স্থানে বদলি না করে নিজ জেলায় বদলি করা হচ্ছে অনেককে। এ ছাড়া তাদের সংশোধনেরও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। 

জানা গেছে, ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করা হয়ে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এমন রিপোর্টই দেওয়া হয়। কারাগারের কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে থাকেন। 
নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে কর্মরত কারারক্ষী মো. সজীব মিয়া এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হতে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে বদলির আদেশপ্রাপ্ত কারারক্ষী মো. মোবারক হোসেনকে কয়েকজন মাদক কারবারিসহ সোনারগাঁ থেকে গত ১৯ মে রাত ১০টার দিকে আটক করে নারায়ণগঞ্জ ডিবি পুলিশ। 

এ বিষয়ে জেল সুপার ও পুলিশ সুপার আলোচনার পর নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের ডেপুটি জেলার সাইফুল ইসলামকে পাঠিয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয় হতে তাদেরকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়। কর্তৃপক্ষের বিনানুমতিতে কারা এলাকা ত্যাগ, শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা এবং মাদক কারবারিদের সঙ্গে আটক হওয়ায় কারা বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।

কারা সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ কারা কর্তৃপক্ষ তাদের সুবিধার্থে সজীব ও মোবারকের বদলি করার জন্য কারা উপ-মহাপরিদর্শক বরাবর চিঠি পাঠান। সজীবকে ঢাকা বিভাগীয় দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। পরে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে অভিযুক্ত কারারক্ষীকে সংশোধনের তেমন কোনো সুযোগ না দিয়ে সম্প্রতি তাকে তার নিজ জেলা নরসিংদীর পার্শ্ববর্তী জেলা কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে বদলি করা হয়।

নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের একাধিক কারারক্ষী জানান, সজীব অনেক বেশি বেপরোয়া ছিলেন। মাদক সেবন, কারাগারে মাদক প্রবেশ করানো, নারীদের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক, সুবিধামতো ডিউটি বদলসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িত।

কারা সূত্র জানায়, একই অভিযোগে ২০২১ সালের শেষ দিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের কাজ থেকে সজীবকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়। 

কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘কেউ অপরাধ করলে অবশ্যই তার শাস্তি হয়। আমরা প্রথমে বিভাগীয় মামলার ব্যবস্থা করি। এরপর অপরাধীকে সাময়িক বরখাস্ত বা বদলি করা হয়। এ ছাড়া তদন্তের পর অপরাধ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় ও অনেক ক্ষেত্রে চাকরিও চলে যায়। 

তিনি আরও বলেন, কারাগারে প্রবেশের সময় তাদের দেহ তল্লাশি করা হয়। এ ছাড়া তারা যে ব্যারাকে থাকেন সেখানেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কারাগারে মাদক প্রবেশ ঠেকাতে কারা কর্তৃপক্ষ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। 

এর আগে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে মাদকসহ গ্রেপ্তার হন কারারক্ষী সোহেল রানা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে একইভাবে গ্রেপ্তার হন প্রধান কারারক্ষী সাইফুল ইসলাম। এদের মতো অনেক কারারক্ষী মাদক কারবারে যুক্ত রয়েছেন। গত ৫ বছরে ২০২ জন কারারক্ষীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে চাকরিচ্যুত হয়েছেন ১২৫ জন ও অর্ধশত কারারক্ষীকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কারারক্ষীকে মাদক মামলায় পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ২ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া অন্য আরেকটি ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গাজীপুরের অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-৩-এর বিচারক মোসাম্মাৎ রেহেনা আক্তার এ রায় দেন। 

জানা গেছে, শুধু গত বছরই মাদকসংশ্লিষ্টতায় বিভাগীয় মামলায় ২৫ জন কারারক্ষীর শাস্তি হয়েছে। এ ছাড়া নজরদারিতে রয়েছেন ৩৫০ জন।

এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, কারারক্ষীদের মাদক কারবারে জড়িত থাকার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। ধরা পরার পর অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী তাদের প্রাথমিক অবস্থায় যে শাস্তি দেওয়া হয় তা লোক দেখানো। বিভাগীয় ব্যবস্থায় লঘু শাস্তির কারণে এটি তাদের ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। 

এ ছাড়া কতিপয় প্রভাবশলী কর্মকর্তারাও জড়িত থাকার কারণে তারা কারারক্ষীদের বিভিন্নভাবে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। তিনি বলেন, কারারক্ষীদের এই অপরাধ খুবই হালকা করে দেখা হয়। বড় অপরাধে লঘুশাস্তি হলে তাদেরও ইচ্চাশক্তি বেড়ে যায়। একজনের দেখাদেখি আরেকজন অপরাধে জড়ান। কর্তৃপক্ষের উচিত তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা। 

এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তিনি বলেন, কারাগারে সিসি ক্যামেরা থাকলেও মাদকের অপরাধ শতভাগ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। অসাধু কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় না আনলে কারাগার মাদক মুক্ত করা যাবে না।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের জেল সুপার মো. মোকাম্মেল হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, সজীব ও মোবারকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টে তারা অপরাধী প্রমাণিত হলে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। 

সংস্কার প্রস্তাব: সময় নিচ্ছে সরকার

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৫১ এএম
আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৫৫ এএম
সংস্কার প্রস্তাব: সময় নিচ্ছে সরকার
রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব বুঝতে সময় নিচ্ছে সরকার। খবরের কাগজ গ্রাফিকস

রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে অন্তর্বর্তী সরকার আরও সময় নিতে চায়। বুঝে নিতে চায় রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাবও। এ ছাড়া বিভিন্ন পেশাজীবীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোও বিবেচনায় নিয়ে এগোতে চায় সরকার। আর এ কারণেই ছয় কমিশন পুরোপুরি গঠন ও কাজ শুরু করতে সরকার আরও কিছুটা সময় নিতে চাইছে।

এদিকে বিএনপিসহ (অংশীজন) অন্যান্য রাজনৈতিক দল এ প্রশ্নে নিজেদের করণীয় নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে প্রস্তাবও তৈরি করছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে।

এদিকে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সঙ্গে কথা বলেননি সরকারের সংশ্লিষ্ট কেউ। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘এখন এই ধরনের কোনো বিষয় নেই। বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী এবং যে দলের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সেই দল আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেওয়ার একটা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চলছে। যে দলের জনপ্রিয়তা তৃণমূলে বিস্তৃত, সেই দলের নাম নিলেই অনেকের গাত্রদাহ শুরু হয়। যারা এই দলের অনুসারী, তাদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, মেরে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। এখন আর এই দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো কোনো কথা বলে না।’

বিএনপির সংস্কার প্রস্তাব 
সূত্রমতে, এরই মধ্যে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য বিএনপির ছয় সদস্যের কমিটি কাজ শুরু করেছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ। 

মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর খবরের কাগজকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, বিএনপি তাকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপি মনে করে, দ্রুত সংস্কার করে জাতীয় নির্বাচন দেওয়া প্রয়োজন। এরই মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে বিএনপি কাজ শুরু করেছে। প্রস্তাব তৈরির কাজ শেষ করে বিএনপির কেন্দ্রীয় বৈঠকে চূড়ান্ত করা হবে। বিএনপির পক্ষ থেকে তৈরি চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে। আশা করি, বিএনপির দেওয়া সংস্কার প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করা হবে।’ 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত খুবই ভালো উদ্যোগ। আমরা দলীয় ফোরামে আলোচনা করেই চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাব ঠিক করছি।’ 

তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে বিএনপি ইন্টারনাল (অভ্যন্তরীণ) কমিটি গঠন করেছে। সেখান থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব সাজেস্ট করা হবে, দলীয় ফোরামে আলোচনা করে তা আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তুলে ধরব। আশা করি, দু-এক দিনের মধ্যে আমাদের প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়ে যাবে।’ 

আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে বিএনপির সমাবেশে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত জবাবদিহিমূলক সরকার এবং সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সামনে রেখেই সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া দরকার। জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া উন্নয়ন-গণতন্ত্র বা সংস্কার কোনোটিই টেকসই ও কার্যকর হয় না।’

নির্বাচনের লক্ষ্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়ার কথা উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যেই বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসনের সংস্কার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ‘সক্ষম এবং উপযুক্ত’ গড়ে তুলতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিএনপি মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার এজেন্ডা সেটিংয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে না পারলে গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্য ব্যাহত করতে ষড়যন্ত্রকারী চক্র নানা সুযোগ গ্রহণ করতে পারে।’

প্রস্তাব তৈরি করছে জাতীয় পার্টি 
জাতীয় পার্টির প্রস্তাবে সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হবে। একই সঙ্গে প্রশাসন দলীয়করণমুক্ত করা এবং অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতেও বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রস্তাবে রাখা হবে। 

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহম্মদ কাদের (জি এম কাদের) খবরের কাগজকে বলেন, ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে দ্রুত সংস্কারের কাজ শেষ করতে হবে। প্রশাসনসহ সব জায়গায় দলীয়করণ হয়েছে। সংস্কারের মাধ্যমে এসব দলীয়করণ দূর করতে হবে। রাষ্ট্রকাঠামো ঠিক না করে নির্বাচন হলে তা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না। আবারও আমরা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেখতে চাই না।’

তিনি বলেন, সংবিধান সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। না হলে আবারও স্বৈরশাসন শুরু হবে, স্বৈরশাসকের জন্ম হবে। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে একবার আওয়ামী লীগ, একবার বিএনপি সরকার গঠন করে কর্তৃত্ববাদী সরকার তৈরি করেছিল। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর একই ঘটনা ঘটেছে। দেশ ও প্রশাসন সম্পূর্ণ দলীয়করণ করা হয়েছে। নির্বাচন নিয়ন্ত্রণের জন্য দুই পক্ষই চেষ্টা করেছে।

তিনি বলেন, সরকার পতনের আগে প্রশাসনে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ ছিল। আওয়ামী লীগ সরে যাওয়ার পর এখন বিএনপির প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। তাই প্রশাসন সম্পূর্ণ দলীয়করণমুক্ত হয়, এমন পদক্ষেপ এখন জনগণের আকাঙ্ক্ষা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্যও সংস্কার প্রয়োজন। অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে হলে অর্থ খাতে ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির প্রস্তাব থাকবে। জাতীয় পার্টি রাষ্ট্র মেরামতের জন্য সব খাতেই সুষ্ঠু, বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার চায়। এসব সংস্কার দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। এরপর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে হবে। 

জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তাব 
এদিকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রেখে সংবিধান সংশোধনসহ কয়েকটি প্রস্তাব তৈরি করেছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে এ বিষয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। প্রস্তাবে একক কর্তৃত্বপরায়ণ কোনো সরকার যাতে আগামীতে ক্ষমতায় আসতে না পারে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া, ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নির্বাচনি ব্যবস্থা, রাজনৈতিক বিভেদ ও বিভাজন কমিয়ে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি বাদ দেওয়ার কথা থাকবে। 

দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মওলানা আবদুল হালিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে আমরা প্রস্তাব দেওয়ার কথা চিন্তা করছি। বাংলাদেশে আর যাতে একক কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার না আসে, এমন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা আমরা বলব।’ 

সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে জামায়াতের দলীয় ফোরামে সংস্কার বিষয়ে কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। 

অন্যান্য রাজনৈতিক দল 
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘আমরা তখনই বলেছিলাম এটা ঠিক হচ্ছে না। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে শুরুতেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। সব পয়েন্টেই আলোচনা করা দরকার; বিশেষ করে নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে এখনই আলোচনা করা দরকার। আমরা এখন জানতে পারলাম সরকার ছয়টি কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে এবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে চায়। যদি চিঠি পাই, তবে আমরা যাব। আলোচনায় গেলে প্রথমেই জানতে চাইব, সংস্কারের লক্ষ্যে কী কী করতে চায়। তারা এই সংস্কারের বিষয়ে আমাদের কাছে পূর্ণাঙ্গ মতামত চাইলে তখন আমরা তা পেশ করব। আমাদের ডাকলে আমরা আমাদের পরামর্শ দেব। নির্বাচন সংস্কার নিয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রস্তাব আগে থেকেই ঠিক করা আছে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি আমাদের সঙ্গে নাও বসে, তাহলে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে সেসব প্রস্তাব দেশবাসীকে জানিয়ে দেব।’ 

গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর খবরের কাগজকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর বাংলাদেশকে আমরা নতুনভাবে বিনির্মাণের সুযোগ পেয়েছি। সেখানে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি প্রতিটি স্টেকহোল্ডারের মতামতের ভিত্তিতে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক সংসদ এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠনের ব্যাপারে আমাদের প্রস্তাব তুলে ধরব। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংস্কার, শিক্ষা খাতসহ রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকবে। ইতোমধ্যে আমরা রাষ্ট্র সংস্কারে আমাদের প্রস্তাব চূড়ান্ত করার কাজ শুরু করেছি।’

এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কার এজেন্ডা মোটা দাগে তিনটি। প্রথমত, আমরা রাজনৈতিক দল ও সরকার কাঠামোতে সংস্কার চাই; দ্বিতীয়ত, আইন ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার এবং তৃতীয়ত, জনপ্রশাসন ও পুলিশি ব্যবস্থাপনার সংস্কার। আমাদের প্রস্তাব হলো- দলের প্রধান ও সরকারপ্রধান একই ব্যক্তি হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য পদে পরপর অথবা বিরতি দিয়ে দুই মেয়াদের বেশি কেউ নির্বাচিত হতে পারবেন না। দলের প্রধান ও দায়িত্বশীল পদগুলোতেও একজন ব্যক্তি দুই বা তিন মেয়াদের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এতে দলে গণতন্ত্রের চর্চা, নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি ও জবাবদিহির পথ সুগম হবে। ব্যক্তি বা পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির পথ রুদ্ধ হবে এবং দুর্নীতি কম হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানান।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। আর সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে প্রথমে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিকের নাম ঘোষণা করা হলেও পরে তা পরিবর্তন করে অধ্যাপক আলী রীয়াজকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

১ অক্টোবর থেকে ছয় কমিশনের কাজ পুরোদমে শুরুর কথা থাকলেও তা হয়নি। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রধান নির্বাচন করা হয়েছে। এর মানে কমিশনের কাজ কিন্তু শুরু হয়েছে। তবে পুরোদমে শুরু করার আগে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা বসতে চায়। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোই আমাদের স্টেকহোল্ডার (অংশীজন)। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসা হবে।’ 

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনে আট থেকে নয়জনকে সদস্য হিসেবে, সর্বোচ্চ ১০ জন নেওয়া হবে। সদস্যদের বিষয়ে আমি মতামত দিয়েছি। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের ঊর্ধ্বতনরা নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্যদের বিষয়ে আরও বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবেন। তাই সদস্য বাড়তে বা কমতে পারে। আমি আশা করছি, অল্প সময়ের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি হবে। সংস্কারকাজে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পরামর্শ আশা করছি।’ 

পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাকে দায়িত্ব দেওয়ার পর থেকেই সংস্কারের বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছি। এখন সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে সদস্য চূড়ান্ত করার পর প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। সংস্কার বিষয়ে শুধু রাজনৈতিক দল না, সমাজের অন্যদের মতামতেরও গুরুত্ব দিতে চাই। সবার কাছ থেকেই মতামত নেওয়া হবে।’ 

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৯তম অধিবেশনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণে সংস্কার সম্পর্কে বলেন, মানুষের আস্থা ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে এবং নির্মম অতীত যেন আর ফিরে না আসে, সে জন্য আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট খাতে সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা-ব্যবস্থা সংস্কারে স্বাধীন কমিশন গঠন করেছি। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের সংস্কারের জন্য পৃথক কমিশনসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে জোর তৎপরতা দুদকের

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৩০ এএম
আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৩৫ এএম
পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে জোর তৎপরতা দুদকের
গ্রাফিকস: মেহেদী হাসান

বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাচারের তথ্য চেয়ে এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৭১টি চিঠি বা পারস্পরিক আইনি সহায়তার জন্য অনুরোধ (মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল এসিস্টেন্স রিকোয়েস্ট-এমএলএআর) পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে জবাব এসেছে ২৭টির। ১০টি দেশে পাচার হয়েছে সবচেয়ে বেশি টাকা। দেশগুলো হলো- কানাডা, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেম্যান আইল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড।

এমএলএআরের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে দুদক। আইনি ব্যবস্থা নিতে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ অপরিহার্য। তাই প্রয়োজনীয় দালিলিক প্রমাণের অভাবে বছরের পর বছর অনিষ্পন্ন রয়েছে দুদকের ১৫৭টি অনুসন্ধান। এখন সেসব তথ্যের অপেক্ষায় আছেন দুদক কর্মকর্তারা।

এমএলএআরের মাধ্যমে তথ্য পেলে অন্তত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করে অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব। এমএলএআর প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তাদের সেসব দেশ ভ্রমণে পাঠানো হতে পারে। পাশাপাশি পাচারের টাকা ফেরাতে সব রকম চেষ্টা চালানো হবে দুদক সূত্র জানিয়েছে। 

অবশ্য পাচারের টাকা ফেরাতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দপ্তর (ইউএনওডিসি), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে দুদক।

গতকাল মঙ্গলবারও রাজধানী সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৪ সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দুদকের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ থেকে পাচার টাকা ফেরত আনতে সহযোগিতা চেয়েছে দুদক। প্রতিনিধিদলটিও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। বৈঠকের পর দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে সেই দেশগুলোর নাম উল্লেখ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। তারা আমাদের সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছে। ইতোমধ্যে পাচারের তথ্য চেয়ে ৭১টি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে জবাব এসেছে ২৭টির।’

পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে আগেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। সবাই সহযোগিতা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। গত ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর দুদক প্রধান কার্যালয়ে দুদকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ শাখার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এফবিআই ও ইউএনওডিসির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে পৃথক বৈঠক হয়েছে। আইএমএফের সঙ্গে কয়েক মাস আগেও দুদকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে পারে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছেন।

দুদকের শীর্ষস্থানীয় একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে-বিদেশে পাচার হওয়া টাকার প্রমাণ সংগ্রহ করতে না পারায় এখনো অর্থ পাচারসংক্রান্ত দেড় শতাধিক অভিযোগের অনুসন্ধান অনিষ্পন্ন রয়েছে। ফলে তদন্ত কর্মকর্তাদের সেসব দেশে পাঠিয়ে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা যায় কি না, তা বিবেচনা করছে কমিশন। এতে বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয়ের সম্ভাবনা থাকায় বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকার চাইলে কমিশন ভবিষ্যতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। 

দুদকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশ-বিদেশে অর্থ পাচারসংক্রান্ত অন্তত ১৫৭টি মামলা অনিষ্পন্ন রয়েছে। এর মধ্যে গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১৪৮টি মামলা অনিষ্পন্ন ছিল। গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১৭টির অনুসন্ধান শেষে মামলা করা হয়। এ ছাড়া চলতি বছর জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৯ মাসে আরও ২৬টি অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, অর্থ পাচার রোধ ও পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেই আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ ধরনের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়। দুদকের এমএলএআর পাঠানো হয় অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের মাধ্যমে এবং এর জবাবও আসে একই মাধ্যমে। এমএলএআর-এ বলা হয়, অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করে সেসব দেশে অর্থসম্পদ গড়ে তুলেছেন, যা বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। অর্থ পাচারের অভিযোগে সেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুদক আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশে অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে-বেনামে থাকা অর্থসম্পদের দালিলিক তথ্য পাওয়া গেলে বিচারকাজে সহায়ক হবে। 

এ প্রক্রিয়ায় ওই সময় (ওয়ান ইলেভেন) কানাডা, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে তথ্যউপাত্ত চেয়ে এমএলএআর পাঠায় দুদক। পরে বাংলাদেশ টাকা পাচারের শীর্ষ ১০ দেশসহ নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, ভারত, লুক্সেমবার্গ, বারমুডাসহ বিভিন্ন দেশের তালিকা করা হয়।

২০১৩ সালে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনিসহ দেশের কয়েকজন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকের পাচার করা টাকা ফেরত আনতে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, হংকং ও কানাডায় এমএলএআর পাঠানো হয়। 

ভারতে পি কে হালদারের টাকা পাচারের ঘটনায় হাইকোর্টে দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে দেশে অর্থ পাচার আইনে ৫ বছরে (২০১৬ থেকে ২০২০) কতটি মামলা হয়েছে এবং কতজনকে আসামি করা হয়েছে, সেসবের তালিকা চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। নিদের্শনা অনুযায়ী, সে সময় প্রতিবেদন আকারে একটি তালিকা হাইকোর্টে জমা দেয় দুদক। প্রতিবেদনে ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত অর্থ পাচার আইনে ১৩৫টি মামলা দায়েরের কথা উল্লেখ করা হয়। এতে ৪৭টি মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল এবং বাকি ৮৮টির তদন্ত চলমান থাকার কথা বলা হয়। প্রতিবেদনে অর্থ পাচার মামলায় অভিযুক্তের তালিকায় এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বহিষ্কৃত কর্মচারী আবজাল, বিসমিল্লাহ গ্রুপের কর্ণধার খাজা সোলায়মান ও তার স্ত্রী, বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল আলম, জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ, ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান বাদল, ঢাকা ট্রেডিংয়ের কর্ণধার টিপু সুলতান, শাহরিস কম্পোজিট টেক্সটাইলের এমডি খাজা সোলেমান আনোয়ার, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান, যুবলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, ঠিকাদার জি কে শামিম, যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা সম্রাট, ক্যাসিনো সেলিম, এনটেক্সের কর্ণধার ইউনুস বাদল, এম এম ভেজিটেবলের চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন, এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াহিদুল হক, ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান বাবুল চিশতি ও তার ছেলে, ভোলার সাবেক এমপি হাফিজ ইব্রাহিম, লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক এমপি পাপুল, এনসিসি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান, লর্ড ভিশনের চেয়ারম্যান হোসাইন মাহমুদ রাসেল, সাবেক পুলিশ পরিদর্শক ফিরোজ কবীর, ডিএমপির হুমায়ুন কবীর বাতেন, সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সালাম, ইলিয়াস ব্রাদার্সের এমডি শামসুল আলম, টেলিটকের সাবেক ম্যানেজার শাহ মোহাম্মদ যোবায়ের, প্যারাডক্স ফার্মাসিউটিক্যালসের সাবেক এমডি রকিবুল হাসান রাজন, আমানত স্টিলের এমডি হারুনুর রশীদ, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন, এএমসি টেক্সটাইলের সাবেক চেয়ারম্যান চাঁদ মিয়া, আইন কমিশনের ড্রাইভার শামসুল আলমের নাম উল্লেখ করা হয়। অভিযুক্তরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে টাকা পাচার করেছেন বলে দুদকের প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অর্থ পাচারের অভিযোগে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ বেশকিছু প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী-এমপি, সাবেক আমলা ও রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।

নড়েচড়ে বসছে প্রশাসন

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০৭ পিএম
আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:২২ পিএম
নড়েচড়ে বসছে প্রশাসন
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তি হলো আজ ৮ সেপ্টেম্বর। এ সময়ের মধ্যে প্রশাসন সকল পর্যায়ে নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে। 

দেখা গেছে, গত এক মাসে কখনো সরকারি নির্দেশে, আবার কখনো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের উদ্যোগে উচ্চ পদ থেকে শুরু করে নিম্ন পদ পর্যন্ত বদলি, পদোন্নতিসহ নতুন নিয়োগ হয়েছে। টানা দেড় দশকের বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনার সরকার ছিল। এ সময় যে প্রভাব প্রশাসনের সর্বস্তরে জেঁকে বসেছিল, তার অবসান ঘটাতে প্রশাসনিক এই রদবদল বলে জানা গেছে। এর মূলে রয়েছে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নতুন সরকারের চেতনা ও প্রতিশ্রুতি। কিন্তু পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং তাদের সহযোগীরা নিজেদের খোলস পাল্টে বঞ্চিত হিসেবে জাহির করে আবার স্বরূপে ফিরে আসার চেষ্টা করছেন।  

অন্তর্বর্তী সরকারকে গত এক মাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং বেসরকারি পর্যায়ে রদবদল ও পুনঃনিয়োগের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যাংক-বিমা ও পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেও এই পরিবর্তন ঘটেছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে।  

সাবেক সচিব ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, অভ্যুত্থান ঘটাতে ছাত্র-জনতার সঙ্গে বিগত সরকারের সময়ে সুবিধাবঞ্চিত ও অন্যায়-অবিচারের শিকার হওয়া লোকজনও ছিলেন। কিন্তু এসব মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সুযোগসন্ধানী কিছু লোক ও গোষ্ঠী। তাদের বিরুদ্ধে দলীয় লেজুড়বৃত্তি করে ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধি করা এবং রাষ্ট্র ও জনগণের বিপুল ক্ষতির অভিযোগ রয়েছে। এখন এরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছেন। এই সুযোগসন্ধানীদের চিহ্নিত করে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। তা না হলে প্রশাসনে সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকারের যে অঙ্গীকার তা ব্যাহত হবে।

এ প্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারের বহু বাণিজ্যিক এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও নানা কারণে অভিযুক্তরা আবার ফিরে আসার চেষ্টা করছেন এবং এদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। 

গোলাম রহমান আরও বলেন, এদের কারণে আবারও সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা পেতে জনগণকে দুর্ভোগ পোহাতে হতে পারে বা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্র ও জনগণের  অর্থ লোপাটের আশঙ্কা থেকেই যাবে।

তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে, অনিয়ম-অত্যাচার এবং অবিচার-দুর্নীতির অবসান ঘটাতেই জুলাইয়ের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আগস্টের প্রথম সপ্তাহে অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান হয়েছে। একটি পরাক্রমশালী সরকারপ্রধানকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে ও তার সহযোগীরা জনরোষের মুখে অনিরাপদ হয়ে পড়েছেন। তাই চূড়ান্ত বিচারে জনগণকে সুশাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতেই এই সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা।  

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, পরিবর্তনটা অবশ্যম্ভাবী। তবে তা হতে হবে যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা ও অতীতের সার্ভিস রেকর্ডের ভিত্তিতে। সবাইকে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। কারণ একটা রাজনৈতিক সরকারের দীর্ঘ মেয়াদ পার হয়েছে। সেখানে সব স্তরে তাদের লোক রয়েছে। 

সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ নিজে থেকেই সরে গেলেও অনেকে তা করেননি বা করতে চান না। দেশবাসীকে সুশাসন ও ন্যায়বিচার উপহার দিতে হলে স্বল্প মেয়াদে না হলেও মধ্যম বা দীর্ঘ মেয়াদে এই পরিবর্তনটা সম্পন্ন করার প্রয়োজন হবে। বিশেষ করে ওপরের দিকে যারা ‘রেগুলেটরি পয়েন্ট অব ভিউ’ বা নিয়ন্ত্রক কিংবা ব্যবস্থাপনাপ্রধানের ভূমিকায় থাকবে এবং নতুন সরকারকে সংস্কারে যথাযথ সহায়তা করবে, তাদের পরিবর্তনটা একটু দেখেশুনে করতে হবে। 

ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, দেশে লাখ লাখ শিক্ষিত ও চাকরিপ্রত্যাশী বেকার যুবক রয়েছেন। সরকারের প্রশাসনকে তার নিজস্ব ধারায় চলার সুযোগ করে দিতে হলে সবার আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাগরিকবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে। কারণ হলো, সব ক্ষেত্রেই পুলিশ দরকার হয়। এ জন্য পুলিশ ও এর সহযোগী আনসার বাহিনীতে শিক্ষিত বেকার যুবকদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। অন্তত এক হাজার উপপরিদর্শক (এসআই) দ্রুত নিয়োগ দেওয়া দরকার। তাদের পুলিশের মিরপুর, রাজশাহীর সারদা, আনসার বাহিনী ও স্কাউটসের মৌচাক সদর দপ্তর এবং সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে তিন মাসের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নামানো যেতে পারে। তারপর ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের আইন ও মানবাধিকার-সম্পর্কিত দক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আনসার-ভিডিপি ও পুলিশ কনস্টেবল পদেও বিপুলসংখ্যক নিয়োগ হতে পারে। মোদ্দাকথা সরকারকে সর্বক্ষেত্রে ‘ফ্রেশ ব্লাড’ নিয়োগ দিতে হবে। সরকারি চাকরি করলেই বেতনের বাইরে অর্থ রোজগার করা যায়- এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হবে না। পুরোনোরা এ ধারণায় অন্ধ হয়ে পড়েছেন। তাই ‘ফ্রেশ ব্লাড’ দরকার।   

তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে, বিশেষ করে প্রাথমিক ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যলয়গুলোতে ৪০ হাজারের বেশি শিক্ষক ও অন্যান্য জনবলের ঘাটতি পূরণে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় শিক্ষিত বেকারদের নিয়োগ দিতে পারে সরকার। এসবের মাধ্যমে প্রশাসনিক সংস্কার-পরবর্তী সার্ভিস ডেলিভারি বা সেবা দিলে তা অন্তর্বর্তী সরকারের চেতনা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।

আকস্মিক বন্যার চ্যালেঞ্জ

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:০৪ পিএম
আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৪ পিএম
আকস্মিক বন্যার চ্যালেঞ্জ
বন্যায় তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি। ছবি: খবরের কাগজ

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ১২ দিনের মাথায় দেখা দেয় আকস্মিক বন্যা। ভারী বৃষ্টিপাত আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে প্লাবিত হয় ফেনীসহ দেশের ১১ জেলা। পানিবন্দি হয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। বন্যাদুর্গতদের নিরাপদে উদ্ধার এবং ত্রাণ বিতরণে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে নতুন সরকার। তবে সবার সম্মিলিত চেষ্টায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ সফলভাবে বন্যা মোকাবিলা করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ নাজমুল আবেদীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা সবার সমন্বয়ে প্রাথমিকভাবে বন্যাপরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি। এখন আমরা পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করব।’

গত ২০ আগস্ট থেকে ফেনীর নিচু অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়। কয়েক দিনের মধ্যে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। প্লাবিত হয় ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, কোস্টগার্ডের সদস্যরা উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এতে যোগ দেয় বেসরকারি বিভিন্ন সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এ পর্যন্ত বন্যায় ৭১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে ফেনী জেলায়। অর্ধলাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিশেষ পরিস্থিতিতে বন্যার আক্রমণ মোকাবিলায় এগিয়ে আসে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। তীব্র স্রোতে স্পিডবোটের অভাবে উদ্ধার কার্যক্রমে বিলম্ব হওয়ায় অনেকেই ট্রাকে করে নৌকা নিয়ে রওয়ানা দেন ফেনী অভিমুখে। প্রতিকূল পরিস্থিতি উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই ছুটে যান শুকনা খাবার, জরুরি চিকিৎসাপণ্যসহ নানা সামগ্রী নিয়ে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সংশ্লিষ্টদের বন্যাকবলিত মানুষের পাশে থাকার নির্দেশনা দেন। ঐক্যবদ্ধভাবে বন্যা মোকাবিলার আহ্বান জানান উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা।

গত ২৪ আগস্ট গঠন করা হয় প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল। স্বল্প সময়ে ব্যাপক সাড়া পড়ে তহবিলে। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের এক দিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ তহবিলে জমা দেন। অনেক গণমাধ্যমও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। একই সঙ্গে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিতরণ করা হয় ত্রাণ। গতকাল পর্যন্ত সরকার নগদ ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ২০ হাজার ৬৫০ টন চাল, ১৫ হাজার বস্তা শুকনা ও অন্যান্য খাবার, ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার শিশুখাদ্য এবং সমপরিমাণ গো-খাদ্য বিতরণ করেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য মেডিকেল টিম চালু আছে ৪৬৯টি।

এসব ত্রাণ কার্যক্রমে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ সংশ্লিষ্টদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থাও বন্যা মোকাবিলায় এগিয়ে আসে।

গণত্রাণ নিয়ে ছাত্র-জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণ
হঠাৎ বন্যায় সরকারকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে ছাত্র-জনতা। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে সামর্থ্য অনুযায়ী ত্রাণ নিয়ে ছুটে আসে হাজার হাজার জনতা। ত্রাণ জমা দিতে দীর্ঘ সময় তাদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। নগদ টাকা, স্বর্ণালংকারের পাশাপাশি শুকনা খাবারে পূর্ণ হয়ে যায় টিএসসির ক্যাফেটেরিয়া। বাধ্য হয়ে ত্রাণ রাখতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রেও। অনেকেই তাদের প্রিয় জিনিস জমা দেন বন্যাদুর্গতদের জন্য। কেউবা পছন্দের গহনা নিয়ে চলে আসেন। তাদের জমানো অর্থ নিয়ে আসে শিশুরা। প্রায় ১১ কোটি টাকা জমা পড়ে ছাত্রদের এই তহবিলে। ছাত্রদের ওপর আস্থা থাকায় এটি সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গণত্রাণ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রেজওয়ান আহম্মেদ রিফাত খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে যখন যেটা করা দরকার সেটা করার চেষ্টা করি। যখন ২০ আগস্ট আমরা জানলাম হঠাৎ বন্যার বিষয়ে, তখন আমরা রেসকিউ টিম করলাম।  সেদিনই এক ট্রাক শুকনা খাবার পাঠানো হয়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় আমাদের ফোরামে আলোচনা হয় বড় পরিসরে কাজ করার জন্য। তারপর গণত্রাণ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। যেটাতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। আমরা ১ কোটি ৭০ লাখ টাকার মতো ত্রাণ দিই। বাকি অর্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ও দুজন সমন্বয়কের যৌথ অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে। আমরা এই টাকা বন্যাদুর্গতদের পুনর্বাসনে ব্যয় করব।’

পুলিশ বাহিনী সংস্কারের তাগিদ

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫৭ এএম
আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৫ পিএম
পুলিশ বাহিনী সংস্কারের তাগিদ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

শেখ হাসিনার সরকারের পতন-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনায় ছিল পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা। কারণ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় সাড়ে ৬ শ মানুষ।

এ ছাড়া আহত হয়েছেন ১৮ হাজার মানুষ। এমন পরিস্থিতির কারণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ বাহিনী সংস্কারের বিষয়টি আলোচনায় আসে।

ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে দাবি উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যেও এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় এ সংস্কার হবে সে বিষয়ে কোনো রূপরেখা এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।

অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ বাহিনীর মোট জনবলের অর্ধেকের বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে। নিয়োগের সময় রাজনৈতিক মতাদর্শকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরোধী দল নিয়ন্ত্রণে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বলা হচ্ছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করতেন।

এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের হেভিওয়েটদের সঙ্গে তাদের সখ্য তৈরি হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ওই পুলিশ কর্মকর্তারা অধস্তনদের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে। পরে সরকারের পতনের পর তারা সটকে পড়েন। তবে নিচু সারির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা (কনস্টেবল-পরিদর্শক) জনগণের রোষানলে পড়েন। তাদের ওপর হামলা হয়। মারা যান ৪০ জনেরও বেশি পুলিশ সদস্য। এসব কারণে পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে একটি কমিশন গঠন করা হবে বলেও অন্তবর্তী সরকারের এক উপদেষ্টার পক্ষ থেকে জানানো হয়।
পুলিশ বাহিনীর ইতিহাস

১৮৬১ সালে ‘দ্য কমিশন অব দ্য পুলিশ অ্যাক্ট’ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয়। ওই আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতের প্রতিটি রাজ্যে একটি করে পুলিশ বাহিনী গঠিত হয়। রাজ্য পুলিশ প্রধান হিসেবে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ পদ এবং জেলা পুলিশ প্রধান হিসেবে সুপারিনটেনটেন্ড অব পুলিশ পদ সৃষ্টি করা হয়।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বাংলাদেশের পুলিশের নাম প্রথমে ‘ইস্ট বেঙ্গল পুলিশ’ রাখা হয়। পরে এটি পরিবর্তিত হয়ে ‘ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ’ নাম ধারণ করে। একাত্তরের পর বাংলাদেশ পুলিশ নামে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়। ব্রিটিশ আমল থেকে পুলিশের পোশাক ছিল খাকি রঙের। ২০০৪ ও ২০১৬ সালে পুলিশের কয়েকটি ইউনিটের পোশাকের রঙ পরিবর্তন করা হয়েছিল। মহানগর ও জেলা পর্যায়ে দুই রঙের পোশাক দেওয়া হয়েছিল। আবার পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও ব্যাটালিয়নভেদে পোশাকের ভিন্নতা রয়েছে। পুলিশের এসব সংস্কারে বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পুলিশের বর্বরোচিত ভূমিকা এ বাহিনীর সংস্কারের প্রয়োজনকে আরও তীব্র করে তুলেছে। এরই মধ্যে পুলিশের পোশাক ও মনোগ্রাম পরিবর্তনের দাবি উঠেছে। তবে পুলিশ বাহিনীর মূল সমস্যা হলো বাহিনীটির রাজনীতিকীকরণ। ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ পুলিশের মোট সদস্য সংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাজার। এর মধ্যে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কনস্টেবল ও উপপরিদর্শক (এসআই) পদে যথাক্রমে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৯২৫ এবং সাড়ে ১১ হাজার। এ থেকে বোঝা যায়, মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের অর্ধেকের বেশিই নিয়োগ হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে। নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের বড় একটি অংশ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন বলে আলোচনা রয়েছে।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ বাহিনীর দলীয়করণের বিষয়টি আলোচনায় আসে। পরের সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী শক্তি দমনে পুলিশ বাহিনী হাতিয়ারে পরিণত হয়।

বিরোধীদের দমনের জন্য গত প্রায় ১৬ বছরে দেড় লাখ মামলায় বিএনপির ৫০ লাখ লোককে আসামি করা হয়। ফলে দলটির রাজপথে রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়ে। গত ৩ সরকারের আমলে পুলিশের শতশত গায়েবি মামলা আলোচনায় আসে। এসব মামলার সূত্র ধরে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ওপর দমন-নিপীড়ন শুরু হয়। গুম-অপহরণসহ আলোচিত নানা হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পুলিশে দলীয়করণের বিষয়টি জনসমক্ষে স্পষ্ট হয়। 

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে এ আলোচনা-সমালোচনা বাড়তে থাকে। এভাবেই পুলিশ বিতর্কিত হয়। সর্বশেষ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রায় সাড়ে ছয় শ জনকে হত্যার ঘটনা এখন ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। ফলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনীও জনরোষের মুখে পড়ে। এ কারণে সংস্কার করে একে সুশৃঙ্খল বাহিনীতে পরিণত করার দাবি ওঠে।

এদিকে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন বাহিনীটির অভ্যন্তরীণ বৈষম্য নিরসনের দাবি উঠেছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতার আক্রমণে নিহত পুলিশ সদস্যদের বেশির ভাগই কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার। তারা বলছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তারা ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছেন। বাহিনীর অতি উৎসাহী ওই কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে নিচের সারির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহার করেছেন। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর তাদের বেশির ভাগই আত্মগোপনে চলে গেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় তারা নানাভাবে সুবিধা ভোগ করেছেন। কিছু কর্মকর্তার কাছে পুরো বাহিনী জিম্মি ছিল। অনিয়মের মাধ্যমে তারা অর্থবৈভবের মালিক হয়েছেন। সময় বুঝে তারা এখন সটকে পড়েছেন। তাই নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন দাবি করে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন। তাদের দাবি পূরণে ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করেছেন সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া আইজিপি ময়নুল ইসলাম।

ঊর্ধ্বতনদের এই স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলামও। দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কতিপয় উচ্চাভিলাষী, অপেশাদার কর্মকর্তার কারণে এবং কর্মকৌশল প্রণয়নে বলপ্রয়োগের স্বীকৃত নীতিমালা অনুসরণ না করায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। নেতৃত্বের ব্যর্থতায় আমাদের অনেক সহকর্মী আহত, নিহত ও নিগৃহীত হয়েছেন।’

পুলিশ কমিশন গঠন করা হবে
এদিকে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার প্রসঙ্গে মত দিয়েছেন বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেছেন, ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু এটা এখনো প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। আগে অপরাধীরা পুলিশকে ভয় পেত কিন্তু এখন ভালো মানুষ ভয় পায়।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভ্যানে লাশের স্তূপের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশ বাহিনীর সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি আরও বলেন, পুলিশ কমিশন গঠন করা হবে। পুরো বাহিনীর সংস্কার প্রয়োজন। যখন যারা ক্ষমতায় ছিল এই বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। তা ছাড়া পুলিশের মধ্যে একটা তাড়না আছে নিজেদের সংস্কারের বিষয়ে। তারা বুঝতে পারছে জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে অনেক কাজ করতে হবে।

উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আপনি ১৮৬১ সালের ব্রিটিশ আমলের পুলিশ আইন দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পুলিশ চালাচ্ছেন। ব্রিটিশরা কি বাংলাদেশে এসেছিল জনমুখী একটা পুলিশ দিতে? তা তো তারা আসেনি। সবকিছুই আলোচনা হয়েছে, পুলিশ কমিশন যখন হবে, যখন জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলো আমরা পাব, সবাইকে নিয়ে আলোচনা করে যাতে একটা জনবান্ধব পুলিশবাহিনী গড়ে তুলতে পারি সেটাই আমাদের ইচ্ছা।’

পুলিশ সদস্যদের ট্রমা কাটছে না
বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকারি হিসেবে ৪০ জনের বেশি পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এ সময় দেশব্যাপী সাড়ে ৪ শর মতো থানা, পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর করা হয়েছে। কাজে ফিরলেও পুলিশ সদস্যরা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে জনরোষে পড়ার ভয়ে সতর্কতার সঙ্গে তারা দায়িত্ব পালন করছেন। কারও কারও কর্মস্পৃহাও কমে গেছে। আবার পুলিশের একটি অংশ যারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, তারা মামলা ও হামলার আতঙ্কে আছেন। তৎকালীন আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং হচ্ছে।

অন্যদিকে যারা মাঠপর্যায়ে আন্দোলন দমনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছিলেন, তাদের মধ্যে বেশি শঙ্কা কাজ করছে। কারণ আন্দোলন দমন করতে তারা গুলি ছোড়াসহ অনেক শক্তি প্রয়োগ করেছেন। সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব পড়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর। ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে খুন, ছিনতাই ও ডাকাতি বেড়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পুলিশের ওপর বড় ধরনের ধকল গেছে। এটি দ্রুত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। 

আন্দোলনের সময় ঢাকাসহ সারা দেশে ৪২ জন পুলিশ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ হাজার ১১৭ জন। অনেকেই এখনো রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কর্মক্ষেত্রে ফিরতে তাদের অনেক সময় লাগবে। তবে কর্মকর্তারা আশা করছেন, সংকট দ্রুতই কেটে যাবে এবং পুলিশ আগের মতো জনসেবা শুরু করবে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এটা দূর করতে পুলিশকে প্রেরণামূলক বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। 

রাজশাহীর সারদায় পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিযুক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডিআইজি জানান, আন্দোলন দমনে নিচু সারির সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথা শুনতে বাধ্য হন। কথা না শুনলে তাদের চাকরি থাকবে না, বিধায় তারা বাধ্য হয়ে শক্তি প্রয়োগ করেছেন। অনেকেই সরাসরি গুলি করতে বাধ্য হয়েছেন। এসব পুলিশ সদস্য বেশি ট্রমায় ভুগছেন। তিনি দাবি করেন, দীর্ঘদিন সরকার পরিবর্তন না হওয়ার কারণে পুলিশের মধ্যে একটি গ্রুপ আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এতে কিছু পুলিশ সদস্য বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।