কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন একাধিক কারারক্ষী। মাদকসহ আটক হওয়ার পরও নানা অজুহাত ও মুচলেখায় পার পেয়ে যাচ্ছেন অনেকে। অসাধু একাধিক কর্মকর্তার গাফিলতি, যথাযথ দায়িত্বে অবহেলা এবং ধরা পড়ার পর লঘুদণ্ডের কারণে কারারক্ষীরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এ ছাড়া বিভাগীয় মামলার পর তদন্তের নির্দিষ্টসীমা না থাকা এবং তদন্ত চলাকালে উচ্চ মহল দিয়ে সুপারিশ ও অপরাধ প্রমাণ হলে আপিলের বিধান থাকায় কারাগারে মাদকের অপরাধ বাড়ছে।
কারা সূত্র জানায়, কারারক্ষীরা মাদক কারবারে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরও যে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা নামমাত্র। জড়িতদের বরখাস্ত, বেতন ও পদোন্নতি না দেওয়া, চাকরিচ্যুত করা বা দূরবর্তী স্থানে বদলি না করে নিজ জেলায় বদলি করা হচ্ছে অনেককে। এ ছাড়া তাদের সংশোধনেরও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
জানা গেছে, ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করা হয়ে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এমন রিপোর্টই দেওয়া হয়। কারাগারের কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে থাকেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে কর্মরত কারারক্ষী মো. সজীব মিয়া এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হতে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে বদলির আদেশপ্রাপ্ত কারারক্ষী মো. মোবারক হোসেনকে কয়েকজন মাদক কারবারিসহ সোনারগাঁ থেকে গত ১৯ মে রাত ১০টার দিকে আটক করে নারায়ণগঞ্জ ডিবি পুলিশ।
এ বিষয়ে জেল সুপার ও পুলিশ সুপার আলোচনার পর নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের ডেপুটি জেলার সাইফুল ইসলামকে পাঠিয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয় হতে তাদেরকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়। কর্তৃপক্ষের বিনানুমতিতে কারা এলাকা ত্যাগ, শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা এবং মাদক কারবারিদের সঙ্গে আটক হওয়ায় কারা বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
কারা সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ কারা কর্তৃপক্ষ তাদের সুবিধার্থে সজীব ও মোবারকের বদলি করার জন্য কারা উপ-মহাপরিদর্শক বরাবর চিঠি পাঠান। সজীবকে ঢাকা বিভাগীয় দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। পরে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে অভিযুক্ত কারারক্ষীকে সংশোধনের তেমন কোনো সুযোগ না দিয়ে সম্প্রতি তাকে তার নিজ জেলা নরসিংদীর পার্শ্ববর্তী জেলা কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে বদলি করা হয়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের একাধিক কারারক্ষী জানান, সজীব অনেক বেশি বেপরোয়া ছিলেন। মাদক সেবন, কারাগারে মাদক প্রবেশ করানো, নারীদের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক, সুবিধামতো ডিউটি বদলসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িত।
কারা সূত্র জানায়, একই অভিযোগে ২০২১ সালের শেষ দিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের কাজ থেকে সজীবকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়।
কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘কেউ অপরাধ করলে অবশ্যই তার শাস্তি হয়। আমরা প্রথমে বিভাগীয় মামলার ব্যবস্থা করি। এরপর অপরাধীকে সাময়িক বরখাস্ত বা বদলি করা হয়। এ ছাড়া তদন্তের পর অপরাধ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় ও অনেক ক্ষেত্রে চাকরিও চলে যায়।
তিনি আরও বলেন, কারাগারে প্রবেশের সময় তাদের দেহ তল্লাশি করা হয়। এ ছাড়া তারা যে ব্যারাকে থাকেন সেখানেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কারাগারে মাদক প্রবেশ ঠেকাতে কারা কর্তৃপক্ষ কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
এর আগে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে মাদকসহ গ্রেপ্তার হন কারারক্ষী সোহেল রানা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে একইভাবে গ্রেপ্তার হন প্রধান কারারক্ষী সাইফুল ইসলাম। এদের মতো অনেক কারারক্ষী মাদক কারবারে যুক্ত রয়েছেন। গত ৫ বছরে ২০২ জন কারারক্ষীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে চাকরিচ্যুত হয়েছেন ১২৫ জন ও অর্ধশত কারারক্ষীকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কারারক্ষীকে মাদক মামলায় পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ২ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া অন্য আরেকটি ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গাজীপুরের অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-৩-এর বিচারক মোসাম্মাৎ রেহেনা আক্তার এ রায় দেন।
জানা গেছে, শুধু গত বছরই মাদকসংশ্লিষ্টতায় বিভাগীয় মামলায় ২৫ জন কারারক্ষীর শাস্তি হয়েছে। এ ছাড়া নজরদারিতে রয়েছেন ৩৫০ জন।
এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, কারারক্ষীদের মাদক কারবারে জড়িত থাকার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। ধরা পরার পর অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী তাদের প্রাথমিক অবস্থায় যে শাস্তি দেওয়া হয় তা লোক দেখানো। বিভাগীয় ব্যবস্থায় লঘু শাস্তির কারণে এটি তাদের ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না।
এ ছাড়া কতিপয় প্রভাবশলী কর্মকর্তারাও জড়িত থাকার কারণে তারা কারারক্ষীদের বিভিন্নভাবে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। তিনি বলেন, কারারক্ষীদের এই অপরাধ খুবই হালকা করে দেখা হয়। বড় অপরাধে লঘুশাস্তি হলে তাদেরও ইচ্চাশক্তি বেড়ে যায়। একজনের দেখাদেখি আরেকজন অপরাধে জড়ান। কর্তৃপক্ষের উচিত তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা।
এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তিনি বলেন, কারাগারে সিসি ক্যামেরা থাকলেও মাদকের অপরাধ শতভাগ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। অসাধু কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় না আনলে কারাগার মাদক মুক্ত করা যাবে না।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের জেল সুপার মো. মোকাম্মেল হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, সজীব ও মোবারকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টে তারা অপরাধী প্রমাণিত হলে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।