পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহারে সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারপরও দোকানে দোকানে, মানুষের হাতে হাতে, ঘরে ঘরে ব্যবহার হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। অন্যদিকে প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল থেকে শুরু করে শিশুদের খেলনাসামগ্রী ও বাসাবাড়ির বিভিন্ন সামগ্রী দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। ব্যাপ্তিও বাড়ছে। এসব পণ্য শুধু দেশেই ব্যবহার হচ্ছে না, বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানির পরিধি বাড়াতে বিভিন্ন মেলারও আয়োজন করা হচ্ছে।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারে পরিবেশের ওপর প্লাস্টিক পণ্যের বিরূপ প্রভাব নিয়ন্ত্রণে প্লাস্টিক পণ্যের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব পচনশীল দ্রব্যের ব্যবহার প্রচলনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার ‘কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০২১’ প্রণয়ন করে। সেই লক্ষ্যে সিঙ্গেল ইউজ বা ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে হাইকোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২১ জুন উপকূলীয় অঞ্চলের ১২ জেলার ৪০টি উপজেলাকে কোস্টাল এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেসব এলাকায় ‘সিঙ্গেল ইউজ’ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
আইন করে দুই যুগ আগে পলিথিনের তৈরি শপিং ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও বন্ধ হয়নি যত্রতত্র পলিব্যাগের ব্যবহার। বিভিন্ন সময়ে পলিব্যাগের ব্যবহার বন্ধে অভিযান চললেও কমেনি উৎপাদন ও সরবরাহ। নিষিদ্ধ ঘোষিত এসব ব্যাগের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধে পরিচালিত অভিযানে গত ৫ বছরে ৬ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হয়েছে। এই সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে ১৭০ জনকে, জব্দ করা হয়েছে ২ হাজার টনের বেশি মালামাল। এ ছাড়া ১৬টি নিয়মিত মামলা করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৫১৬টি পরিচালিত অভিযানে ৪ হাজার ২০৭টি মামলায় ৬ কোটি ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ২৫০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। ২০১০ সালের জুলাই থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রমের আওতায় নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন উৎপাদনকারী কারখানাগুলোকে উচ্ছেদ ও মালিকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হচ্ছে।
দেশে ২০০২ সালে পলিথিনের শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করে আইন করা হয়। সেখানে বলা হয়, ‘পলিথিনের শপিং ব্যাগ বা অন্য যেকোনো সামগ্রী, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, সেসব উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত, পরিবহন ইত্যাদি নিষিদ্ধ।’
গত ৬ ফেব্রুয়ারি চলতি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন চলাকালে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্নোত্তরে এসব তথ্য জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। পরিবেশমন্ত্রী আরও জানান, নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন শপিং ব্যাগ বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর নিজস্ব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে।
এদিকে তুলনামূলক কম দামের হওয়ায় প্লাস্টিকসামগ্রী দিনে দিনে জনপ্রিয়তা বাড়ছে। একসময়ে কল্পনা মনে হলেও এখন প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল তৈরি হচ্ছে। এসব পণ্য বহনও তুলনামূলক সহজ। শুধু তাই নয়, প্লাস্টিকের বিভিন্ন খেলার সামগ্রীও স্থান করে নিয়েছে বাচ্চাদের কাছে। গৃহসামগ্রী হিসেবেও স্থান করে নিয়েছে প্লাস্টিকের পণ্য। এভাবে প্রতিনিয়ত সব ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি মো. শামিম আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, গৃহসামগ্রী থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিল, শিশুদের খেলনার সামগ্রী এমন কোনো খাত নেই যে প্লাস্টিক ব্যবহার হয় না। স্থানীয় বাজারে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হচ্ছে। দিনে দিনে এটা সব ক্ষেত্রে জনপ্রিয় হচ্ছে। কাঁচামালের আমদানির সঙ্গে রিসাইক্লিং করেই এসব পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। এতে পরিবেশের ক্ষতি হয় না। যেগুলো ক্ষতিকর তা হচ্ছে পলিথিনের শপিং ব্যাগ। সরকার তা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পুরান ঢাকার ইসলামবাগে বিভিন্ন ঘরবাড়িতে এসব পণ্য উৎপাদন করে তা বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে। তারা আমাদের সদস্য না। তাই তাদের ধরা যায় না।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিপিজিএমইএ) জানায়, বর্তমানে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে প্লাস্টিক পণ্যের অবস্থান ১২তম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৬ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলারের প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২০ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়েছে। অর্থাৎ এক বছরে প্লাস্টিক রপ্তানি বেড়েছে ২৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের ১২৬টি দেশে বাংলাদেশে তৈরি প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বিপিজিএমইএর সভাপতি মো. শামিম আহমেদ বলেন, চাহিদা মিটিয়ে গত অর্থবছরে প্লাস্টিকের বিভিন্ন পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। বিভিন্ন দেশে এক দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়েছে। গৃহস্থালি পণ্য, ক্রোকারিজ, প্যাকেজিং উপকরণ, খেলনা, ফার্মাসিউটিক্যালস, আসবাব, মেলামাইন, তৈরি পোশাক উপকরণ, পিপি ওভেন ব্যাগ রয়েছে। দেশের প্লাস্টিক খাত এখনো প্রায় ২০ লাখ টন মূল্যের কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এটি এ খাত বিকাশের অন্যতম প্রধান বাধা। তাই এ খাতের বিকাশে সরকারের নীতি সহায়তা দরকার।