ঢাকা ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪

প্রতিদিন ১১ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পড়ে নদী ও সাগরে

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৫০ এএম
আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৮ পিএম
প্রতিদিন ১১ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পড়ে নদী ও সাগরে
দেশের ভেতরের বিভিন্ন নদনদী থেকেই শুধু ৯ হাজার ৭৬৭.৩২ টন  সিঙ্গেল ইউজ বা ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের বর্জ্য দৈনিক বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশে। ছবি: খবরের কাগজ

নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী দিন দিন ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণের কবলে পড়ে নালায় পরিণত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সমুদ্রোপকূলে প্লাস্টিক বর্জ্য অব্যবস্থাপনার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ১০ম স্থানে রয়েছে। এক তথ্য অনুসারে দেশের ভেতরের বিভিন্ন নদনদী থেকে শুধু ৯ হাজার ৭৬৭.৩২ টন  সিঙ্গেল ইউজ বা ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের বর্জ্য দৈনিক বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশে। এ ছাড়া দেশের বাইরে ভারত থেকে ১ হাজার ৪৯৩.৮০ টন ও মায়ানমার থেকে ২৪৮.৫৬ টন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বর্জ্যও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে দৈনিক বঙ্গোপসাগরের পানিতে গিয়ে মিশে। যার মোট পরিমাণ দাঁড়ায়  ১১ হাজার ৫০৯.৬৮ টন।

 প্লাস্টিকের দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০২ সালে দেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছিল। তবে, প্রায় দুই দশক পর পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন এসডোর (এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন) করা এক সাম্প্রতিক  গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দেশের পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যের ৮৭ শতাংশই সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে ফেলা হয় না। এসব বর্জ্য বিভিন্ন উপায়ে নদীতে মিশে শুধুমাত্র পানির নিচের জীববৈচিত্র্যকেই না, বরং মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। 

শুধু নদী দূষণ করেই ক্ষান্ত না, প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের দূষণের জন্যও দায়ী। এসডোর করা ‘দ্য ট্র্যাজিক টেল অব আওয়ার রিভার’ নামের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের বিভিন্ন নদনদী থেকে শুধু সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বর্জ্য দৈনিক কত পরিমাণ বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশে তার একটা হদিস পাওয়া যায়। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশের ভেতরে  মহানন্দা নদী থেকে ১০ টন, ডাহুক থেকে ১০.১৪ টন, করতোয়া থেকে ১১.২৩ টন, ধরলা থেকে ১০.৯১ টন, তিস্তা থেকে ১২.০২ টন, দুধ কুমার থেকে ৪১২.৯১ টন, ব্রক্ষ্মপুত্র থেকে ১১৫২.০৮ টন, সোমেশ্বরী থেকে ৪১৫.৩১ টন, কংস নদী থেকে ৩৮৭.০৩ টন, সুরমা থেকে ৪৪১.৩৪ টন, কালনি থেকে ৪৩০.৭০ টন, কুশিয়ারা থেকে ৪২৮৭.৮৪ টন, পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে ২৩৭৯.৯৬ টন, মাতামুহুরি থেকে ৪৯৯.৭২ টন, পশুর থেকে ৩৭৪.৮৫ টন, ইছামতি থেকে ৪৪৮.৫৯ টন ও নাফ থেকে ৯৭৫.৫৪ টন বঙ্গোপসাগরে মেশে। বিভিন্ন জাহাজ ও নৌযান থেকে দৈনিক বঙ্গোপসাগরে ফেলা হয় ১৩৬৬.০৪ টন বর্জ্য। এ ছাড়া দেশের বাইরে ভারত থেকে ১৪৯৩.৮০ টন ও মায়ানমার থেকে ২৪৮.৫৬ টন বর্জ্য দৈনিক বঙ্গোপসাগরের পানিতে গিয়ে মিশে।

কক্সবাজারের মতো এলাকায়, পর্যটক এবং দর্শনার্থীরা সমুদ্র সৈকতে ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের জিনিস ফেলে দেয়। এসব বর্জ্য শেষ পর্যন্ত সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। আবার যেসব প্লাস্টিকের পণ্য বা প্যাকেট রাস্তায় ফেলা হয় বা নদীর তিরে ড্যাম্প করে রাখা হয়, বৃষ্টিপাতের সময় এসব প্লাস্টিক বর্জ্য খাল, নালা ও নদীপথে জমা হয়। এসব বর্জ্য নালা এবং পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে আটকে রাখে। এক গবেষণায় দেখা যায়, প্লাস্টিক দূষণের কারণে ঢাকা শহরের ৬৫টি খালের মধ্যে ২২টি এখন ডাম্পিং জোনে পরিণত হয়েছে। প্লাস্টিক পণ্য বিভিন্ন উপায়ে পানিতে মিশে ধীরে ধীরে সেখান থেকে মাইক্রো প্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়। এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক ব্যাপকভাবে পানির নিচের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে। মাছসহ পানির নিচের অন্যান্য প্রাণী এসব মাইক্রোপ্লাস্টিককে খাবার ভেবে গ্রহণ করে। ফলে মারাত্মক এক হুমকির মুখে রয়েছে পানির নিচের জীববৈচিত্র্য। 

জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচি (ইউএনইপি) তাদের বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা নদী দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে মিশে যাচ্ছে। এ ছাড়া ভারত, নেপাল ও চীনের বর্জ্য গঙ্গা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রে ভাসছে। 

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, যা এই দেশের পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। আরও বলা হয়, আনুমানিক ২.৬ মিলিয়ন টন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতিবছর আমাদের বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে, যার মধ্যে বিরাট এক অংশ আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো দিয়ে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের আন্তসীমান্ত নদীগুলো প্রতিদিন প্রায় ১৫,৩৪৫ টন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বর্জ্য বহন করে, যার মধ্যে ভারত থেকে ২৫১৯ টন এবং মায়ানমার থেকে আসে ২৮৪ টন। 

২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘শকিং স্ট্যাটিস্টিকস অন প্লাস্টিক ইন বাংলাদেশ’ নামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে। শুধু ঢাকা শহরেই ১৪ মিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ প্রতিদিন ব্যবহার করা হয়। এসব বর্জ্যের অধিকাংশই দিন শেষে কোনো না কোনোভাবে নদীতে গিয়ে মিশে, তারপর একসময় এর ঠাঁই হয়ে সমুদ্রে। আরও বলা হয়, দেশে ৬১ শতাংশ মানুষ পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। 

২০২১ সালে প্রকাশিত বিডার (বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা শহরে লালবাগ, হাজারীবাগ ও সদরঘাটসহ বিভিন্ন এলাকাসহ সারা দেশে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনের প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি ফ্যাক্টরি রয়েছে। শুধুমাত্র পুরান ঢাকাতেই প্রতি মাসে স্ট্র, গ্লাস, প্লেট, চামচসহ ২৫০ টন ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের পণ্য কেনাবেচা হয়। বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্য ও প্রসাধনীর প্যাকেটে ব্যবহৃত সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক দেশে প্লাস্টিক দূষণের ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বিভিন্ন পণ্যের প্লাস্টিকের মিনিপ্যাক মানুষের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এসব মিনিপ্যাকের ব্যবহারও দেশে প্লাস্টিক দূষণের একটি বড় উৎস। ২০১৯ সালে প্রকাশিত এসডোর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণের মূল উৎস পলিথিনের ব্যাগ। তা ছাড়া মানুষ প্রতিবছর প্রায় ৮৭ হাজার টন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ফেলে দেয়। এই বর্জ্যের প্রায় ৯৬ শতাংশ আসে খাদ্য ও প্রসাধনী আইটেম থেকে, যার মধ্যে ৩৩ শতাংশ অপুনর্ব্যবহারযোগ্য মিনিপ্যাক।

২০২১ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২০০৫ সালে প্রতিবছর ৩ কেজি থেকে বেড়ে ২০২০ সালে প্রতিবছর ৯ কেজিতে উন্নীত হয়েছে। শুধু ঢাকাতেই প্লাস্টিকের গড় ব্যবহার ২০০৫ সালে বার্ষিক ৯.২ কেজি থেকে বেড়ে ২০২০ সালে ২২.২৫ কেজি হয়েছে।

এসডোর সিনিয়র প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট মালিহা হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক দূষণের মাধ্যম হলো পলিথিনের ব্যাগ। বাংলাদেশ সরকার আইন করে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিলেও, কঠোরভাবে এই আইন নিরীক্ষণ না করার কারণে মানুষ দেদার পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করছে। প্লাস্টিকের মধ্যে তের শরও বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে। পলিথিনের ব্যাগসহ প্লাস্টিকের পণ্যগুলো পচনশীল না হওয়ার কারণে এগুলো যখন নদীর মাধ্যমে সমুদ্রে গিয়ে মিশে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো মাইক্রো প্লাস্টিকে পরিণত হয়। এসব মাইক্রো প্লাস্টিক মেরিন জীববৈচিত্র্যকে তো ধ্বংস করেই, সঙ্গে মানবদেহেও অনেক বিরূপ প্রভাব ফেলে। এসব মাইক্রো প্লাস্টিক বিভিন্ন মাধ্যমে মাছের পেটে যায়, এসব মাছ আবার যখন মানুষ খাবার হিসেবে গ্রহণ করে, তখন তা মানবদেহে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। সম্প্রতি এক গবেষণায় মায়ের বুকের দুধ, এমনকি ভ্রুণের মধ্যেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। প্লাস্টিকের এসব দূষণ রোধে আমাদের এখনই সচেতন হওয়া উচিত।’

মানিকনগরে প্রকাশ্যে মাদকের হাট!

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:৪৮ পিএম
আপডেট: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:৪৮ পিএম
মানিকনগরে প্রকাশ্যে মাদকের হাট!
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

রাজধানীর মানিকনগর এলাকার বিভিন্ন গলিতে চলে মাদকের রমরমা কারবার। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় নেশার দ্রব্য। সেখানে বেশ কিছু জায়গা এখন মাদকের হটস্পট। 

হটস্পটগুলো হচ্ছে পুকুর পাড়, বালুর মাঠ ও মিয়াজান গলি। সম্প্রতি এসব হটস্পটে গিয়ে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য বেচাকেনার দৃশ্য চোখে পড়ে।

মাদক বিক্রির স্পটে কথা হয় মাদক বিক্রেতা কালা পাভেজের সঙ্গে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই কিছু লাগবে না কি। যদি লাগে লজ্জা শরম ফেলে কোনটা লাগবে শুধু জানান। গাঁজার এক পোঁটলার দাম ১০০ টাকা, আর ইয়াবার দাম বাড়ছে। আগে এক পিস ইয়াবা ২৫০ টাকায় বিক্রি হতো, এখন ৩৫০ টাকা করে দেওয়া লাগবে। তবে মাল ভালো।’

এ সময় দেখা যায়, পাভেজের সঙ্গে রয়েছে আরও ১০ থেকে ১৫ জন। তারা সবাই মাদক কারবারি নাসিরের অনুসারী। নাসির পুলিশের চোখে ওই এলাকার বড় মাদক সম্রাট। তিনি মাদক কারবার করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা হওয়ার পর থেকে তিনি মাদক সেবনকারীদের দিয়ে বিভিন্ন স্পটে মাদক বিক্রি করেন। তার সঙ্গে মিয়াজান গলির কিছু নারীও জড়িত।

মানিকনগর মিয়াজান গলির সামনে কিছু সময় দাঁড়ালে দেখা যায়, সোর্স বাবুল নামের এক ব্যক্তি বাদামের ঝুড়ির মধ্যে গাঁজা বিক্রি করছেন। এ সময় বেশ কয়েকজনকে তা কিনতে দেখা যায়। প্রকাশ্যে বাদামের ডালায় গাঁজা সাজিয়ে এভাবে প্রায় দিন সকাল-সন্ধ্যা মাদকদ্রব্য বিক্রির রমরমা কারবার চলে। দূর থেকে দেখে মনে হবে, এটা একটা সাধারণ হাটের মতোই। 

পুলিশ জানায়, মাদক কারবারিরা নিয়মিত একটি নির্দিষ্ট গলি বা এলাকায় গিয়ে মাদক বিক্রি করে। এসব অপরাধ দমনে পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে। তবে তাতে তেমন কোনো ফল আসছে না। কারণ মাদক কারবারিরা জামিনে বের হয়ে আবারও একই কাজ করে।

সূত্র জানায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে মাদক বিক্রি ও সেবনের অভিযোগে অসংখ্য লোককে গ্রেপ্তার করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের ২৪ তারিখ পর্যন্ত ৫ হাজার ৭৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত সোমবার সরেজমিনে মানিকনগর এলাকায় বেলা ৩টা ২৪ মিনিটের দিকে বালুর মাঠে কথা হয় মাদক বিক্রেতা নাসিরের ছোট ভাই পিয়াসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যবসা করি আপনাকে কে বলেছে। মাঝে মাঝে খাই এবং সামান্য বিক্রি করি।’

গাঁজার ক্রেতা দিলুর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘সামান্য গাঁজা সেবন করি, তেমন কোনো অপরাধ করি নাই। সব সময় গাঁজা পাওয়া যায় না, মাঝে মাঝে সপ্তাহে এক দিন এখানে গাঁজা বিক্রি হয়। এ জন্য যখন খবর পাই তখন প্রয়োজনমতো কিনে নিয়ে যাই।’

পুলিশে ধরে না? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ধরে আবার ছেড়ে দেয়। আমি তো কারবার করি না। ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাই।’
সূত্র জানায়, এই এলাকার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী হলো পিয়াস এবং তার শ্বশুর আরাফাত। এ ছাড়া বিভিন্ন স্পটে মাদক বিক্রি করেন বাবুল, জুয়েল, সোর্স বাবু ও ডিলার পিয়াস।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে মুগদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল হোসাইন (ওসি তদন্ত) খবরের কাগজকে বলেন, আপনি যাদের নাম বললেন তাদের নামে ৫ থেকে ১০টির বেশি মামলা রয়েছে। এরা এক একসময় এলাকা পরিবর্তন করে। এদের ধরতে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। তা ছাড়া মাদকের সঙ্গে কোনো আপস নেই।’

কারারক্ষীদের মাদক কারবার: লঘুদণ্ডে কমছে না অপরাধ

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:৩৩ পিএম
আপডেট: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:৫৩ পিএম
কারারক্ষীদের মাদক কারবার: লঘুদণ্ডে কমছে না অপরাধ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন একাধিক কারারক্ষী। মাদকসহ আটক হওয়ার পরও নানা অজুহাত ও মুচলেখায় পার পেয়ে যাচ্ছেন অনেকে। অসাধু একাধিক কর্মকর্তার গাফিলতি, যথাযথ দায়িত্বে অবহেলা এবং ধরা পড়ার পর লঘুদণ্ডের কারণে কারারক্ষীরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এ ছাড়া বিভাগীয় মামলার পর তদন্তের নির্দিষ্টসীমা না থাকা এবং তদন্ত চলাকালে উচ্চ মহল দিয়ে সুপারিশ ও অপরাধ প্রমাণ হলে আপিলের বিধান থাকায় কারাগারে মাদকের অপরাধ বাড়ছে। 

কারা সূত্র জানায়, কারারক্ষীরা মাদক কারবারে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরও যে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা নামমাত্র। জড়িতদের বরখাস্ত, বেতন ও পদোন্নতি না দেওয়া, চাকরিচ্যুত করা বা দূরবর্তী স্থানে বদলি না করে নিজ জেলায় বদলি করা হচ্ছে অনেককে। এ ছাড়া তাদের সংশোধনেরও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। 

জানা গেছে, ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করা হয়ে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এমন রিপোর্টই দেওয়া হয়। কারাগারের কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে থাকেন। 
নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে কর্মরত কারারক্ষী মো. সজীব মিয়া এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হতে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে বদলির আদেশপ্রাপ্ত কারারক্ষী মো. মোবারক হোসেনকে কয়েকজন মাদক কারবারিসহ সোনারগাঁ থেকে গত ১৯ মে রাত ১০টার দিকে আটক করে নারায়ণগঞ্জ ডিবি পুলিশ। 

এ বিষয়ে জেল সুপার ও পুলিশ সুপার আলোচনার পর নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের ডেপুটি জেলার সাইফুল ইসলামকে পাঠিয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয় হতে তাদেরকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়। কর্তৃপক্ষের বিনানুমতিতে কারা এলাকা ত্যাগ, শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা এবং মাদক কারবারিদের সঙ্গে আটক হওয়ায় কারা বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।

কারা সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ কারা কর্তৃপক্ষ তাদের সুবিধার্থে সজীব ও মোবারকের বদলি করার জন্য কারা উপ-মহাপরিদর্শক বরাবর চিঠি পাঠান। সজীবকে ঢাকা বিভাগীয় দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। পরে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে অভিযুক্ত কারারক্ষীকে সংশোধনের তেমন কোনো সুযোগ না দিয়ে সম্প্রতি তাকে তার নিজ জেলা নরসিংদীর পার্শ্ববর্তী জেলা কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে বদলি করা হয়।

নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের একাধিক কারারক্ষী জানান, সজীব অনেক বেশি বেপরোয়া ছিলেন। মাদক সেবন, কারাগারে মাদক প্রবেশ করানো, নারীদের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক, সুবিধামতো ডিউটি বদলসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িত।

কারা সূত্র জানায়, একই অভিযোগে ২০২১ সালের শেষ দিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের কাজ থেকে সজীবকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়। 

কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘কেউ অপরাধ করলে অবশ্যই তার শাস্তি হয়। আমরা প্রথমে বিভাগীয় মামলার ব্যবস্থা করি। এরপর অপরাধীকে সাময়িক বরখাস্ত বা বদলি করা হয়। এ ছাড়া তদন্তের পর অপরাধ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় ও অনেক ক্ষেত্রে চাকরিও চলে যায়। 

তিনি আরও বলেন, কারাগারে প্রবেশের সময় তাদের দেহ তল্লাশি করা হয়। এ ছাড়া তারা যে ব্যারাকে থাকেন সেখানেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কারাগারে মাদক প্রবেশ ঠেকাতে কারা কর্তৃপক্ষ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। 

এর আগে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে মাদকসহ গ্রেপ্তার হন কারারক্ষী সোহেল রানা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে একইভাবে গ্রেপ্তার হন প্রধান কারারক্ষী সাইফুল ইসলাম। এদের মতো অনেক কারারক্ষী মাদক কারবারে যুক্ত রয়েছেন। গত ৫ বছরে ২০২ জন কারারক্ষীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে চাকরিচ্যুত হয়েছেন ১২৫ জন ও অর্ধশত কারারক্ষীকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কারারক্ষীকে মাদক মামলায় পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ২ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া অন্য আরেকটি ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গাজীপুরের অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-৩-এর বিচারক মোসাম্মাৎ রেহেনা আক্তার এ রায় দেন। 

জানা গেছে, শুধু গত বছরই মাদকসংশ্লিষ্টতায় বিভাগীয় মামলায় ২৫ জন কারারক্ষীর শাস্তি হয়েছে। এ ছাড়া নজরদারিতে রয়েছেন ৩৫০ জন।

এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, কারারক্ষীদের মাদক কারবারে জড়িত থাকার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। ধরা পরার পর অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী তাদের প্রাথমিক অবস্থায় যে শাস্তি দেওয়া হয় তা লোক দেখানো। বিভাগীয় ব্যবস্থায় লঘু শাস্তির কারণে এটি তাদের ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। 

এ ছাড়া কতিপয় প্রভাবশলী কর্মকর্তারাও জড়িত থাকার কারণে তারা কারারক্ষীদের বিভিন্নভাবে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। তিনি বলেন, কারারক্ষীদের এই অপরাধ খুবই হালকা করে দেখা হয়। বড় অপরাধে লঘুশাস্তি হলে তাদেরও ইচ্চাশক্তি বেড়ে যায়। একজনের দেখাদেখি আরেকজন অপরাধে জড়ান। কর্তৃপক্ষের উচিত তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা। 

এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তিনি বলেন, কারাগারে সিসি ক্যামেরা থাকলেও মাদকের অপরাধ শতভাগ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। অসাধু কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় না আনলে কারাগার মাদক মুক্ত করা যাবে না।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের জেল সুপার মো. মোকাম্মেল হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, সজীব ও মোবারকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টে তারা অপরাধী প্রমাণিত হলে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। 

মাদক মামলা এক-তৃতীয়াংশেরও কম নিষ্পত্তি

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:২২ পিএম
আপডেট: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:৪৮ পিএম
মাদক মামলা এক-তৃতীয়াংশেরও কম নিষ্পত্তি

চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ঢাকা মহানগরে মোট মামলা হয়েছে ৬৮৬টি। নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২২০টি। অর্থাৎ এই সময়ে মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তি এক-তৃতীয়াংশেরও কম। সর্বশেষ গত ৩১ মে পর্যন্ত ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ও ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত মিলে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৬ হাজার ১৫টি। আদালতের মাদক প্রসিকিউশন শাখা সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

মামলা নিষ্পত্তির এই চিত্র তুলে ধরে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু গতকাল মঙ্গলবার খবরের কাগজকে বলেন, মামলা নিষ্পত্তির হার এত কম হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে সাক্ষী সংকট। অনেক সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আসছেন না। ঠিকানা অনুসারে অনেককে পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, এই সমস্য নিরসনে সবাইকে আরও আন্তরিক হতে হবে। আদালতে একজন সাক্ষী এলে অবশ্যই তার সাক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে, কোনোভাবেই একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য না নিয়ে ফেরত পাঠানো যাবে না। আদালতের নির্দেশ ঠিকমতো তামিল হচ্ছে কি না, যেমন আদালতের সমন ঠিক সময়ে পৌঁছাচ্ছে কি না, আদালতকে তা মনিটরিং করতে হবে। পুলিশ যদি ঠিকানা মতো সাক্ষীকে না পায়, তাহলে তা আদালতকে সময়মতো অবহিত করতে হবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দেশে প্রথম মামলা হয় ২০০২ সালে। দুই দশক পর ২০২২ সালে মামলাটি নিষ্পত্তি করে রায় দেন আদালত। রায়ে সফিকুল ইসলাম ওরফে জুয়েলকে যাবজ্জীবনসহ মোট ৫ জনকে আদালত বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। ঢাকার পরিবেশ আপিল আদালতের তৎকালীন বিচারক ওই রায় ঘোষণা করেন।

ওই আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলেন এ এফ এম রেজাউল করিম (হিরণ)। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা প্রশ্নে তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ধরুন একটি মামলার সাক্ষী হলেন ঘটনাস্থলের কাছে থাকা একজন হকার। কিন্তু তিনি তো ভাসমান। মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলার সময় তাকে হয়তো ওই জায়গায় পাওয়া যায় না। আবার পুলিশের সাক্ষ্যেও মামলা নিষ্পত্তি হতে পারে বলে উচ্চ আদালতে নির্দেশনা আছে। কিন্তু পুলিশের চাকরিতে বদলির ব্যাপার আছে। মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলার সময় হয়তো একজন পুলিশ সদস্য দূরে কোথাও বদলি হয়ে আছেন বা অবসরে আছেন। সেটিও একটি সংকট।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব সংকট কমাতে উচিত স্থানীয়দের সাক্ষী করা। কিন্তু স্থানীয়রা হয়তো ভবিষ্যতে মামলায় হাজিরা দিতে হবে ভেবে আগেই সাক্ষী হওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে চলেন। আবার বদলি স্থান থেকে একজন পুলিশ সদস্য সাক্ষ্য দিতে এলে তাকে নিজ খরচে আসতে হয়। কোনো কোনো পুলিশ সদস্য অবসর জীবনে বয়সজনিত কারণেও সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়টি এড়াতে চান। 

ড্যান্ডিতে ডুবছে পথশিশুরা

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:১২ পিএম
আপডেট: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:৪৯ পিএম
ড্যান্ডিতে ডুবছে পথশিশুরা
ছবি: সংগৃহীত

বিকেল হলেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দেখা মেলে গুলিস্তানের মুক্তমঞ্চ এলাকায়। গত সোমবার (২৪ জুন) এখানেই সন্ধ্যা নামার পর জায়গায় জায়গায় গোল হয়ে বসে থাকতে দেখা যায় বেশ কিছু ছিন্নমূল শিশুকে। এদের সবারই বয়স ৮ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। কাছে গেলে দেখা যায়, এদের মধ্যে একজনের হাতে একটি কুঁচকানো পলিথিন ধরা। পলিথিনের ভেতর এক ধরনের হলুদ রঙের আঠালো যৌগ। 

শিশুদের সবাই পালাক্রমে এই পলিথিন নাকের কাছে নিয়ে জোরে টান দিচ্ছে। প্রতিবার টান দেওয়ার পর কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকছে। হাতবদল করে পলিথিন ঘুরছে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘোরার মতো করে। সেই সঙ্গে এই শিশুদের ভেতরের অনুভূতিগুলোও ঘুরছে বিভিন্ন ডাইমেনশনে। পলিথিনের ভেতরের যৌগ সাময়িক সময়ের জন্য এই কোমলমতি শিশুদের মাথার ভেতরের রাসায়নিক যৌগকে ওলট-পালট করে দিচ্ছে। পলিথিনের ভেতরে এই রাসায়নিক যৌগের নাম ‘ড্যান্ডি’। 

২০২২ সালে প্রকাশিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ও ইউনিসেফের একটি গবেষণায় বলা হয়, দেশে ড্যান্ডিতে আসক্ত ১৫ দশমিক ২ শতাংশ শিশু। এর মধ্যে রাজধানীতেই ড্যান্ডিতে আসক্ত পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। যদিও ২০২৪ সালে এসে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি বেড়েছে। এ ছাড়া দেশে ৫৮ শতাংশ পথশিশু ড্যান্ডিসহ অন্যান্য মাদকে আসক্ত। ১৪ শতাংশ শিশু ১০ বছর বয়সের আগেই মাদক সেবন করে। তুলনামূলক সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় পথশিশুদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ গাঁজা সেবন করে। 

ড্যান্ডি মূলত এক ধরনের আঠা। ‘ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ’ বা ‘ড্যান্ড্রাইট’ নামের আঠাটিকেই মাদকসেবীরা ‘ড্যান্ডি’ বলে চেনে। এই আঠা পলিথিনে ভরে নেশা করে তারা। আঠায় থাকা কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, টলুইন, অ্যাসিটোন ও বেনজিন স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেই বাষ্পে পরিণত হয়। এই বাষ্প নিশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা লোপ পায়। তখন এই নেশা গ্রহণকারী এক ঘোরের মধ্যে সময় কাটায়। ড্যান্ডি সেবনে ক্ষুধামান্দ্য তৈরি হয়। সামাজিক বাস্তবতা ভুলে থাকা যায়, যেখানে-সেখানে ঘুমিয়ে পড়া যায়। আর খুব অল্প খরচে এই নেশা কিনতে পাওয়া যায় বলে পথশিশুরা ঝুঁকে পড়ছে এতে।

সোমবার রাত ১০টার পর রাজধানীর ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনে দেখা যায় পথশিশুদের এ রকম জটলা। এদের মধ্যে একজন ১৪ বছরের রনি। তাকে প্রায়ই ফার্মগেট লেগুনাস্ট্যান্ডে লেগুনার হেল্পারি করতে দেখা যায়। রাতে প্রতিদিন সে হাজিরা দেয় এই ড্যান্ডির আখড়ায়। সারা দিনের উপার্জন ড্যান্ডির পেছনে খরচ করে। রাতে পলিথিনে সুখটান দেয়। তার ফাঁকে জানায়, ড্যান্ডি খেলে ক্ষুধা লাগে না। তাই খায়। কিন্তু তার উপার্জনের টাকায় তো দুই বেলা খাবারের জোগান হয়ে যায়। এ কথা বললে জানায়, ‘আমার ট্যাহা, আমি ড্যান্ডি খামু, ভাত খামু না। কার কী!’ 

তবে ক্ষুধার তাড়নায় ড্যান্ডি সেবনের ব্যাখাকে কেবল নেশা করার অজুহাত বলে মন্তব্য করেছেন পথশিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ‘পথশিশু সেবা সংগঠন’-এর কো-অর্ডিনেটর কাউছার আহমেদ। তিনি জানান, ‘এই নেশার কারণ ক্ষুধা নয় বরং এর সহজলভ্যতা। জুতার আঠা বা গামের টিউবের দাম ৩৫ টাকা। একটা কৌটার দাম ১০০ টাকা। এই টাকা চাইলেই বিভিন্ন উপায়ে তারা এক দিনে সংগ্রহ করতে পারে। আবার মুচির দোকান বা হার্ডওয়্যারের দোকান থেকেও ১০ টাকা দিয়ে অল্প পরিমাণে এরা সংগ্রহ করে। ফলে ভাগে ভাগে জোগাড় করে নেশা করতে পারে। ড্যান্ডির নেশা থেকে পথশিশুদের বাঁচাতে হলে এর সহজলভ্যতাকে আগে বন্ধ করতে হবে।’ 

মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচে ড্যান্ডি সেবন করতে দেখা যায় আরেক শিশু জহিরকে। ময়লা শরীরে ভর্তি। জহির জানায়, বিভিন্ন জায়গায় বোতল, প্লাস্টিকের টুকরো, ভাঙারি সংগ্রহ ও বিক্রি করে। ক্ষুধা মেটাতে ড্যান্ডিতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। আঠাটি মুচির কাছ থেকে কেনে সে। এ ছাড়া বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও হার্ডওয়্যারের দোকানে বিক্রি হয় এটি। এই আঠা দিয়ে সাধারণত বিভিন্ন ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিকের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, চামড়াসহ বিভিন্ন পণ্য জোড়া দেওয়ার কাজ করা হয়।

কীভাবে এই নেশার ব্যাপারে জানলে প্রশ্ন করা হলে জহির বলে, ‘বন্ধুরা জানায়। ওরা আগে থাইকাই নেশা করত। এক দিন আমারেও সাধল। কইলাম, এডি খাইলে কী অয়? ওরা কইল, এডি নিলে সবকিছু ভালো লাগে। খিদা লাগে না। ঘুমও ভালো অয়। তহন আমারো ইচ্ছা করল টানতে। কয়েক দিন অগো লগে টাইনা এখন এডি ছাড়া পাগল পাগল লাগে।’ 

এ বিষয়ে পথশিশু সেবা সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক বৃষ্টি সরকার খবরের কাগজকে জানান, ড্যান্ডিসহ সব ধরনের নেশাই পথশিশুদের মধ্যে একজনের কাছ থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে অন্যজনের কাছে। পথশিশুরা সাধারণত গাঁজা, ড্যান্ডি ও পেট্রল শুঁকে নেশা করে। নেশার কারণে শিশুদের মানসিক বিকৃতি ঘটে। নেশার অর্থ জোগাড় করতে ছিনতাই, চুরি, পকেটমারি, মাদক কেনাবেচাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে পথশিশুরা। নেশা সেবনে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। 

২০২২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘পথশিশুদের জরিপ-২০২২’-এ গবেষণায় উঠে আসে নেশাগ্রস্ত ৫৫ শতাংশ শিশুরাই স্বাস্থ্যের দিক থেকে স্বাভাবিক নেই এবং ৬৪ শতাংশ শিশুর নিজেকে পরিচালনার সক্ষমতা নেই। পথশিশুরা শিক্ষা, পুষ্টিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

আবার বিভিন্ন এলাকায় পথশিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় আরও এক আশঙ্কাজনক তথ্য। পথশিশুরা জানায়, ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত পথশিশুরা তাদের নেশার টাকার জোগান দিতে দলবদ্ধভাবে আক্রমণ চালায় অন্যান্য পথশিশুদের ওপর। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ছিন্নমূল শিশু মুন্না জানায়, যেসব শিশু সারা দিন পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করে, তাদের টার্গেট করে দলগত আক্রমণ করে সব ছিনিয়ে নেয় নেশাখোর শিশুরা। মুন্না বলে, এরা নেশা করে সারা দিন, এখানে-সেখানে ঝিমায়। 

এর ফাঁকে সুযোগ খুঁজতে থাকে কার কাছ থেকে টাকা নেওয়া যায়। তারপর সুযোগ বুঝে মারধর করে টাকা নিয়ে যায়। নেশার টাকা পেতে তারা স্টেশনে আসা লোকদের কাছ থেকেও পকেট মারে, মোবাইল চুরি করে। এ ছাড়া এরা মাদকের চোরাচালান, বাজারজাত ও সামগ্রিক বিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। 

রোজ গার্ডেন থেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪, ১১:৪৬ এএম
আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪, ১১:৪৬ এএম
রোজ গার্ডেন থেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ

আজ ২৩ জুন, আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের এই দিনে পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জন্ম নেয় দলটি। দীর্ঘ ৭৫ বছর পার করে ৭৬-এ পা দিয়েছে উপমহাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। রোজ গার্ডেন থেকে বর্তমান ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ- এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে গিয়ে যেমন বহু প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে, তেমনি দলটির ঝুলিতে জমা হয়েছে অনেক অর্জন। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় গৌরবের অর্জন হচ্ছে, এই দেশের স্বাধীনতা। এই অর্জনে এককভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আওয়ামী লীগের (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ) প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে লিখেছেন- ‘কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত কাজী হুমায়ুন বশীর সাহেবের কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনের বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল।’ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু আরও লেখেন- ‘আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনো আসে নাই, তাই যাঁরা বাইরে আছেন তাঁরা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন।’

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’-এ লিখেছেন, ‘মুসলিম লীগ সরকারের ভয়ভীতি, ত্রাস ও নির্যাতনকে উপেক্ষা করে সম্মেলনকে (মুসলিম লীগের কর্মীদের সম্মেলন) সহযোগিতা দিতে অনেক ঢাকাবাসী সাহস পাননি। সম্মেলনের জন্য সরকারি কোনো মিলনায়তন জোগাড় করা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে কাজী হুমায়ুন বশীর তাঁর কে এম দাস লেনের বাসভবন রোজ গার্ডেনে সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেন। সম্মেলনের প্রস্তুতি চলার সময় ভাসানী (মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী) ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে থাকতেন। ১০ জুনের দিকে সংবাদ পাওয়া গেল, সরকার ভাসানীকে গ্রেপ্তারের পরিকল্পনা করছে। খন্দকার মোশতাক আহমদ তখন কাজী বশীরের সঙ্গে পরামর্শ করে শওকত আলীর সহায়তায় ভাসানীর গায়ে কম্বল পেঁচিয়ে তাকে সেই রাতেই ঘোড়ার গাড়িতে করে রোজ গার্ডেনে পৌঁছে দেন। সম্মেলন শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভাসানী কাজী বশীরের রোজ গার্ডেনেই ছিলেন।’

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের (পরে আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠার বর্ণনা দিতে গিয়ে মহিউদ্দিন আহমদ আরও লেখেন, ‘২৩ জুন (১৯৪৯) বেলা তিনটায় রোজ গার্ডেনের দোতলার হলঘরে সম্মেলন শুরু হয়। সেখানে ২৫০ থেকে ৩০০ কর্মী উপস্থিত হন।’ ১৫০ মোগলটুলি সম্পর্কে মহিউদ্দিন আহমদ তার বইয়ে লেখেন, ‘এখানে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের একটি শাখা অফিস ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই শাখা অফিসকে কেন্দ্র করেই বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি সংগঠিত হয়। ঢাকার নবাববাড়িকেন্দ্রিক প্রভাব খর্ব করার ক্ষেত্রে ১৫০ নম্বর মোগলটুলির তরুণদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।’

‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বইয়ে তিনি আরও লেখেন, ‘আতাউর রহমান খান মূল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। অনেক আলোচনার পর ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। আওয়ামী লীগ নামটি মওলানা ভাসানীর দেওয়া। ...২৩ তারিখের (২৩ জুন) অধিবেশনের শেষ দিকে মওলানা ভাসানী প্রস্তাব করেন, প্রতিটি জেলা ও প্রতিষ্ঠানের একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হোক। এত বড় কমিটি করার ব্যাপারে অনেকেরই আপত্তি ছিল। পরে মওলানা ভাসানীকেই কমিটি করার অনুরোধ জানানো হয়। ভাসানী পরামর্শের জন্য একটি ঘরে ঢোকেন এবং কিছুক্ষণ পর বাইরে এসে ৪০ জন নিয়ে একটি কমিটির প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবটির ব্যাপারে সবাই একমত হন। কমিটির কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (সভাপতি), আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহমেদ খান, আলী আমজাদ খান ও আবদুস সালাম খান (সহসভাপতি), শামসুল হক (সাধারণ সম্পাদক), শেখ মুজিবুর রহমান (যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক), খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে এম রফিকুল হোসেন (সহসম্পাদক) এবং ইয়ার মোহাম্মদ খান (কোষাধ্যক্ষ)।’

ড. শ্যামলী ঘোষ তার ‘আওয়ামী লীগ ১৯৪৯-১৯৭১’ বইয়ে লিখেছেন, ‘১৯৪৯ সালের গ্রীষ্মের গোড়ার দিকে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। দলের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের পক্ষপাতী সদস্যরা প্রাদেশিক পরিষদের টাঙ্গাইল আসনের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের দলীয় প্রার্থী খুররম খান পন্নীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ঢাকার বিশিষ্ট মুসলিম লীগের কর্মী শামসুল হককে মনোনয়ন দান করে। শামসুল হক উল্লেখযোগ্য ভোটের ব্যবধানে পন্নীকে পরাজিত করলে প্রদেশে পরিবর্তনের বিরোধিতাকারীদের নড়বড়ে অবস্থানের মুখোশটি উন্মোচিত হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির পরবর্তী ঘটনাগুলো এরই স্বাভাবিক পরিণতি বৈ আর কিছু নয়। ১৯৪৯ সালের জুন মাসে কতিপয় মুসলিম লীগ এমএলএ কর্মী যারা দলীয় প্রভুদের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে তারা ঢাকায় দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের আয়োজন করে।’

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয় ১৯৫৫ সালে। এ প্রসঙ্গে ড. শ্যামলী ঘোষ তার বইয়ে উল্লেখ করেন, “১৯৫৫ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করা হলে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য সদস্যপদ লাভের পথ উন্মুক্ত হয়। ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বপ্রথম বিষয়টি উত্থাপিত হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ভাসানী কর্তৃক জনমত যাচাই না হওয়া পর্যন্ত প্রশ্নটি অমীমাংসিত থাকে (ছিল)।” পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তি অর্থাৎ স্বাধীনতার পর দলটির নাম হয় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’।

এই দীর্ঘ সময় (৭৫ বছর) পাড়ি দিতে আওয়ামী লীগকে কখনো সহ্য করতে হয়েছে শাসকের রক্তচক্ষু, কখনো দলটির নেতা-কর্মীদের ওপর নেমে এসেছে অসহ্য নির্যাতন। এই দলের প্রাণপুরুষ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বেশির ভাগ সময় কাটাতে হয়েছে কারা প্রকোষ্ঠে। এমনকি একাধিকবার তার প্রাণ সংশয়ের উপক্রম হয়েছে। স্বাধীনতার পর জাতির পিতাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন, দমন-পীড়ন আর জেল-জুলুম নেমে আসে। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা প্রবাস থেকে দেশে ফেরার পর আওয়ামী লীগ পুনর্গঠন করেন। শেখ হাসিনার আপসহীন নেতৃত্বে ক্রমে সংগঠিত হতে থাকেন দলটির নেতা-কর্মীরা এবং পঁচাত্তর-পরবর্তী দুঃসময় কাটিয়ে ১৯৯৬ সালে জনগণের রায়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

কিন্তু তারও আগে এই সংগঠনের প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান তার কাজের মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা। তিনি (শেখ মুজিবুর রহমান) ১৯৫২ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু। প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক সংগ্রাম, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়সহ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে পঞ্চাশের দশকেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল তথা প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। তবে প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী রাজনৈতিক মতভিন্নতার জন্য ১৯৫৭ সালে দল ছেড়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। শুরুর দিকে দলটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল- বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি, এক ব্যক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৬ সালেই (ষষ্ঠ কাউন্সিলে) বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ। সপ্তম ও অষ্টম কাউন্সিলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অপরিবর্তিত থাকেন। এভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ এবং গোটা বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। তার নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে মুক্তিকামী মানুষ। এরপর আসে ভয়াল ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হন জাতির পিতা। এরপর শুরু হয় ভাগ্যক্রমে বেঁচে থাকা তার (বঙ্গবন্ধুর) দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার দীর্ঘ দুরূহ পথ।

কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর দেশ শাসনের পর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। পরবর্তী সময় দেশে রাজনৈতিক সংকটের (সেনাসমর্থিত সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ) পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনরায় সরকার গঠন করে। এরপর ২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে।

সম্মেলন করার জন্য একটি হল ভাড়া পেতে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতারা ১৯৪৯ সালে দ্বারে দ্বারে ঘুরে পেয়েছিলেন রোজ গার্ডেন। এই রোজ গার্ডেনে জন্ম নেওয়া দলটি (আওয়ামী লীগ) এখন উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন একটি রাজনৈতিক দল। দলটি (আওয়ামী লীগ) টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে। এখন সম্মেলন করার জন্য কোনো হল খুঁজে বেড়াতে হয় না। ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের সুরম্য ভবন। সেখানে রয়েছে অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। তবে বেশ কিছু সময় ৯১, নবাবপুর রোডেও ছিল আওয়ামী লীগের কার্যালয়। 

১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। তখন এখানেই (৯১, নবাবপুর রোড) বসতেন দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর অস্থায়ীভাবে সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলের গলিতে কিছুদিন বসে অফিস করেন নেতারা। পরে পুরানা পল্টনের দুই জায়গায় দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের অফিস ছিল। ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলের দায়িত্ব নিলে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নতুন ঠিকানা হয় ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ।