পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে ধরিত্রীর ক্ষতি হচ্ছে। ধরিত্রীকে সুরক্ষিত রাখতে পরিবেশ দূষণ রোধের বিকল্প নেই। সংবিধানেও পরিবেশ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের আলোকে একাধিক আইন করা হয়েছে। আইনের আওতায় কাজ করছে কয়েকটি পরিবেশ আদালত ও অধিদপ্তর। এর বাইরে দূষণ ঠেকাতে কাজ করছে কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন। তারা ব্যক্তিগতভাবে পরিবেশ দূষণ রোধে হাইকোর্টে রিট করে প্রতিকারের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
হাইকোর্টে ২০০২ সাল থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ধরনের রিটের সংখ্যা ২ হাজার ১৭৫টি। এর মধ্যে ৮০১টি নিষ্পত্তি হয়েছে। বিচারাধীন রয়েছে ১ হাজার ৩৭৪টি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হলে আইন সংশোধন করে শাস্তি বাড়াতে হবে। মাঠপর্যায়ের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সদিচ্ছা থাকতে হবে। এ ছাড়া সবার সচেতনতা অত্যন্ত প্রয়োজন।’
এ ব্যাপারে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় সরাসরি মামলা করতে আইন সংশোধন বা পরিবর্তন করা প্রয়োজন। শুধু মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করে কিংবা জরিমানার ভয় দেখিয়ে পরিবেশ রক্ষার মূল উদ্দেশ্য সফল হবে না। সাজা দিতে হবে। মামলার মাধ্যমে সাজা না হলে পরিবেশ দূষণ রোধ করা অসম্ভব। যেসব পরিবেশ আদালত আছে, সেখানে বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকে। কাজের কাজ কিছুই হয় না। এ জন্য আইন পরিবর্তন করতে হবে। পরিবেশ আদালতগুলোকে হাইকোর্টের অধীনে আনতে হবে। যেমনটা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে আছে। পরিবেশ রক্ষায় মাঠপর্যায়ে প্রশাসন ও দায়িত্বরতদেরও সদিচ্ছা প্রয়োজন। এ ছাড়া যেসব ব্যবসায়ী পরিবেশ দূষণ করছেন, তাদেরও বোধোদয় হতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে সচেতন হতে হবে। আইনগতভাবে কঠোর ব্যবস্থার পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে সরকারকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদের সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে।’ সংবিধানের সঙ্গে সংগতি রেখে পরিবেশ রক্ষায় একাধিক আইনও করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৫ সালের বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও ২০১০ সালের বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন অন্যতম। বিদ্যমান আইনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে পদক্ষেপ নিচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এর বাইরেও কাজ করছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশসহ (এইচআরপিবি) বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন।
২০২১ সালের ৮ এপ্রিল এক রায়ে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে আলকাতরা ও ন্যাপথলিন উৎপাদন কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। নজরুল অ্যান্ড ব্রাদার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কারাখানা চালিয়ে আসছিল। এটি ওই এলাকার পরিবেশ দূষণ করছে বিবেচনায় নিয়ে তা বন্ধ করে দেন হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের বেঞ্চ। এই রায়কে যুগান্তকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তেজগাঁওয়ে স্টিচওয়েল ডিজাইন লিমিটেডের (গার্মেন্টস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন এবং এলাকার বিভিন্ন গার্মেন্টস ও স্থানীয়রা আলকাতরার বাই প্রোডাক্টসের গন্ধে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ এনে পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করেন। অভিযোগের তদন্ত শেষে ২০১৮ সালে কারখানা বন্ধের চূড়ান্ত নোটিশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে নজরুল অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক হাইকোর্টে রিট করেন। শুনানি শেষে ২০২১ সালে ওই রিট খারিজ করেন হাইকোর্ট।
২০০১ সালে বেলার দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ দূষণকারী ‘ক’ শ্রেণি বা লাল (অতি বিপজ্জনক) ও ‘খ’ কমলা (বিপজ্জনক) তালিকাভুক্ত শিল্পকারখানার বিরুদ্ধে দুই বছরের মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। রায়ে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে কেউ যাতে নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়। রায়ের আট বছর পরও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় জনস্বার্থে রায় বাস্তবায়নে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে আবেদন করে এইচআরপিবি। এ আবেদনের শুনানি নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু আজও সেই রায় বাস্তবায়ন হয়নি।
এদিকে পরিবেশ দূষণকারী ইটভাটা বন্ধে হাইকোর্টে রায় বাস্তবায়নে গড়িমসি করায় গত ১৮ জানুয়ারি ক্ষোভ প্রকাশ করেন হাইকোর্টের বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ। ওই দিন অবৈধ ইটভাটা-সংক্রান্ত এক রিটের শুনানিতে হাইকোর্ট বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্পায়নের অবশ্যই প্রয়োজন আছে, তবে সেটা হতে হবে পরিবেশকে রক্ষা করে। দেশে অটিজম কী পরিমাণ বাড়ছে, সরকার কি তার হিসাব রাখে? এ ক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণের প্রভাব রয়েছে। দেশের নদী দূষিত, বাতাস দূষিত, সাবির্কভাবে পরিবেশ দূষিত। ঢাকার অবস্থা আরও খারাপ। সুতরাং পরিবেশ নিয়ে আমরা শঙ্কিত।’
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, এ ধরনের ৮০১টি রিটের ক্ষেত্রে রায় হয়েছে। এসব রায়ের অধিকাংশ আদেশ বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো বিচারাধীন আছে ১ হাজার ৩৭৪টি।