বিকেল হলেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দেখা মেলে গুলিস্তানের মুক্তমঞ্চ এলাকায়। গত সোমবার (২৪ জুন) এখানেই সন্ধ্যা নামার পর জায়গায় জায়গায় গোল হয়ে বসে থাকতে দেখা যায় বেশ কিছু ছিন্নমূল শিশুকে। এদের সবারই বয়স ৮ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। কাছে গেলে দেখা যায়, এদের মধ্যে একজনের হাতে একটি কুঁচকানো পলিথিন ধরা। পলিথিনের ভেতর এক ধরনের হলুদ রঙের আঠালো যৌগ।
শিশুদের সবাই পালাক্রমে এই পলিথিন নাকের কাছে নিয়ে জোরে টান দিচ্ছে। প্রতিবার টান দেওয়ার পর কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকছে। হাতবদল করে পলিথিন ঘুরছে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘোরার মতো করে। সেই সঙ্গে এই শিশুদের ভেতরের অনুভূতিগুলোও ঘুরছে বিভিন্ন ডাইমেনশনে। পলিথিনের ভেতরের যৌগ সাময়িক সময়ের জন্য এই কোমলমতি শিশুদের মাথার ভেতরের রাসায়নিক যৌগকে ওলট-পালট করে দিচ্ছে। পলিথিনের ভেতরে এই রাসায়নিক যৌগের নাম ‘ড্যান্ডি’।
২০২২ সালে প্রকাশিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ও ইউনিসেফের একটি গবেষণায় বলা হয়, দেশে ড্যান্ডিতে আসক্ত ১৫ দশমিক ২ শতাংশ শিশু। এর মধ্যে রাজধানীতেই ড্যান্ডিতে আসক্ত পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। যদিও ২০২৪ সালে এসে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি বেড়েছে। এ ছাড়া দেশে ৫৮ শতাংশ পথশিশু ড্যান্ডিসহ অন্যান্য মাদকে আসক্ত। ১৪ শতাংশ শিশু ১০ বছর বয়সের আগেই মাদক সেবন করে। তুলনামূলক সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় পথশিশুদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ গাঁজা সেবন করে।
ড্যান্ডি মূলত এক ধরনের আঠা। ‘ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ’ বা ‘ড্যান্ড্রাইট’ নামের আঠাটিকেই মাদকসেবীরা ‘ড্যান্ডি’ বলে চেনে। এই আঠা পলিথিনে ভরে নেশা করে তারা। আঠায় থাকা কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, টলুইন, অ্যাসিটোন ও বেনজিন স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেই বাষ্পে পরিণত হয়। এই বাষ্প নিশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা লোপ পায়। তখন এই নেশা গ্রহণকারী এক ঘোরের মধ্যে সময় কাটায়। ড্যান্ডি সেবনে ক্ষুধামান্দ্য তৈরি হয়। সামাজিক বাস্তবতা ভুলে থাকা যায়, যেখানে-সেখানে ঘুমিয়ে পড়া যায়। আর খুব অল্প খরচে এই নেশা কিনতে পাওয়া যায় বলে পথশিশুরা ঝুঁকে পড়ছে এতে।
সোমবার রাত ১০টার পর রাজধানীর ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনে দেখা যায় পথশিশুদের এ রকম জটলা। এদের মধ্যে একজন ১৪ বছরের রনি। তাকে প্রায়ই ফার্মগেট লেগুনাস্ট্যান্ডে লেগুনার হেল্পারি করতে দেখা যায়। রাতে প্রতিদিন সে হাজিরা দেয় এই ড্যান্ডির আখড়ায়। সারা দিনের উপার্জন ড্যান্ডির পেছনে খরচ করে। রাতে পলিথিনে সুখটান দেয়। তার ফাঁকে জানায়, ড্যান্ডি খেলে ক্ষুধা লাগে না। তাই খায়। কিন্তু তার উপার্জনের টাকায় তো দুই বেলা খাবারের জোগান হয়ে যায়। এ কথা বললে জানায়, ‘আমার ট্যাহা, আমি ড্যান্ডি খামু, ভাত খামু না। কার কী!’
তবে ক্ষুধার তাড়নায় ড্যান্ডি সেবনের ব্যাখাকে কেবল নেশা করার অজুহাত বলে মন্তব্য করেছেন পথশিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ‘পথশিশু সেবা সংগঠন’-এর কো-অর্ডিনেটর কাউছার আহমেদ। তিনি জানান, ‘এই নেশার কারণ ক্ষুধা নয় বরং এর সহজলভ্যতা। জুতার আঠা বা গামের টিউবের দাম ৩৫ টাকা। একটা কৌটার দাম ১০০ টাকা। এই টাকা চাইলেই বিভিন্ন উপায়ে তারা এক দিনে সংগ্রহ করতে পারে। আবার মুচির দোকান বা হার্ডওয়্যারের দোকান থেকেও ১০ টাকা দিয়ে অল্প পরিমাণে এরা সংগ্রহ করে। ফলে ভাগে ভাগে জোগাড় করে নেশা করতে পারে। ড্যান্ডির নেশা থেকে পথশিশুদের বাঁচাতে হলে এর সহজলভ্যতাকে আগে বন্ধ করতে হবে।’
মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচে ড্যান্ডি সেবন করতে দেখা যায় আরেক শিশু জহিরকে। ময়লা শরীরে ভর্তি। জহির জানায়, বিভিন্ন জায়গায় বোতল, প্লাস্টিকের টুকরো, ভাঙারি সংগ্রহ ও বিক্রি করে। ক্ষুধা মেটাতে ড্যান্ডিতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। আঠাটি মুচির কাছ থেকে কেনে সে। এ ছাড়া বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও হার্ডওয়্যারের দোকানে বিক্রি হয় এটি। এই আঠা দিয়ে সাধারণত বিভিন্ন ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিকের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, চামড়াসহ বিভিন্ন পণ্য জোড়া দেওয়ার কাজ করা হয়।
কীভাবে এই নেশার ব্যাপারে জানলে প্রশ্ন করা হলে জহির বলে, ‘বন্ধুরা জানায়। ওরা আগে থাইকাই নেশা করত। এক দিন আমারেও সাধল। কইলাম, এডি খাইলে কী অয়? ওরা কইল, এডি নিলে সবকিছু ভালো লাগে। খিদা লাগে না। ঘুমও ভালো অয়। তহন আমারো ইচ্ছা করল টানতে। কয়েক দিন অগো লগে টাইনা এখন এডি ছাড়া পাগল পাগল লাগে।’
এ বিষয়ে পথশিশু সেবা সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক বৃষ্টি সরকার খবরের কাগজকে জানান, ড্যান্ডিসহ সব ধরনের নেশাই পথশিশুদের মধ্যে একজনের কাছ থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে অন্যজনের কাছে। পথশিশুরা সাধারণত গাঁজা, ড্যান্ডি ও পেট্রল শুঁকে নেশা করে। নেশার কারণে শিশুদের মানসিক বিকৃতি ঘটে। নেশার অর্থ জোগাড় করতে ছিনতাই, চুরি, পকেটমারি, মাদক কেনাবেচাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে পথশিশুরা। নেশা সেবনে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
২০২২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘পথশিশুদের জরিপ-২০২২’-এ গবেষণায় উঠে আসে নেশাগ্রস্ত ৫৫ শতাংশ শিশুরাই স্বাস্থ্যের দিক থেকে স্বাভাবিক নেই এবং ৬৪ শতাংশ শিশুর নিজেকে পরিচালনার সক্ষমতা নেই। পথশিশুরা শিক্ষা, পুষ্টিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
আবার বিভিন্ন এলাকায় পথশিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় আরও এক আশঙ্কাজনক তথ্য। পথশিশুরা জানায়, ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত পথশিশুরা তাদের নেশার টাকার জোগান দিতে দলবদ্ধভাবে আক্রমণ চালায় অন্যান্য পথশিশুদের ওপর। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ছিন্নমূল শিশু মুন্না জানায়, যেসব শিশু সারা দিন পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করে, তাদের টার্গেট করে দলগত আক্রমণ করে সব ছিনিয়ে নেয় নেশাখোর শিশুরা। মুন্না বলে, এরা নেশা করে সারা দিন, এখানে-সেখানে ঝিমায়।
এর ফাঁকে সুযোগ খুঁজতে থাকে কার কাছ থেকে টাকা নেওয়া যায়। তারপর সুযোগ বুঝে মারধর করে টাকা নিয়ে যায়। নেশার টাকা পেতে তারা স্টেশনে আসা লোকদের কাছ থেকেও পকেট মারে, মোবাইল চুরি করে। এ ছাড়া এরা মাদকের চোরাচালান, বাজারজাত ও সামগ্রিক বিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।