দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে অত্যাবশ্যকীয় প্রাণিসম্পদ, পোলট্রি ও মাছের খাদ্য বা ফিড উৎপাদকদের দুর্দিন চলছে। একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারের দফায় দফায় পতনকে এ শিল্পসংশ্লিষ্টরা ‘ডাবল ব্লো’ বা ‘দ্বৈত আঘাত’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এ ছাড়া কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খুলতে ডলার সরবরাহে সংকট তো আছেই। ওই ঋণপত্রের বিপরীতে পণ্য আসার পর বিল পরিশোধে ঋণপত্র খোলার দিনের বিনিময় হারের পরিবর্তে বিল নিষ্পত্তির দিনের এক্সচেঞ্জ রেট আদায় করার কারণেও ব্যয় বেশি হচ্ছে ফিড উৎপাদকদের।
দেশের প্রথম সারির ফিড উৎপাদক প্রতিষ্ঠান এসিআই-গোদরেজ অ্যাগ্রোভেট প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অজয় ওয়াতিলা খবরের কাগজকে বলেছেন, এমন পরিস্থিতি এ শিল্পের জন্য ‘ডাবল ব্লো’। ভারত ও বাংলাদেশে আমার ২০ বছরের পেশাগত জীবনে এমন সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি।
পদ্মা ফিড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনোয়ারুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত এক মাসেই আমাদের এ শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।’
তিনি জানান, কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খুলতে গেলে ডলার পাওয়া যায় না। আবার বিল নিষ্পত্তিতে বেশি দাম পরিশোধ করতে হচ্ছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ফরওয়ার্ড পারচেজ’ বা ‘অগ্রিম ক্রয়’-এর ডলার কিনে রাখার বিধান জারি করলেও ব্যাংকগুলো সে সুবিধা দিতে চায় না। তিনি বলেন, এ সুবিধা পেলে অন্তত অস্থির বিনিময় হার থেকে নিস্তার পাওয়া যেত।
কাজী ফার্মস এর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ক্রয়) মাহবুব আনাম খান এক ই-মেইলের জবাবে খবরের কাগজকে জানান, গত মে মাসের তুলনায় নভেম্বরে ডলারের বিনিময় হারের কারণে কাঁচামাল আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। একই সময়ে প্রধান কাঁচামাল ভুট্টার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ ও সয়ামিলের দাম বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ অ্যাগ্রো ফিড ইনগ্রিডিয়েন্টস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম আমিরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও খুচরা বিক্রিতে ফিডের দাম বাড়াতে পারছেন না উৎপাদকরা।
তিনি বলেন, এমনিতেই ছোট-বড় সব খামারি ফিডের ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এরপর ফিডের দাম বাড়ানো হলে অনেক ছোট খামারি হারিয়ে যাবেন।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, ফিড তৈরিতে বিকল্প কাঁচামাল যেমন রাইস ডিডিজিএস, ব্রোকেন রাইস, সরগম, বার্লি, কটন সিড মিল, সানফ্লাওয়ার সিড মিল, পিনাট ও মিলেট নামক ৯টি পণ্য আমদানিতে শুল্কমুক্ত পণ্যের ক্যাটাগরিতে বিবেচনা করা হলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির চাপ এই মুহূর্তে কমবে।
তারা জানান, এ জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক একটি সাপ্লিমেন্টারি এসআরও জারির দরকার হবে। এতে করে সিড তৈরিতে উৎপাদন ব্যয় কমবে কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা।
এদিকে ফিডের দাম বাড়াতে এ খাতের সাত সংগঠন একীভূত হয়ে এগোচ্ছে। তারা এ ব্যাপারে সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগ, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন করবে বলে জানিয়েছেন পদ্মা ফিডের এমডি আনোয়ারুল হক।
তিনি জানান, দেশে মোট ফিড মিলের সংখ্যা চার শতাধিক। এর মধ্যে নিবন্ধিত ২৯০টি। এসব ফিড মিলে বছরে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ মেট্রিক টন পোলট্রি, ডেইরি ও মাছের ফিড উৎপাদন হয়।
ফিড উৎপাদনে দরকারি কাঁচামালের প্রায় ৯০ শতাংশ বাইরের দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। মূল দুটি কাঁচামাল হলো ভুট্টা ও সয়ামিল (সয়াবিন মিল বা খৈল)। আন্তর্জাতিক বাজারে এ দুটি উপাদানেরই মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এ ছাড়া আমদানি করা কাঁচামাল পরিবহনে জাহাজ ভাড়াও বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এসব কাঁচামালের মূল উৎস।
দেশের প্রায় ৬০ লাখ মানুষ এ শিল্পের সঙ্গে সরাসরি ও আংশিকভাবে জড়িত। দেশের প্রায় ১৭ কোটি জনগণের প্রতিদিনের পুষ্টির চাহিদা পূরণে এ শিল্প ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী দেশে গরু, মহিষ, ভেড়া ও ছাগল মিলিয়ে মোট গৃহপালিত পশুর সংখ্যা (অ্যানিমেল পপুলেশন) ৫ কোটি ৭১ লাখ ৪৩ হাজার। হাঁস-মুরগির সংখ্যা ৩৮ কোটি ৫৭ লাখ।
এ শিল্প থেকে বছরে দুধ আসে ১ কোটি ৪০ লাখ মেট্রিক টন, মাংস ৮৭ লাখ মেট্রিক টন ও ডিম ২ হাজার ৩৩৭ কোটি পিস।
দেশে বছরে মোট মাংসের চাহিদা ৭৬ লাখ মেট্রিক টন (দিনে ১২০ গ্রাম জনপ্রতি হিসাবে)। দুধের বার্ষিক চাহিদা দৈনিক মাথাপিছু ২৫০ মিলিলিটার ধরে মোট ১ কোটি ৫৮ লাখ মেট্রিক টন। আর ডিমের চাহিদা বছরে মোট ১ হাজার ৮০৬ কোটি পিস।
দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে এ শিল্পের অবদান ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ।