ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় চার বছর পার হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়েও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পায়নি রাজধানীবাসী। অথচ ঢাকা ওয়াসার ‘ব্যর্থতার’ কারণেই খালগুলো ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
গতকাল বুধবারও (২৬ জুন) দেড় ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকার অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী ২৮ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত টানা পাঁচ দিন অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি রাজধানীতেও বৃষ্টিপাত বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে নতুন করে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
দায়িত্ব হস্তান্তরের আগে ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর ২৬টি খাল (প্রায় ৮০ কিলোমিটার) এবং প্রায় ৩৮৫ কিলোমিটার বড় আকারের নালা ও চারটি পাম্পস্টেশন রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করত। অন্যদিকে, দুই সিটি করপোরেশন দেখভাল করত প্রায় ২ হাজার ২১১ কিলোমিটার নালা। দায়িত্ব হস্তান্তরের পর জলাবদ্ধতা নিরসনের পুরো দায়িত্ব এখন দুই সিটি করপোরেশনের।
গত ২০২০ সালে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেয় ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি)। তারপর নানাভাবে দখল হওয়া খাল উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে সংস্থা দুটি। জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া হয়েছে বিশেষ কর্মসূচি। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের আগে এসব খাল-ড্রেন পরিষ্কার করে দুই সিটি করপোরেশন। এ জন্য প্রতিবছর সংস্থা দুটির ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৩০০ কোটি টাকা। তারপরও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি বলেই নগরবাসীর অভিযোগ।
গতকাল বুধবারের বৃষ্টিতেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়ে নগরবাসী। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি শুরু হয়ে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ সময় মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর, ফার্মগেট, বাড্ডা, মগবাজার, মিরপুর ও খিলক্ষেত এলাকায় হাঁটুপানি পর্যন্ত পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেখা গেছে অনেককে।
সকালে পরিবহন না থাকায় গন্তব্যে পৌঁছাতে হিমশিম খেতে হয় অফিসগামীদের। ব্যক্তিগত গাড়ি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বিকল হতে দেখা গেছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, প্রতিবছর গড়ে ৩০০ কোটি টাকা খরচের হিসাব পাওয়া গেলেও এই টাকার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার হচ্ছে না। এই টাকা দিয়ে বর্ষা মওসুমের আগে খাল-ড্রেন পরিষ্কার করা হয়। অথচ দরকার পূর্ণাঙ্গ ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। বৃষ্টির কিছু পানি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতেই জলাশয়ে চলে যাবে। বাকিটা মাটির নিচে স্থাপন করা ড্রেন দিয়ে খালে চলে যাবে। সেই খাল দিয়ে পানি নদীতে চলে যাবে। কিন্তু এ রকম কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি।
এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের ড. আদিল মুহাম্মদ খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের জন্য পরিকল্পনা দরকার। পূর্ণাঙ্গ ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। সেটা না করে যেটুকু প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ছিল তাও ধ্বংস করা হয়েছে।’
এক সময় ঢাকা শহরজুড়ে অসংখ্য ছোট-বড় খাল জালের মতো বিস্তৃত ছিল। স্বাধীনতার পর পর রাজধানীতে ৫৭টি খালের অস্তিত্ব ছিল। সেটা কমে একসময় ৪৬টি হয়। দুর্বৃত্তরা খাল দখল করার পাশাপাশি বিভিন্ন সময় সরকারের খাল ভরাট করে বক্স কালভার্ট করেছে। বর্তমানে মাত্র ২৬টি খালের অস্তিত্ব রয়েছে।
সম্প্রতি জলাবদ্ধতা মুক্তি পেতে ডিএনসিসির হটলাইন নম্বরে (১৬১০৬) যোগাযোগ করতে মেয়র আতিকুল ইসলাম নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশ আগামী একবছর খাল উদ্ধারে মনোযোগ দেবেন বলে জানান তিনি।
ডিএনসিসি সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে মেয়র বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে সবাই যখন শুধু নিজের চিন্তা করে। আমরা কেউ অন্যের চিন্তা করি না। খাল যখন দূষিত হয়ে যাচ্ছে, তখন কীভাবে বাথটাব, টিভি, ফ্রিজ বা জাজিম খালে ফেলে দেয়? এ কারণে জলাবদ্ধতা তো হবেই। তবে অনেক জায়গায় আগে যেখানে জলাবদ্ধতা হতো, সেগুলো দূর করা হয়েছে।’
অন্যদিকে, ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ২০২০ সালে দায়িত্ব নেওয়ার আগে খাল ও ড্রেন আমাদের দায়িত্বে ছিল না। এরপর আমরা ১৩৬টি স্থান নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন করেছি। ফলে জলাবদ্ধতা ১০ ভাগে নেমে এসেছে।’
টানা পাঁচ দিন ভারী বৃষ্টির আভাস
মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর পুরোপুরি সক্রিয় থাকায় টানা পাঁচ দিন মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। গতকাল বিকেলে আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা খবরের কাগজকে বলেন, ২৮ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত বৃষ্টিপাত বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগ ছাড়া সব বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় নামতে পারে বৃষ্টি। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারা দেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে। চলমান তাপপ্রবাহ প্রশমিত হতে পারে।