![২ বছরের কাজ ৮ বছরে করেছেন ১০ প্রকল্প পরিচালক](uploads/2024/06/28/jhinaidoho-1719561610.jpg)
একজন নয়, দুজন নয়, পাঁচজন নয়, ১০ জন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কেউ পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেননি। এর ফলে দুই বছরের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে সময় লেগেছে আট বছর। শুধু তা-ই নয়, প্রকল্পের নিজস্ব কোনো লোকবল না থাকায় মনিটরিংও হয়নি। খরচ ১৮১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮৭ কোটি টাকায়। কাজের গুণগত মান নিশ্চিতে ও যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য ২৪টি ‘প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি’র (পিএসসি) সভা করার কথা। কিন্তু আট বছরে একটিও আলোর মুখ দেখেনি। একইভাবে ২৪টির মধ্যে মাত্র একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভা হয়েছে।
এটি যেনতেন প্রকল্প নয়, দেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগরের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের জন্য ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর-মুজিবনগর সড়ক উন্নীতকরণ প্রকল্পের বাস্তব চিত্র। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রভাব মূল্যায়ন খসড়া প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘসূত্রতায় উন্নয়নকাজে অর্থের অপচয় হচ্ছে। অর্থনীতিতেও পুরো সুফল পাওয়া যায় না। জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, ‘উন্নয়নের এই চিত্র গোটা বাংলাদেশের। প্রায় প্রকল্পে বিভিন্ন অজুহাতে সময় বাড়ছে। অর্থের অপচয় হচ্ছে। প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। আইএমইডি কিছু মাপকাঠি ঠিক করেছে। ঘন ঘন পিডি পরিবর্তন করা যাবে না। ঠিকাদার যেন মানসম্পন্ন কাজ করে, তার নজরদারি বাড়াতে হবে, ক্ষেত্রবিশেষে জমির ক্ষতিপূরণের অর্থ বাড়াতে হবে। অনেক প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে না। ঐতিহাসিক মুজিবনগর সড়কের একই চিত্র। পিডিরা নিজেদের দায়িত্ব অবহেলা করেছেন। ফলে ঠিকমতো হয়নি কাজ। বিনিয়োগেও বিলম্ব হয়েছে। ফলে অর্থনীতিতে সুফল পাওয়া যায় না।’
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’ তারা তো এখন দায়িত্বে নেই। এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘তখন তো আমিও কোনো দায়িত্বে ছিলাম না। এখন তো সেই প্রকল্প শেষ হয়ে গেছে।’ ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘তখন যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা বলতে পারবেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘কাগজ আমার হাতে নেই। এটা অনেক আগের প্রকল্প। কে কে দায়িত্বে ছিলেন তা দেখতে হবে। না দেখে কিছু বলা যাবে না।’
এ ব্যাপারে মেহেরপুর চেম্বার অব কমার্সের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল আনাম বকুল বলেন, ‘বর্তমানে আমরা দ্রুত ঢাকা ও খুলনা যেতে পারি। এলাকায় অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’
বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগরের সঙ্গে দেশের অন্য অঞ্চলসহ ঢাকার সংযোগ স্থাপন করার উদ্যোগ নেয় সরকার। কারণ সড়কটি চওড়া ছিল ৫ দশমিক ৫ মিটার। তা ৭ দশমিক ৩০ মিটার চওড়া করে ৭৬ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি নির্মাণে ২০১১ সালের ১১ মার্চ একনেকে পাস হয়। তখন ব্যয় ধরা হয় ১৮১ কোটি টাকা। পিডি নিয়োগ দেওয়া হলেও কাজে গতি বাড়েনি। খরচ বেড়ে ২৮৭ কোটি টাকায় ঠেকেছে, বেড়েছে ১০৬ কোটি টাকা বা ৫৯ শতাংশ। ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর সংশোধন করে এই খরচ বাড়ানো হয়েছে। দীর্ঘ সময়ে প্রকল্পটির বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৯৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ ও আর্থিক অগ্রগতি ৯৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।
প্রকল্পের প্রধান প্রধান কাজ ধরা হয়- সড়ক বাঁধ প্রশস্তকরণ ৩ লাখ ঘনমিটার, পেভমেন্ট প্রশস্তকরণ ৭৬ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার, হার্ড শোল্ডার ৭৬ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার, আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণ ১১ দশমিক ৮০ কিলোমিটার, আরসিসি রোড ডিভাইডার নির্মাণ ধরা হয় ৭৬০ মিটার। একই সঙ্গে সাইন, সিগনাল, রোড মার্কিং স্থাপনের কাজও ধরা হয়। ১৭টি প্যাকেজে এসব কাজ শেষ হয়েছে। প্রতিটি প্যাকেজের মেয়াদ এক বছর ধরা হলেও নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করা হয়নি। কোনো প্যাকেজে কাজে তিন বছরও লেগেছে। প্রায় প্যাকেজের মেয়াদ পিপিআর ২০০৮ অনুযায়ী হলেও ঝিনাইদহ অংশের দু-একটি প্যাকেজের মেয়াদ বৃদ্ধি যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়নি। যা অডিট আপত্তিতে উঠে আসে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে হয়েছে নানা অনিয়ম। পরিবহনের শৃঙ্খলা রাখতে সাইন, সিগনাল, রোড মার্কিং খাতে ১ কোটি ৬১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও খরচ করা হয়েছে ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। খরচ কম করা হয়েছে প্রায় ৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘ সময়ে ১০ জন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এম মো. শরিফ উল ইসলাম মাত্র ২২ দিন দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর মো. আব্দুল কুদ্দুস ২৮ দিন দায়িত্ব পালন করেছেন। এভাবে অন্য পিডিরা আসতে না আসতে চলে গেছেন দায়িত্ব ছেড়ে। ফলে মনিটরিং ও সুপারভিশন মোটেই হয়নি। বারবার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের ফলে প্রকল্পের কাজে মনোনিবেশ করতে পারেননি কেউ। এর ফলে ১৬৭ শতাংশ মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্পের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দিক হলো, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই মহাসড়কটি আগের মতো জরাজীর্ণ হয়ে যাবে। ঝিনাইদহ থেকে মেহেরপুর সড়কের পেভমেন্টের ভেতরে বড় বড় গাছ থেকে গেছে। এতে যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটে। মহাসড়কে ইজিবাইক, ভ্যানগাড়িসহ ছোট ছোট যানবাহন চলাচল নিষেধ থাকলেও এসব দেদার চলছে।