![কানেকটিভিটিতে প্রাধান্য](uploads/2024/06/28/BAN_IND-1719563537.jpg)
বাংলাদেশের ভেতর ভারতের ট্রেন যাবে। আবার ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল যাবে বাংলাদেশের ট্রেন। সম্প্রতি এমন সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে ঢাকা-দিল্লির মধ্যে। ২০১০ সাল থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বহুমুখী সংযোগ শুরু হয়। ঢাকা বলছে, ১৯৬৫ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া সংযোগ পুনরায় চালু করা হচ্ছে। এ অবস্থায় কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের বড় একটি অংশ জুড়ে আছে কানেকটিভিটি বা সংযোগ।
দুই দেশই সংযোগকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এতে উভয় দেশই লাভবান হবে বলে কর্মকর্তারা বলছেন। উভয় দেশই বিপুল পরিমাণে ট্রানজিট শুল্ক পাবে। এ ছাড়া বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে সংযোগকে একটি বাস্তবতা বলে মনে করা হয়।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভারতের নির্বাচনি জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত সংযোগ যত বাড়বে, ততই উন্নতি হবে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ শুরু হয়ে গেছে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ঢাকা অবধি মিতালী এক্সপ্রেস চলছে। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মিলে আমরা রাধিকাপুর স্টেশনের সঙ্গে কানেকটিভিটি বাড়াচ্ছি।’
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। ভারত-বাংলাদেশ সংযোগ নিয়ে সম্প্রতি ভারতীয় নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় নিবন্ধ লেখেন তিনি। ‘সংযোগ উভয় দেশের জন্যই আশীর্বাদ’ শিরোনামে লেখা ওই নিবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘সংযোগ এবং জ্বালানি নিরাপত্তা গত দুই দশক ধরে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কেন্দ্র-মঞ্চ দখল করেছে।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমদ এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিশ্বায়নের যুগে কানেকটিভিটি বা সংযোগ একটি বাস্তবতা। কানেকটিভিটির প্রসঙ্গ এলে এর বিপরীতে নিরাপত্তার প্রসঙ্গ চলে আসে, অবাঞ্ছিত শক্তির অনুপ্রবেশের বিষয়টিও আলোচনায় আসে। আজকের প্রেক্ষাপটে এমন ভাবনা একেবারেই অমূলক। বর্তমান বিশ্বে শুধু মানুষে মানুষে নয়, এখন মানুষ যুক্ত হচ্ছে আইটি, তথ্য, জ্বালানি দেওয়া-নেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমে।’
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যান। ওই সফরেও হাসিনা-মোদির যৌথ বিবৃতিতে দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক রেল, সড়ক ও অন্যান্য যোগাযোগ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। উভয় পক্ষই টঙ্গী-আখাউড়া লাইনের ডুয়েল গেজে রূপান্তর, রেলওয়ে রোলিং স্টক সরবরাহ, বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মীদের জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নত সেবার জন্য আইটি সহযোগিতার মতো চলমান দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগকে স্বাগত জানায়।
দুই প্রধানমন্ত্রী কাউনিয়া-লালমনিরহাট-মোগলঘাট-নিউ গীতালদাহা সংযোগ, হিলি ও বিরামপুরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন, ট্র্যাক ও সিগন্যালিং সিস্টেমের আপগ্রেডেশন এবং বেনাপোল-যশোর লাইন বরাবর রেলস্টেশন, বুড়িমারী ও চ্যাংড়াবান্ধার মধ্যে সংযোগ পুনঃস্থাপনের মতো নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানান। ২০২১ সালের ২৬ মার্চ মোদির বাংলাদেশ সফরের সময়ও সংযোগের বিষয়টি দুই পক্ষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করে।
২০২৩ সালের ১ নভেম্বর দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভার্চুয়ালি উদ্বোধন হওয়া এই দুটি সংযোগ হলো আখাউড়া-আগরতলা ক্রস বর্ডার রেললিংক এবং খুলনা-মোংলা রেললাইন।
হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আখাউড়া-আগরতলা আন্তসীমান্ত রেল সংযোগ প্রথমবারের মতো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বাংলাদেশের সঙ্গে রেলপথে সংযুক্ত করবে। এটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে আরও ভালো সংযোগের সুবিধা দেবে এবং বাণিজ্য ও পর্যটনকে বাড়িয়ে তুলবে।’
দুই দেশের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ পাকিস্তান আমলে ছিল। কিন্তু ১৯৬৫ সালের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। সেগুলোই নতুন করে চালু করছে ঢাকা-দিল্লি।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর সঙ্গে ভারতের নানা অঞ্চলের যোগাযোগ বহুদিন ধরে। ১৯৬৫ সালের পর অনেক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সেগুলো আবার চালু করা হচ্ছে।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বায়নের যুগে কোনো দেশই একা একা চলতে পারে না। ইউরোপের দেশগুলোর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। পুরো ইউরোপে সেই অর্থে কোনো সীমান্ত নেই। আর বাংলাদেশের তো তিন দিকে ভারত বেষ্টন করে আছে। কাজেই সংযোগ এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম স্থলসীমান্ত। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ২ হাজার ২১৭ কিলোমিটার, আসামের সঙ্গে ২৬২ কিলোমিটার, মেঘালয়ের সঙ্গে ৪৪৩ কিলোমিটার, ত্রিপুরার সঙ্গে ৮৫৬ কিলোমিটার এবং মিজোরামের সঙ্গে ৩১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এ ছাড়া উভয় পাশে প্রায় ২০০টি ছিটমহল ছিল, যেগুলো দুই দেশের মধ্যে বিনিময় হয়েছে।
শুধু যে রেল বা স্থল সংযোগের ওপর দুই দেশ গুরুত্ব দিচ্ছে তা নয়। গুরুত্ব দিচ্ছে মেরিটাইম কানেকটিভিটি বা সমুদ্র সংযোগেও। এর ফলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে।
ভারতের বিখ্যাত গবেষণা সংস্থা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের সফল পরীক্ষায় ভারত-বাংলাদেশ সামুদ্রিক যোগাযোগকে একটি বড় উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের ১৮ জুলাই এমভি শেজ্যোতি ভারতের ত্রিপুরা ও আসাম থেকে এবং চারটি কনটেইনার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়ার শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি বন্দর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করে। চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ভারতের ল্যান্ডলকড উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার এটিই প্রথম ট্রায়াল ছিল বলে যাত্রাটি ছিল ঐতিহাসিক। এই পদক্ষেপটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কও জোরদার করবে বলে আশা করা হচ্ছে।’
আগামীকাল পড়ুন: বাংলাদেশ-ভারত সংযোগ: কার কী লাভ (শেষ)