দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ মাদকাসক্তের সংখ্যা ও বাজারে এগিয়ে আছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দফায় দফায় অভিযানে ধরা পড়ছেন মাদক কারবারিরা। প্রতিদিনই গ্রেপ্তার মামলা ও শাস্তি হওয়ার পরেও থেমে নেই মাদকের কারবার।
রাজধানী ঢাকার সর্বত্র এখন মাদক বিক্রির স্পট। রাজধানীর ৬টি এলাকাকে মাদকের রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করেছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। রেড জোনে রয়েছে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, মহাখালীর কড়াইল বস্তি, কালশী বিহারি ক্যাম্প, কারওয়ান বাজার, খিলগাঁও ও যাত্রাবাড়ী। এ ছাড়া ইয়েলো ও গ্রিন জোনের তালিকায় রয়েছে পুরো রাজধানী।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানায়, রাজধানী ঢাকা দেশের সবচেয়ে বড় মাদকের বাজার। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পরেও দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা হয়ে ঢাকায় আসছে মাদক। সড়ক, নদী, সাগর ও আকাশপথে প্রতিনিয়ত রাজধানীতে ঢুকছে মাদক।
গবেষকরা বলছেন, একসময় হেরোইন ও ফেনসিডিলের চাহিদা বেশি থাকলেও এখন মাদকের বাজার দখলে নিয়েছে ইয়ারা ও ক্রিস্টাল মেথ (আইস)। বাংলাদেশে এখন এই দুই মাদকের চাহিদা তুঙ্গে। টিনএজরা সবচেয়ে বেশি মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে বলেও গবেষণায় জানা যায়।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের মে পর্যন্ত ৩৬ হাজার ১৭২টি মাদক মামলায় ৪৫ হাজার ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব অভিযানে কয়েক কোটি টাকার মাদক উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ইয়াবা ছিল ১ কোটি ১১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৭৮টি ও গাঁজা জব্দ করা হয় ৬৯ হাজার ৪৮০ কেজি। এ ছাড়া দেশে আইসের চাহিদা বাড়ায় চোরাই পথে বিপুল পরিমাণে এই মাদক আসছে। কারবারিরা মায়ানমার থেকে এই মাদক নিয়ে আসছে। ২০২৪ সালের প্রথম ৪ মাসে দেশে ৬৬ কেজি আইস বা ক্রিস্টাল মেথ উদ্ধার হয়েছে। ২০১৯ সালের শুরুতে আইসের খুব একটা চাহিদা না থাকলেও সম্প্রতি ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় জেলা শহরে আইসের বাজার তৈরি হয়েছে। ফলে অনেক টাকা খরচ করে কারবারিরা আইস আনছে। কারণ ইয়াবার চেয়ে এখন আইস কারবারে লাভ বেশি।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক তানভীর মমতাজ (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) খবরের কাগজকে বলেন, সারা বিশ্বে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ছে মাদক। আমেরিকা, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে মাদক আসক্ত হয়ে প্রতিদিন অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সব দেশই মাদক নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে।
তিনি বলেন, মাদক কারবারের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় অপারেশনসহ নজদারি রাখা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত অভিযান, গ্রেপ্তার ও মামলা দেওয়ার মাধ্যমে মাদক কারবারিদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (নিরোধ শিক্ষা) মো. মানজুরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, দেশে প্রতিনিয়ত ঢুকছে মাদক। দেশের সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রাস্তা ও টহলে বিজিবি সদস্যদের সংকট থাকায় দেশে অবাধে ঢুকছে মাদক। এই মাদক জল, স্থল ও আকাশপথের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে মাদকসেবীর সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি। প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বাড়ছে। শিশু, কিশোর ও তরুণরা বেশি মাদকে আসক্ত হচ্ছে।
রাজধানীর মাদক কারবারিদের তালিকা
রাজধানীতে মাদক কারবারে যুক্ত রয়েছে এমন বেশ কয়েকজনের নাম সম্প্রতি খবরের কাগজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এসব তালিকার বাইরেও রয়েছে অসংখ্য মাদক কারবারি।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প (বিহারি ক্যাম্প) এলাকায় ৪০ হাজারের মতো মানুষের বসবাস। দেশে পাকিস্তানি বিহারিদের সবচেয়ে বড় ক্যাম্প এটি। ক্যাম্পের ঘিঞ্জি পরিবেশে গড়ে উঠেছে রাজধানীর সবচেয়ে বড় মাদকের বাজার।
জেনেভা ক্যাম্পে ইয়াবার ডন হিসেবে পরিচিত শীর্ষ মাদক কারবারি নাদিম ওরফে পঁচিশ ২০১৮ সালে জুলাইয়ে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। পঁচিশ যে দলে কাজ করতেন এর প্রধান ছিলেন ইশতিয়াক। ইশতিয়াকের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন পঁচিশ। ইশতিয়াক মারা যান করোনায়। ইশতিয়াক ও পঁচিশের মৃত্যুর পর ক্যাম্প ও মোহাম্মদপুরজুড়ে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন পাকিস্তানি রাজু। তিনি এখন এই এলাকায় ইয়াবা ডন হিসেবে পরিচিত।
ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, ক্যাম্পের ইয়াবা ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানি রাজুর হাতে। তিনি এখানে থাকেন না। বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে বিভিন্ন সময় ক্যাম্পে আসেন তিনি। তার সহযোগী হচ্ছেন পাচু, পাচুর স্ত্রী ফারহানা, মনির, হাসিব, সোনুরা, ইশরাত, খুরশিদ, পিচ্চি রাজা, জনি, রুবেল ও কামরান। ক্যাম্প ছাড়াও মোহাম্মদপুর এলাকায় রয়েছে মাদক বিক্রির স্পট।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিরপুর বিভাগে গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এই এলাকায় মাদকের সবচেয়ে বড় ডিলার হলেন নুর আলম। নুর আলমদের পারিবারিকভাবে বেশ টাকা-পয়সা রয়েছে। এরপরেও তিনি মিরপুরের বিভিন্ন জায়গায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
মিরপুরে চিহ্নিত বড় মাদক ব্যবসায়ী হলেন রাজিব রায় ওরফে রাজিব। এ ছাড়া রয়েছেন আকরাম হোসেন, সীমা বেগম, নাসিমা রেজা, হেমায়েত হোসেন, আরেফিন নুর আলম ওরফে নুর আলম, খোকন নরা ওরফে পাইটু খোকন, ঘর আলম, মিডিয়া কর্মী তুষার হোসেন। তুষার একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রুফ সেকশনে চাকরি করতেন। তার নামে একাধিক মাদক মামলা রয়েছে। এ ছাড়া যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের প্রত্যেকের নামে ৫ থেকে ৭টি মাদক মামলা রয়েছে এবং তারা কয়েকটি মামলায় পলাতক আসামি।
এই এলাকায় মাদক ব্যবসার শীর্ষে আরও বেশ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে। তারা হলেন বড় মিলন, আরিফুল রহমান মাদক কারবারি (তনরিনের বাবা), তাহেরের ভাতিজা টুলু, শেওড়াপাড়া এলাকার মামা মাসুদ, তুলা মাসুদ, রাজিব, রিঙ্কু, জুয়েল ও নাজিরের বউ হিসেবে পরিচিত নয়ন মনি, মো. ফয়সাল, সোর্স ফয়সাল, সুজন, জনতা হাউজিংয়ের বিশু, মুরগি আলমগীর, সেলুন মিলন, ভদ্র আল আমিন, কায়েস কামাল এবং শাহ আলী থানা এলাকার বাবুল তালুকদার।
গুলশান এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র জানায়, এই এলাকায় যারা মাদক ব্যবসা করেন তারা হলেন মাদক সম্রাট আলমগীর, সেন্টু ভাই, মো. মোহন, ল্যাংড়া সোহেল, প্রাইভেট পাটোয়ারী, সুমন, পাগল শিরিন, আকাশ খুদি, কামাল, বস্তির রাসেল (রাসেল অস্ত্র মাদকসহ কয়েকটা মামলার আসামি), মাদক ব্যবসায়ী (নিহত) ইসমাইলের ছোট ভাই তরু ওরফে মনা, প্রিন্স ইসমাইল, সাততলার বাপ্পী, কড়াইয়ের রুবেল, গুলশানের আলী রবি, চিকু শর্মা, জাহিদুল আলম সজল, যুবলীগ নেত্রী তাসলিমা বেগম, হাসিনা বেগম, যুবলীগ নেতা মোস্তফা, মোশারফ বাজারের রুবেল, হাত কাটা বাবু পুলিশি সোর্স ছিল (মাদকের শীর্ষে) নাম অস্ত্রধারী রুবেল (বনানী খাজা বাবার দরবার শরিফের), বসুন্ধরার আনিকা ও কুড়িল বিশ্বরোডের শাহানাজ লিজা।
গোয়েন্দা সূত্রমতে, তেজগাঁও এলাকায় মাদকের শীর্ষ ব্যবসায়ী হলেন হোয়াইট ফারুক। ফারুক কয়েকটি মাদক মামলাসহ খুনের আসামি। ফারুকের বউ তাসলি তার তেজগাঁও এলকার নিজ বাড়িতে গাঁজার চাষ করেন। এ ছাড়া আরও রয়েছেন মাইছা মনির, বাবু, মাসুদ, ইয়াকুব, জুতার সুমন, গিটার সুমন, ভোকাল সুমন, নাখালপাড়ার ছোট বাবু, সানি, ইয়াকুব, ফারহানা, মোহাম্মদপুরের হিরোইন সুজন, ৬০ ফিটের রেজাউল (গার্মেন্ট ব্যবসায়ী) ও কানা আল আমিন। আমিন নিজ বাড়ির ছাড়ে গাঁজা চাষ করতে গিয়ে একবার ধরাও পড়েন।
সূত্র জানায়, উত্তরা এলাকায় মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বস এয়ন, (একসময় পুলিশের সোর্স ছল), রানী রাজ। এ ছাড়া আলমগীর, সেন্টু, বাবুল হোসেন, (সেন্টুরা ইয়াবা তৈরির চেষ্টা কালে গ্রেপ্তার হন) ফরমা নয়ন, যুবতী মডেল নামে পরিচিত তুলি, মডেল যুবতী সামিরা, রাকিবুল ইসলাম, কুড়িলের বাবু, বড় মোশাররফ, সাবেক ক্যামেরা অ্যাসিস্ট্যান্ট আরমান, কুড়িল বিশ্বরোডের আরমান, রুমা বেগম, বসুন্ধরার পুতুল, তূরজো, রবি, কুড়িল নতুন রাস্তার হেলাল, অয়েন, ভাটারার জিল্লু, পাতা বাবু, দুলাল, কাল্লা রুবেল, নেহাল, জাহাঙ্গীর ও উত্তরা আজিমপুরের পলি মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত।
এদিকে বনশ্রী ও আফতাবনগর এলাকায় মাদক কারবারের শীর্ষে রয়েছেন ভাইজান আলমগীর, আলমগীর মিম, নায়িকা মৌ (নামধারী মডেল একসময় একটি বেসরকারি অফিসের স্টাফ ছিলেন মিম), মাসুদ, রাসেল, চুইন্যা মঈন, ঊর্মি খাতুন (ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্ক করে মাদক সেবনের মার্কেটিং করে), শর্মা ফারুক, জামাল এলেক্স, বেড়াইতে ওহিদ, নয়ন, কমিশনার নির্বাচন করেছে মো. নয়ন।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মতিঝিল এলাকায় মাদক ব্যবসা করেন সাবেক এক ডিআইজির পুত্র মুগদা এলাকার নামধারী মাদক ব্যবসায়ী আরাফাত জুয়েল (তিনি বাঁশের বক্সে করে ইয়াবা পাচার করেন)। ইয়াবা বিক্রি করলেও তিনি নিয়মিত ফেনসিডিল সেবন করেন। এ ছাড়া এই এলাকায় ফান্টু হাবিব, ছোট পারভেজ (মতিঝিল চত্বর) আলামিন মিত্র, পিয়াস মুগদা, সুন্দরী যুবতী নাসিমা আক্তার মাগুরা (বাসাবো), সোহেল, রাকিব, তাহমিনা ভাবি, সাথী ভাবি, নবী, হানিফ, যাত্রাবাড়ীর মাসুদ, বাসাবোর রহিমা, সুন্দরী সীমা, লাইলী প্রমুখ মাদকের কারবার করেন।
লালবাগ গোয়েন্দাদের তথ্য বলছে, পুরান ঢাকার নামকরা মাদক কারবারি হলেন মোহাম্মদ সেলিম। সেলিমের নামে একাধিক মামলা রয়েছে। সেলিম ঘোড়ার শাহ মাজার রোডে বসবাস করেন। এ ছাড়া এ এলাকায় রয়েছেন নামধারী যুবলীগ নেতা আরিফ, বড় ভাই শহিদ। শহিদ শুধু হেরোইনের ব্যবসা করেন। এ ছাড়া আরও রয়েছে খাককি বাবু, মাসুম প্রমুখ। এসব মাদক কারবারি পুরান ঢাকার সরকারি বিভিন্ন কোয়ার্টারের মধ্যে গিয়ে নিরিবিলি স্থান বেছে নিয়ে মাদকের হাটবাজার বসান। স্থানীয় ও বসবাসরতদের দীর্ঘদিন ধরে এমন অভিযোগ রয়েছে।
মাদকের এসব বিষয় নিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বসুন্ধরা ৩০০ ফিট, গাবতলী, সায়দাবাদ, যাত্রবাড়ী, বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস, নদীপথে ট্রলার বা অন্যান্যভাবে রাজধানীতে সীমান্ত এলাকা দিয়ে এসব মাদক প্রবেশ করছে।