ঢাকা ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪

রাজধানীতে মাদকের নতুন ৬ রেড জোন

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:১৯ পিএম
আপডেট: ২৬ জুন ২০২৪, ০১:২৬ পিএম
রাজধানীতে মাদকের নতুন ৬ রেড জোন
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ মাদকাসক্তের সংখ্যা ও বাজারে এগিয়ে আছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দফায় দফায় অভিযানে ধরা পড়ছেন মাদক কারবারিরা। প্রতিদিনই গ্রেপ্তার মামলা ও শাস্তি হওয়ার পরেও থেমে নেই মাদকের কারবার। 

রাজধানী ঢাকার সর্বত্র এখন মাদক বিক্রির স্পট। রাজধানীর ৬টি এলাকাকে মাদকের রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করেছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। রেড জোনে রয়েছে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, মহাখালীর কড়াইল বস্তি, কালশী বিহারি ক্যাম্প,  কারওয়ান বাজার, খিলগাঁও ও যাত্রাবাড়ী। এ ছাড়া ইয়েলো ও গ্রিন জোনের তালিকায় রয়েছে পুরো রাজধানী। 

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানায়, রাজধানী ঢাকা দেশের সবচেয়ে বড় মাদকের বাজার। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পরেও দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা হয়ে ঢাকায় আসছে মাদক। সড়ক, নদী, সাগর ও আকাশপথে প্রতিনিয়ত রাজধানীতে ঢুকছে মাদক।

গবেষকরা বলছেন, একসময় হেরোইন ও ফেনসিডিলের চাহিদা বেশি থাকলেও এখন মাদকের বাজার দখলে নিয়েছে ইয়ারা ও ক্রিস্টাল মেথ (আইস)। বাংলাদেশে এখন এই দুই মাদকের চাহিদা তুঙ্গে। টিনএজরা সবচেয়ে বেশি মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে বলেও গবেষণায় জানা যায়। 

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের মে পর্যন্ত ৩৬ হাজার ১৭২টি মাদক মামলায় ৪৫ হাজার ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব অভিযানে কয়েক কোটি টাকার মাদক উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে  ইয়াবা ছিল ১ কোটি ১১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৭৮টি ও গাঁজা জব্দ করা হয় ৬৯ হাজার ৪৮০ কেজি। এ ছাড়া দেশে আইসের চাহিদা বাড়ায় চোরাই পথে বিপুল পরিমাণে এই মাদক আসছে। কারবারিরা মায়ানমার থেকে এই মাদক নিয়ে আসছে। ২০২৪ সালের প্রথম ৪ মাসে দেশে ৬৬ কেজি আইস বা ক্রিস্টাল মেথ উদ্ধার হয়েছে। ২০১৯ সালের শুরুতে আইসের খুব একটা  চাহিদা না থাকলেও সম্প্রতি ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় জেলা শহরে আইসের বাজার তৈরি হয়েছে। ফলে অনেক টাকা খরচ করে কারবারিরা আইস আনছে। কারণ ইয়াবার চেয়ে এখন আইস কারবারে লাভ বেশি। 

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক তানভীর মমতাজ (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) খবরের কাগজকে বলেন, সারা বিশ্বে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ছে মাদক। আমেরিকা, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে মাদক আসক্ত হয়ে প্রতিদিন অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সব দেশই মাদক নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে।

তিনি বলেন, মাদক কারবারের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় অপারেশনসহ নজদারি রাখা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত অভিযান, গ্রেপ্তার ও মামলা দেওয়ার মাধ্যমে মাদক কারবারিদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। 

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (নিরোধ শিক্ষা) মো. মানজুরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, দেশে প্রতিনিয়ত ঢুকছে মাদক। দেশের সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রাস্তা ও টহলে বিজিবি সদস্যদের সংকট থাকায় দেশে অবাধে ঢুকছে মাদক। এই মাদক জল, স্থল ও আকাশপথের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। 

তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে মাদকসেবীর সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি। প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বাড়ছে। শিশু, কিশোর ও তরুণরা বেশি মাদকে আসক্ত হচ্ছে। 

রাজধানীর মাদক কারবারিদের তালিকা
রাজধানীতে মাদক কারবারে যুক্ত রয়েছে এমন বেশ কয়েকজনের নাম সম্প্রতি খবরের কাগজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এসব তালিকার বাইরেও রয়েছে অসংখ্য মাদক কারবারি। 

রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প (বিহারি ক্যাম্প) এলাকায় ৪০ হাজারের মতো মানুষের বসবাস। দেশে পাকিস্তানি বিহারিদের সবচেয়ে বড় ক্যাম্প এটি। ক্যাম্পের ঘিঞ্জি পরিবেশে গড়ে উঠেছে রাজধানীর সবচেয়ে বড় মাদকের বাজার।

জেনেভা ক্যাম্পে ইয়াবার ডন হিসেবে পরিচিত শীর্ষ মাদক কারবারি নাদিম ওরফে পঁচিশ ২০১৮ সালে জুলাইয়ে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। পঁচিশ যে দলে কাজ করতেন এর প্রধান ছিলেন ইশতিয়াক। ইশতিয়াকের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন পঁচিশ। ইশতিয়াক মারা যান করোনায়। ইশতিয়াক ও পঁচিশের মৃত্যুর পর ক্যাম্প ও মোহাম্মদপুরজুড়ে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন পাকিস্তানি রাজু। তিনি এখন এই এলাকায় ইয়াবা ডন হিসেবে পরিচিত। 

ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, ক্যাম্পের ইয়াবা ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানি রাজুর হাতে। তিনি এখানে থাকেন না। বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে বিভিন্ন সময় ক্যাম্পে আসেন তিনি। তার সহযোগী হচ্ছেন পাচু, পাচুর স্ত্রী ফারহানা, মনির, হাসিব, সোনুরা, ইশরাত, খুরশিদ, পিচ্চি রাজা, জনি, রুবেল ও কামরান। ক্যাম্প ছাড়াও মোহাম্মদপুর এলাকায় রয়েছে মাদক বিক্রির স্পট। 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিরপুর বিভাগে গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এই এলাকায় মাদকের সবচেয়ে বড় ডিলার হলেন নুর আলম। নুর আলমদের পারিবারিকভাবে বেশ টাকা-পয়সা রয়েছে। এরপরেও তিনি মিরপুরের বিভিন্ন জায়গায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

মিরপুরে চিহ্নিত বড় মাদক ব্যবসায়ী হলেন রাজিব রায় ওরফে রাজিব। এ ছাড়া রয়েছেন আকরাম হোসেন, সীমা বেগম, নাসিমা রেজা, হেমায়েত হোসেন, আরেফিন নুর আলম ওরফে নুর আলম, খোকন নরা ওরফে পাইটু খোকন, ঘর আলম, মিডিয়া কর্মী তুষার হোসেন। তুষার একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রুফ সেকশনে চাকরি করতেন। তার নামে একাধিক মাদক মামলা রয়েছে। এ ছাড়া যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের প্রত্যেকের নামে ৫ থেকে ৭টি মাদক মামলা রয়েছে এবং তারা কয়েকটি মামলায় পলাতক আসামি।

এই এলাকায় মাদক ব্যবসার শীর্ষে আরও বেশ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে। তারা হলেন বড় মিলন, আরিফুল রহমান মাদক কারবারি (তনরিনের বাবা), তাহেরের ভাতিজা টুলু, শেওড়াপাড়া এলাকার মামা মাসুদ, তুলা মাসুদ, রাজিব, রিঙ্কু, জুয়েল ও নাজিরের বউ হিসেবে পরিচিত নয়ন মনি, মো. ফয়সাল, সোর্স ফয়সাল, সুজন, জনতা হাউজিংয়ের বিশু, মুরগি আলমগীর, সেলুন মিলন, ভদ্র আল আমিন, কায়েস কামাল এবং শাহ আলী থানা এলাকার বাবুল তালুকদার।

গুলশান এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র জানায়, এই এলাকায় যারা মাদক ব্যবসা করেন তারা হলেন মাদক সম্রাট আলমগীর, সেন্টু ভাই, মো. মোহন, ল্যাংড়া সোহেল, প্রাইভেট পাটোয়ারী, সুমন, পাগল শিরিন, আকাশ খুদি, কামাল, বস্তির রাসেল (রাসেল অস্ত্র মাদকসহ কয়েকটা মামলার আসামি), মাদক ব্যবসায়ী (নিহত) ইসমাইলের ছোট ভাই তরু ওরফে মনা, প্রিন্স ইসমাইল, সাততলার বাপ্পী, কড়াইয়ের রুবেল, গুলশানের আলী রবি, চিকু শর্মা, জাহিদুল আলম সজল, যুবলীগ নেত্রী তাসলিমা বেগম, হাসিনা বেগম, যুবলীগ নেতা মোস্তফা, মোশারফ বাজারের রুবেল, হাত কাটা বাবু পুলিশি সোর্স ছিল (মাদকের শীর্ষে) নাম অস্ত্রধারী রুবেল (বনানী খাজা বাবার দরবার শরিফের), বসুন্ধরার আনিকা ও কুড়িল বিশ্বরোডের শাহানাজ লিজা।

গোয়েন্দা সূত্রমতে, তেজগাঁও এলাকায় মাদকের শীর্ষ ব্যবসায়ী হলেন হোয়াইট ফারুক। ফারুক কয়েকটি মাদক মামলাসহ খুনের আসামি। ফারুকের বউ তাসলি তার তেজগাঁও এলকার নিজ বাড়িতে গাঁজার চাষ করেন। এ ছাড়া আরও রয়েছেন মাইছা মনির, বাবু, মাসুদ, ইয়াকুব, জুতার সুমন, গিটার সুমন, ভোকাল সুমন, নাখালপাড়ার ছোট বাবু, সানি, ইয়াকুব, ফারহানা, মোহাম্মদপুরের হিরোইন সুজন, ৬০ ফিটের রেজাউল (গার্মেন্ট ব্যবসায়ী) ও কানা আল আমিন। আমিন নিজ বাড়ির ছাড়ে গাঁজা চাষ করতে গিয়ে একবার ধরাও পড়েন। 

সূত্র জানায়, উত্তরা এলাকায় মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বস এয়ন, (একসময় পুলিশের সোর্স ছল), রানী রাজ। এ ছাড়া আলমগীর, সেন্টু, বাবুল হোসেন, (সেন্টুরা ইয়াবা তৈরির চেষ্টা কালে গ্রেপ্তার হন) ফরমা নয়ন, যুবতী মডেল নামে পরিচিত তুলি, মডেল যুবতী সামিরা, রাকিবুল ইসলাম, কুড়িলের বাবু, বড় মোশাররফ, সাবেক ক্যামেরা অ্যাসিস্ট্যান্ট আরমান, কুড়িল বিশ্বরোডের আরমান, রুমা বেগম, বসুন্ধরার পুতুল, তূরজো, রবি, কুড়িল নতুন রাস্তার হেলাল, অয়েন, ভাটারার জিল্লু, পাতা বাবু, দুলাল, কাল্লা রুবেল, নেহাল, জাহাঙ্গীর ও উত্তরা আজিমপুরের পলি মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত। 

এদিকে বনশ্রী ও আফতাবনগর এলাকায় মাদক কারবারের  শীর্ষে রয়েছেন ভাইজান আলমগীর, আলমগীর মিম, নায়িকা মৌ (নামধারী মডেল একসময় একটি বেসরকারি অফিসের স্টাফ ছিলেন মিম), মাসুদ, রাসেল, চুইন্যা মঈন, ঊর্মি খাতুন (ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্ক করে মাদক সেবনের মার্কেটিং করে), শর্মা ফারুক, জামাল এলেক্স, বেড়াইতে ওহিদ, নয়ন, কমিশনার নির্বাচন করেছে মো. নয়ন।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মতিঝিল এলাকায় মাদক ব্যবসা করেন সাবেক এক ডিআইজির পুত্র মুগদা এলাকার নামধারী মাদক ব্যবসায়ী আরাফাত জুয়েল (তিনি বাঁশের বক্সে করে ইয়াবা পাচার করেন)। ইয়াবা বিক্রি করলেও তিনি নিয়মিত ফেনসিডিল সেবন করেন। এ ছাড়া এই এলাকায় ফান্টু হাবিব, ছোট পারভেজ (মতিঝিল চত্বর) আলামিন মিত্র, পিয়াস মুগদা, সুন্দরী যুবতী নাসিমা আক্তার মাগুরা (বাসাবো), সোহেল, রাকিব, তাহমিনা ভাবি, সাথী ভাবি, নবী, হানিফ, যাত্রাবাড়ীর মাসুদ, বাসাবোর রহিমা, সুন্দরী সীমা, লাইলী প্রমুখ মাদকের কারবার করেন।

লালবাগ গোয়েন্দাদের তথ্য বলছে, পুরান ঢাকার নামকরা মাদক কারবারি হলেন মোহাম্মদ সেলিম। সেলিমের নামে একাধিক মামলা রয়েছে। সেলিম ঘোড়ার শাহ মাজার রোডে বসবাস করেন। এ ছাড়া এ এলাকায় রয়েছেন নামধারী যুবলীগ নেতা আরিফ, বড় ভাই শহিদ। শহিদ শুধু হেরোইনের ব্যবসা করেন। এ ছাড়া আরও রয়েছে খাককি বাবু, মাসুম প্রমুখ। এসব মাদক কারবারি পুরান ঢাকার সরকারি বিভিন্ন কোয়ার্টারের মধ্যে গিয়ে নিরিবিলি স্থান বেছে নিয়ে মাদকের হাটবাজার বসান। স্থানীয় ও বসবাসরতদের দীর্ঘদিন ধরে এমন অভিযোগ রয়েছে।

মাদকের এসব বিষয় নিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বসুন্ধরা ৩০০ ফিট, গাবতলী, সায়দাবাদ, যাত্রবাড়ী, বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস, নদীপথে ট্রলার বা অন্যান্যভাবে রাজধানীতে সীমান্ত এলাকা দিয়ে এসব মাদক প্রবেশ করছে।

শিমুলের দুর্নীতির প্রমাণ দেশে-বিদেশে

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৫০ এএম
আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২৯ পিএম
শিমুলের দুর্নীতির প্রমাণ দেশে-বিদেশে
কানাডার টরেন্টোতে (বাঁয়ে) ও নাটোরে সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের আলিশান বাড়ি। ইনসাটে শফিকুল ইসলাম শিমুল

বাবা ঠিকাদার হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই বিলাসী জীবনযাপন ছিল নাটোর-২ (সদর-নলডাঙ্গা) আসনের সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের। বাড়ি নাটোর শহরে হওয়ায় ছাত্রজীবনেই জেলা ছাত্রলীগে ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক পদ দিয়ে শুরু হয় নেতৃত্ব। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কাউন্সিলের মাধ্যমে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। ২০০৮ সালে তিনি নাটোর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন। ২০১৪ সালে নির্বাচিত হন নাটোর-২ (সদর-নলডাঙ্গা) আসনের এমপি। ২০১৮ ও ২০২৪ সালেও এমপি হন শিমুল। পাশাপাশি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদেও আসীন হন তিনি। এতে তার শক্তি ও ক্ষমতা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। 

নাটোরের রাজনৈতিক-সচেতন মহলের দাবি, একসময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রেনে উঠে নাটোর রেলস্টেশনে নেমে রাজনৈতিক সমাবেশ করতে চাইলে সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু তা প্রতিরোধ করেন। ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা নাটোরে আওয়ামী লীগের শক্ত নেতৃত্ব চান, যাতে দুলু নাটোরে টিকতে না পারেন।

এমপি শিমুল শেখ হাসিনার ওই মনোভাব জানতেন। তাই তিনি দুলুমুক্ত নাটোর ঘোষণা করেন এবং তা বাস্তবায়নও করেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের আগ পর্যন্ত শিমুল নাটোর বিএনপি-জামায়াতমুক্ত রাখতে পুলিশি ও রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহারে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি। ওই একটি কারণেই শেখ হাসিনা বারবার শিমুলকে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছেন।

তবে শেখ হাসিনার মাধ্যমে বারবার এমপি মনোনয়ন পেলেও জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবার, স্বজন ও পছন্দের মানুষদের বসানো, জেলার আর্থিকভাবে লাভবান প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব বলয়ের মানুষকে বসানো, নিজ পছন্দের মানুষদের নেতৃত্বে দল ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠন ইত্যাদি কারণে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং অন্য এমপিসহ জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের একাংশের প্রতিপক্ষে পরিণত হন শিমুল।

এরই ধারাবাহিকতায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ হারাতে হয় শিমুলকে। 

স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ ও শিমুলের কাছের মানুষদের দাবি, দীর্ঘ ১৬ বছর জনপ্রতিনিধি থাকার সুবাদে অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন। নাটোরে এক রাজকীয় বাড়ি, কানাডায় বাড়ি, জমি, প্লটসহ কোটি কোটি টাকার ব্যাংক-ব্যালান্স রয়েছে শিমুলের। পাশাপাশি তার পরিবার, স্বজন ও পছন্দের কিছু মানুষও দুর্নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন। তবে শিমুল ও তার স্বজনরা এসব দাবি অস্বীকার করেছেন। 

তথ্যমতে, ২০০৮ সালে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় ঠিকাদারি করে বছরে ২ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছিলেন শফিকুল। তখন সব মিলিয়ে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল সাড়ে ১৪ লাখ টাকার মতো। স্ত্রীর সম্পদ ছিল সাড়ে ৪ লাখ টাকার কিছু বেশি। ওই সময় তাদের কোনো গাড়ি ছিল না। নিজ নামে কোনো বাড়িও ছিল না।

২০১৩ সালের হলফনামায় শিমুল নিজের নামে ১১ লাখ ও স্ত্রীর নামে ৫১ লাখ টাকার হিসাব দেখান। ২০১৮ সালে দুজনের নামে মোট সম্পদ দেখান ৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

২০১৮-১৯ সালে তিনি ২ কোটি ১৪ লাখ টাকা আয় দেখালেও পরের বছর ওই আয় দেখানো হয় ১৬ লাখ টাকা। দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হওয়ার পর পরই শহরের কান্দিভিটুয়া পিটিআই রোডে ‘জান্নাতি প্যালেস’ নামে বিশাল বাড়ি করেন। ২৮ শতক জমির ওপর নির্মিত বাড়িটি দেখতে রাজপ্রাসাদের মতো, যা নির্মাণে ৩ কোটি টাকা খরচের দাবি করেন স্থানীয়রা। ২০২০-২১ অর্থবছরে তার সম্পদ বেড়ে হয় ৪ কোটি ২২ লাখ টাকারও বেশি।

জানা যায়, কানাডার ব্যাংকে শিমুলের দুটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি কানাডার ব্যাংকের অ্যাকাউন্টগুলোতে টাকার পরিমাণ ছিল ৬১ কোটি ৬২ লাখ টাকা।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি টরন্টোতে পাঁচ বেড, পাঁচ বাথরুম ও তিনটি পার্কিংসহ ওই বাড়িটি কেনেন প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকায়।

২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামা অনুসারে তার বার্ষিক আয় প্রায় ৫৩ লাখ ৩ হাজার ১০৯ টাকা। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৪ কোটি ৯৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা। অর্থাৎ দেড় দশকে তার সম্পদ বেড়েছে ৩৪ গুণের বেশি। একই সময় স্ত্রীর সম্পদ ১৬৩ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা। আগে তার স্ত্রীর কোনো আয় ছিল না। তবে এখন আয় বছরে ২৮ লাখ ২৮ হাজার ৩৬০ টাকা।

জেলা আওয়ামী লীগের একাংশের দাবি, নাটোর ও কানাডায় স্ত্রী জান্নাতির নামে বাড়ি ছাড়াও দেশ-বিদেশের ব্যাংকে রয়েছে কোটি কোটি টাকা। আয়কর রিটার্নে জান্নাতিকে গৃহবধূ উল্লেখ করলেও ব্যবসা থেকে তার আয় বেড়েছে- এমন দাবি করতেন শিমুল। তবে কী ব্যবসা তা প্রকাশ করেননি।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হয় শিমুলের নাটোরের বাড়ি। সঙ্গে তিনটি পাজেরো গাড়ি। ওই দিনই আত্মগোপনে যান শিমুল, তার পরিবারের সদস্যরা, স্বজন ও আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী নেতারা।

ওই দিন সকালেও ‘নাটোরের রাজপথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে ব্যস্ত ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল। ওই দিন বিকেলেই তিনি আত্মগোপনে যান। এরপর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা শহরের কান্দিভিটুয়া মহল্লায় ‘জান্নাতি প্যালেস’ নামে তার প্রাসাদোপম বাড়িতে হামলা চালান। ভাঙচুর, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগে ধ্বংসস্তূপে পরিণত বাড়িটি দেখতে এখন প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সেখানে আসেন। ওই সময় আগুন দেওয়া হয় শিমুলের বাড়ির পাশে তার ভাই সাগরের বাড়িও। 

এদিকে দুদক সূত্রে জানা যায়, অর্থ পাচারের মাধ্যমে কানাডায় বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ২ সেপ্টেম্বর শিমুলের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।

জানা যায়, দুদকের কমিশন সভায় সাবেক এই এমপির দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, শফিকুল ইসলাম শিমুলের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, প্রকল্পে অনিয়মসহ দেশে-বিদেশে বিপুল অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের তথ্য আমলে নিয়ে কমিশন তার দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

শিমুলের নামে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে অর্থ পাচার করে কানাডায় বাড়ি কেনার অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে বলে দুদকসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। 

আরও জানা যায়, গত ১৫ আগস্ট শফিকুল ইসলাম শিমুল এবং তার স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতির ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ। 

দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের তথ্যমতে, কানাডার টরন্টোর নিকটবর্তী স্কারবরো শহরে তার নামে একটি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। 

স্থানীয়রা জানান, শিমুল সংসদ সদস্য হওয়ার পরই নাটোরে জান্নাতি প্যালেস নির্মাণ করেন। এ ছাড়া স্থানীয় ভেদরার বিলে তিনি ১৬ বিঘা জমি কিনেছেন। নাটোরের নীচাবাজার এলাকায়ও রয়েছে প্লট।

গত নির্বাচনের আগে নাটোরের কয়েকজন নেতা দলীয়প্রধানের কাছে শিমুলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয়, ঢাকার আদাবর রিং রোডে স্ত্রী, শাশুড়ি ও ভগ্নিপতির নামে পাঁচটি ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, মালেয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে নামে-বেনামে তার সম্পদ রয়েছে।

শিমুলের অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের বিষয়টি অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন মহলে আলোচনায় আছে। গত বছর এ ব্যাপারে শিমুলের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, সবই ‘অপপ্রচার’। যা কিছু দেখা যাচ্ছে, তা তার বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ ও ঠিকাদারি ব্যবসা থেকে করা। তিনি আরও দাবি করেছিলেন, তার স্ত্রী ব্যবসা করেন। কী ব্যবসা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব তো বলা যাবে না। ট্যাক্স ফাইলে সব বলা আছে।’ তিনি ওই সময়ে আরও দাবি করেন, তার পরিবার কানাডায় থাকে। পরিবারের খরচের প্রয়োজনীয় টাকা তিনি বৈধভাবেই পাঠান।

স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দাবি, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন শফিকুল ইসলাম শিমুল। নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে তিনি পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মামলা-হামলার মাধ্যমে হয়রানি করেছেন। নিজ দলের প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতা-কর্মীরাও তার নির্যাতন থেকে বাদ যাননি। দলের সিনিয়র ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে দলীয় পদে বসিয়েছেন নিকটাত্মীয় ও বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে।

জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শফিকুল ইসলামের আয়ের মূল উৎস ছিল বিভিন্ন প্রকল্প থেকে কমিশন গ্রহণ, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ-বাণিজ্য, পরিবহনে চাঁদাবাজি, সরকারি প্রণোদনা ও টিআর-কাবিখার লোপাট করা অর্থ।

জেলা আওয়ামী লীগের এক পদবঞ্চিত সাবেক নেতার দাবি, ২০১৫ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার আগ পর্যন্ত শফিকুলের পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন না। ওই বছর তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। তখনই তিনি তার স্ত্রী শামীমা সুলতানাকে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, বড় ভাই শরিফুল ইসলামকে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, বড় ভাবি সীমা পারভিনকে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, ভাই সিরাজুল ইসলামকে পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, আরেক ভাই সাজেদুল আলমকে জেলা যুবলীগের সদস্য, ভাইয়ের স্ত্রী সিনথিয়া ইসলামকে জেলা যুব মহিলা লীগের সহসভাপতি, বোন নাছিমা রহমানকে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ভগ্নিপতি সাজেদুর রহমান ওরফে বুড়া চৌধুরীকে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, বোন নাজলী রহমানকে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, দুলাভাই আমিরুল ইসলাম জাহানকে জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ, ভাগনে নাফিউল ইসলামকে পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক, বোনের দেবর খন্দকার ওমর শরীফ চৌহানকে জেলা আওয়ামী লীগের সমাজ কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক পদে বসান।

তার অভিযোগ, জেলা বিএনপি ও জামায়াতের অনেকে শিমুলের হাত ধরে আওয়ামী লীগে পুনর্বাসিত হন।

জেলার এক ঠিকাদার জানান, শফিকুল তার ভগ্নিপতি মীর আমিরুল ইসলাম ওরফে জাহানের মাধ্যমে ঠিকাদারি খাত নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমপির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপে আমিরুল ইসলাম ও তার দুই ভাই ২০১৪ সালের পর থেকে প্রায় ৩৮০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ পেয়েছেন।

জেলা মৎস্যজীবী লীগের এক নেতার দাবি, শিমুলের ভগ্নিপতি সাজেদুর রহমান ওরফে বুড়া চৌধুরী আগে থেকেই সরকারি জলাশয় ইজারা নিয়ে মাছ চাষের ব্যবসা করতেন। শ্যালক সংসদ সদস্য হওয়ার পর বেশির ভাগ সরকারি জলাশয় তার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের এক নেতা দাবি করেন, শিমুলের ছোট ভাই সাজেদুল ইসলাম ২০১৬ সালে অনেকটা জোর করেই পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হন। তার মাধ্যমে পরিবহন খাত থেকে বিপুল চাঁদা উঠত, যার বড় অংশ পেতেন শিমুলও।

 

এবার শিল্পকলায় হচ্ছে না দুদকের দুর্নীতিবিরোধী দিবসের অনুষ্ঠান

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০২:০১ পিএম
এবার শিল্পকলায় হচ্ছে না দুদকের দুর্নীতিবিরোধী দিবসের অনুষ্ঠান

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আয়োজিত আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসের অনুষ্ঠান এ বছর শিল্পকলা একাডেমিতে হচ্ছে না। দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর ‘দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ’ বিষয়ে এক আলোচনা সভা রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলার জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু দুদককে এবার সেই ভেন্যু পরিবর্তন করতে হচ্ছে। কারণ শিল্পকলার নবনিযুক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ মিলনায়তন বরাদ্দের বিষয়টি সরাসরি নাকচ করেছেন। 

বিষয়টি জানতে সোমবার (৭ অক্টোবর) বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মোবাইল ফোনে কয়েকবার সৈয়দ জামিল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে সন্ধ্যা ৭টা ২১ মিনিটে তার ব্যক্তিগত সহকারী সোহেল আলম মোবাইলে ফোন দিয়ে যোগাযোগের কারণ জানতে চান। 

শিল্পকলার মিলনায়তন ব্যবহারে দুদককে ‘না’ করে দেওয়ার বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা হলে সোহেল খবরের কাগজকে বলেন, ‘গতকাল (রবিবার) দুদকের ডিজি পর্যায়ের দুজন কর্মকর্তা শিল্পকলার ডিজি স্যারের কাছে এসেছিলেন। স্যার (ডিজি) তাদের বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মিলনায়তন বরাদ্দ দেওয়া যাবে না।’ এর বাইরে কিছু জানতে চাইলে আগামীকাল (মঙ্গলবার) অফিসে গিয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন সোহেল আলম। 

এদিকে শিল্পকলা একাডেমির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শিল্পকলার ডিজি সেখানকার মিলনায়তন ব্যবহারে দুদক কর্মকর্তাদের অনুরোধ সরাসরি নাকচ করেছেন। দুদকের এ ধরনের অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতিসহ রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তিত্বরা অংশগ্রহণ করেন। এসব শোনার পরও শিল্পকলার ডিজি বলেছেন, আল্লাহর ফেরেশতা নেমে এলেও মিলনায়তন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হবে না। অন্যদিকে দুদকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তন না পাওয়ায় দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তারা রবিবারেই মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মিলনায়তন ও ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের মিলনায়তনসহ সেগুনবাগিচার আশপাশের কয়েকটি মিলনায়তন পরিদর্শন করে এসেছেন। প্রতিবছর শিল্পকলার মিলনায়তন ব্যবহারের মূল কারণ হচ্ছে সেখানে ৭০০ থেকে সাড়ে ৭০০ জনের আয়োজন করা যায় এবং সেটি দুদক প্রধান কার্যালয়সংলঘ্ন ছিল।

আবুল কালাম আজাদ আমলারা মন্ত্রীদের কথা শুনতেন না

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৩৭ পিএম
আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০২:১১ পিএম
আমলারা মন্ত্রীদের কথা শুনতেন না
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক অনেক মন্ত্রী-আমলা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে এনেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বেশ কিছু কথা জানিয়েছেন।

সাবেক আমলা আবুল কালাম আজাদ প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের দায়িত্ব পালন শেষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামালপুর-৫ আসনে নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নিজ এলাকায় ভুরিভোজের আয়োজন করে নির্বাচন বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আসে তার বিরুদ্ধে। 

পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, সরকারের কোনো মন্ত্রী বা এমপি অথবা কোনো উপদেষ্টার দলীয় প্ল্যাটফর্মে আলোচনা করার সুযোগ ছিল না। দলীয় প্ল্যাটফর্মে কেউ খোলাখুলি মতামত দিলে তাকে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা হতো। এ জন্য কেউ মুখ খুলতেন না। শেখ হাসিনা দল ও সরকার পরিচালনায় যে সিদ্ধান্ত নিতেন, সেটাই সবাই অনুসরণ করতেন। 

তিনি জানিয়েছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আমলারা বেপরোয়া হয়ে পড়েছিলেন। তারা কোনো মন্ত্রীর কথা শুনতেন না। এমপিদের পাত্তা দিতেন না। একাধিক মন্ত্রী ও এমপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনেক সচিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি। এতে দিন দিন সচিবরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। আবুল কালাম আজাদের মামলার তদন্তের কাজে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা এ কথা জানিয়েছেন। 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক মুখ্য সচিব ও সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদকে গত শনিবার ধানমন্ডি থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে পল্টনে যুবদল নেতা শামীম হত্যা মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদকে আদালতে হাজির করেন পল্টন থানার এসআই তন্ময় কুমার বিশ্বাস। তিনি সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াদুর রহমান জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আবুল কালাম আজাদ এখন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে আছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা। 

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক জানান, ‘আবুল কালাম আজাদকে রিমান্ডে আনা হয়েছে।’

মামলার তদন্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা জানান, আবুল কালাম আজাদ জিজ্ঞাসাবাদে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। কিছু প্রশ্নের উত্তর দেননি। যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেননি সেগুলো জানার চেষ্টা করছেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি দাবি করেছেন, ১৪ সালের পর মাঠপর্যায়ে পুলিশের তদবির বেড়ে যায়। তার কাছেও কয়েকজন কর্মকর্তা ডিএমপিসহ আরও কয়েকটি জেলায় বদলির সুপারিশের জন্য এসেছিলেন। পরে ওই সব কর্মকর্তার সুপারিশের জন্য তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। 

জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, পুলিশ তদবিরের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাসের কাছে আসত। তিনি কয়েকজনের বদলির জন্য সুপারিশ করলেও ধনঞ্জয়ের জন্য তা হয়নি বলে দাবি করেন। গতকাল সচিবালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ৫ আগস্টের পর ধনঞ্জয় আর সচিবালয়ে আসেন না। 

তার বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে আবুল কালাম আজাদ তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে দাবি করেছেন, পল্টন থানার যে হত্যা মামলায় তাকে জড়ানো হয়েছে তার সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত নন।

সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনের বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, কোটা আন্দোলনের বিষয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ইতিবাচক ছিলেন। বিষয়টি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হোক বলে তিনি চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো প্ল্যাটফর্মে তিনি তার মতামত বলতে পারেননি। ৫ আগস্টের পর তিনি নিশ্চুপ হয়ে যান। তবে তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে দাবি করেছেন যে অন্যদের মতো তার দেশ ছাড়ার কোনো উদ্যোগ ছিল না।

সুস্থ হতে যুদ্ধ চলছে এমদাদের

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০১:২৩ পিএম
আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০১:২৪ পিএম
সুস্থ হতে যুদ্ধ চলছে এমদাদের
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে চোখ হারিয়েছেন এমদাদ

‘আমার এক চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। তাতে আমার দুঃখ নেই। নিজের জন্য চিন্তা করি না। কষ্টের জায়গা হচ্ছে, আমার ভাইয়েরা এখন সরকারে আছে। তবুও আহত ভাইদের চিকিৎসার জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার পরও সুরাহা পেলাম না। কষ্টের জায়গাটা এখানেই।’ 

আক্ষেপের সুরে সোমবার (৭ অক্টোবর) কথাগুলো বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ডান চোখ হারানো রাজধানীর সরকারি মাদ্রাসা-ই আলিয়ার শিক্ষার্থী সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ। তিনি চট্টগ্রামের চকবাজার ডিসি রোড এলাকার মো. বেল্লাল হোসেন ছেলে। 

আন্দোলনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনে আঘাতপ্রাপ্ত বামহাতে গামছা পেঁছিয়ে পুলিশের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে তর্ক করছি। এ ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন থেকেই পুলিশ আমাকে টার্গেট করে। পরে আমি চট্টগ্রামে চলে আসি। এরপর আমাকে আটকের জন্য গোয়েন্দা পুলিশ ঢাকার মেসে এবং চট্টগ্রামের বাসায় কয়েকবার খোঁজ নেয়। তার পরও আমি চট্টগ্রামে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। গত ৪ আগস্ট চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নিউমার্কেট মোড়ে পুলিশের গাড়ির নিচে চাপা পড়া থেকে রক্ষা পেলেও রাবার বুলেট থেকে বাঁচতে পারিনি। বুলেটের আঘাতের পর একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। প্রাথমিক চিকিৎসায় আমার জ্ঞান ফিরে। তবে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে বুলেটের ক্ষত সারাতে হাসপাতালে যাইনি। বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছি। এরপর ৫ আগস্ট বিজয়ের দিন আমি মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম। বিকেলে দামপাড়া পুলিশলাইনস এলাকায় ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের এক দফা সংঘর্ষ হয়। ওই সময় পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল নিক্ষেপ, এমনকি গুলিও করে। অনেক সাধারণ মানুষ ছিল যারা চায়নি পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘাত হোক। তারা গেটে গিয়ে হিউম্যান চেইন তৈরি করে, জনতাকে পুলিশলাইনসের ভিতরে যেতে বাধা দেন। একপর্যায়ে পুলিশ এগ্রেসিভ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গুলি করে। এ সময় আমি পাশের পেট্রলপাম্পের একটি পিলারের পাশে গিয়ে আশ্রয় নিই। লাইনস থেকে পুলিশ বের হয়ে আমাকে একা পেয়ে যায়। আমাকে লক্ষ্য করে পুলিশ দুটি সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। এরপর পুলিশের এক সদস্য গুলি করে। এতে আমি গুলিবিদ্ধ হই। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেয়ে আমি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি। পরে ঢাকার পিজি হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, সিএমএইচ, ল্যাবএইড হাসপাতাল, বাংলাদেশ আই হসপিটাল, জাতীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি।

এমদাদ বলেন, ‘আমি এখন ডান চোখে দেখি না। চিকিৎসকরা চোখের বিষয়ে বলেছেন, রেটিনা ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে তুমি ডান চোখে দেখবে পাবে না। চিকিৎসকরা চান অন্তত চোখটি যেন কেটে ফেলে দিতে না হয়। তারা সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছেন।’

চিকিৎসা খরচ হিসেবে সরকারের কাছ থেকে এক টাকাও না পাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘গত ২০ সেপ্টেম্বর আমি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। ইতোমধ্যে আমার ৩ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। তবে টাকা পায়নি। এটা (টাকা) যদি সঠিক সময়ে দেওয়া না হয়, তাহলে কোনো কাজে আসবে না। আমি আমার কথা বলছি না। আমি বলছি আহত সব সহযোদ্ধার কথা। এখানে অনেক আহত আছেন, যাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানো প্রয়োজন। তা না হলে তাদের অঙ্গহানি হবে। নতুবা মৃত্যুবরণ করবে। তাই সঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসা সহযোগিতা করা অতীব জরুরি। আমার আহত ভাইরা যদি বিনা চিকিৎসায় হারিয়ে যায়, পরে হাজার কোটি টাকা দিয়ে আমরা কি করব?’

স্বপ্নের মেগা প্রকল্প এখন গলার কাঁটা

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৩৫ পিএম
আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০০ পিএম
স্বপ্নের মেগা প্রকল্প এখন গলার কাঁটা
ব্যয়বহুল মেগা প্রকল্পগুলো এখন হয়ে গেছে গলার কাঁটা।

কথা ছিল এ বছরের অক্টোবরে অর্থাৎ চলতি মাসেই ‘স্বল্প পরিসরে’ চালু হবে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কার্যক্রম। তবে কার্যক্রম শুরু হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো বিগত সরকারের এই মেগা প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করতে ২০২৬ সাল লাগতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশাল অঙ্কের বাজেটের এ প্রকল্পের বিদেশি ঋণ পরিশোধের কিস্তি শুরু হবে আগামী ডিসেম্বর থেকেই। তাই সাধারণ মানুষকে স্বপ্ন দেখানো এ মেগা প্রকল্পই যেন এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

২০২৩ সালের অক্টোবরে তাড়াহুড়ো করে বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের সফট ওপেনিং (একাংশের উদ্বোধন) করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন জানানো হয়েছিল, ২০২৩ সালের শেষে পরীক্ষামূলকভাবে আর ২০২৪ সালের শেষ ভাগে পুরোদমে শুরু হবে টার্মিনালের কার্যক্রম। পরে গত ৩০ মে সরেজমিন পরিদর্শন গিয়ে তৎকালীন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান বলেছিলেন, তৃতীয় টার্মিনাল চলতি বছরের শেষ দিকে বা আগামী বছরের শুরুতে স্বল্প পরিসরে চালু হবে। ওই সময় পর্যন্ত টার্মিনাল ভবনের ৩ শতাংশের মতো কাজ বাকি আছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।

বলা হয়েছিল, অত্যাধুনিক এই টার্মিনালে থাকবে যাত্রীদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা, যা দেশের এভিয়েশন খাতের চিত্রই পাল্টে দেবে। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গেই যেন বেরিয়ে আসছে প্রকল্পের পদে পদে পরিকল্পনার ভুল আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা। নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে থাকলেও প্রথমে অর্থসংকট এবং এখন চুক্তিগত নানা জটিলতা আর দক্ষ জনবলের অভাব দেখিয়ে টার্মিনালটির কার্যক্রম শুরু হওয়া পেছাতে পেছাতে এখন ঠেকেছে ২০২৬ সালে। 

বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্প নিয়ে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটি বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) সঙ্গে একটি চুক্তি করে। টার্মিনালটি পরিচালনা-রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজরি সার্ভিস ও ভেন্ডরের নাম সুপারিশ করার কথা ছিল আইএফসির। টার্মিনালটি পরিচালনার বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়নি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি। এ কারণে পরিচালন ব্যয় নির্ধারণে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) চুক্তিও করা যায়নি। 

এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা এ প্রকল্পের শুরু থেকেই বলে এসেছি বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে প্যারালালি টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম কীভাবে নির্ধারিত সময়ে শুরু করা যাবে, সে কাজগুলো যেন করা হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা শোনেনি। তারা বিল্ডিং নির্মাণে জোর দিয়েছে, কিন্তু এই যে পিপিপি চুক্তি করা, দক্ষ জনবল তৈরি করার জন্য কে কাজ করবে সেসব ঠিক করা, এগুলোতে জোর দেয়নি। ফলে এখন বিল্ডিং তৈরি হয়েছে, কিন্তু তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আবার যদি এখন তাড়াহুড়ো করে অদক্ষ জনবল বা অদক্ষ প্রতিষ্ঠানের হাতে এই টার্মিনালের কার্যক্রম পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে বিশ্বে আমাদের সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ফলে এই টার্মিনাল দিয়ে যে আমরা আমাদের সেবার মান উন্নত হয়েছে, এটা দেখিয়ে যে একটি বাজার তৈরি করতে চাচ্ছিলাম তা ব্যাহত হবে। আবার এটিকে এভাবে ফেলে রাখলে যদি ভালোভাবে মেইনটেইন না করা হয়, তবে এখানে যেসব যন্ত্রাংশ সেট করা হয়ছে, সেগুলো নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।’ 

২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকায় তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৫ হাজার ২৫৮ কোটি ৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। বাকি ১৬ হাজার ১৪১ কোটি ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে জাইকা। যে ঋণ পরিশোধের প্রথম কিস্তি আগামী ডিসেম্বর থেকেই দিতে হবে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘পরিকল্পনার শুরু থেকেই কার্যক্রম কীভাবে চলবে তা নিয়ে প্যারালালি কাজ করা প্রয়োজন ছিল। কারণ এই প্রকল্পের একটি বড় টাকা জাইকার কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে, যার কিস্তি আমাদের এ বছরের ডিসেম্বর থেকেই দেওয়া শুরু করতে হবে। কিন্তু প্রকল্প নিয়ে এখন যা হচ্ছে তাতে ডিসেম্বরে এখান থেকে কোনো টাকা তো আসা সম্ভবই না, বরং এটির মেনটেন্যান্সের জন্য সরকারকে টাকা গুনতে হবে। না হলে যা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোও নষ্ট হওয়ার শঙ্কা আছে। পাশাপাশি ঋণের কিস্তির বোঝা তো আছেই।’

থার্ড টার্মিনালের কাজ কতটা শেষ হয়েছে এবং কবে কার্যক্রম শুরু হতে পারে- এমন প্রশ্নের উত্তরে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘কাজ ৯৮ দশমিক ৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। থার্ড টার্মিনালের অপারেশন ও মেইন্টেন্যান্স কে করবে, আমরা এ সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছি। উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে দফায় দফায় মিটিং হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যত দ্রুত কাজ শুরু করা যায়।’ অপারেশন ও মেইন্টেন্যান্স করার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হলেই মূলত কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যাবে। তবে অপারেশন শুরু করতে করতে সামনের বছরটা অর্থাৎ ২০২৫ সাল চলে যাবে বলেও মনে করছেন তিনি।

বেবিচক জানায়, পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পর জনবল নিয়োগ করতে হবে, তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এরপর ট্রায়াল শুরু হবে, প্রণয়ন করা হবে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি)। সব মিলিয়ে প্রক্রিয়াটা অনেক দীর্ঘ। টার্মিনালে ৬ ঘণ্টা করে চার শিফটে মোট ছয় হাজার লোক কাজ করবেন। এর মধ্যে র‍্যাব-পুলিশ, এভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক), এপিবিএন, আনসার, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যসহ নিরাপত্তা রক্ষাতেই কাজ করবেন প্রায় চার হাজার সদস্য। তাদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও কাজের জন্য প্রস্তুত করতেও প্রায় এক বছর সময় লাগবে।

এর আগে এ প্রকল্পের শেষ কিস্তির অর্থছাড়ে জটিলতা দেখা দিলে গত ১ জুলাই থার্ড টার্মিনালের প্রকল্প পরিচালক-পিডি এ কে এম মাকসুদুর ইসলাম একটি চিঠি পাঠিয়েছেন বেবিচককে। সেখানে বেবিচকের কাছে ১৫০ কোটি টাকা ঋণ চাওয়া হয়েছে প্রকল্পটির জন্য। সেই চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রকল্পকাজের স্বার্থে ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরের বাজেট বরাদ্দের বিপরীতে জিওবি খাতে বরাদ্দ করা তহবিল পাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ে প্রকল্পের আয়কর ও ভ্যাট এবং আমদানি করা মালামালের কাস্টম ডিউটি পরিশোধের জন্য ১৫০ কোটি টাকা ঋণ প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল থেকে এই ঋণ দেওয়ার জন্য এ চিঠি দেওয়া হয়েছে।

বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঋণের অর্থ ছাড় করে বেবিচক। অর্থাৎ সে হিসেবে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা সম্পূর্ণ অর্থই প্রকল্পে চলে গেছে এবং তাদের কাজ শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় সব কেনাকাটাই শেষ হয়েছে। ফলে অর্থসংকটের কোনো বিষয় নেই এখন। 

এতকিছুর পরও প্রকল্পটির সুবিধা পেতে এত দেরির বিষয় উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের মেগা প্রকল্প হওয়ার পরও কেন এ প্রকল্পের শুরু থেকেই এর পরিকল্পনায় আয়-ব্যয় নির্ধারণ এবং এর কার্যক্রম নির্ধারিত সময়ে শুরু করার বিষয়ে কেন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, সে বিষয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন এবং যারা গাফিলতি করেছেন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার দাবিও জানান তারা। বলেন, এর জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি হওয়া প্রয়োজন। যেখানে বেবিচকসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিশিষ্টজনরা থাকবেন। তারা মূলত এই প্রকল্পের বিভিন্ন ভাগের যারা দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনবেন। তাহলে হয়তো এর কার্যক্রম শুরু ত্বরান্বিত হতে পারে।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বর্তমানে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনাল দিয়ে বছরে প্রায় ৮০ লাখ যাত্রী বহনের ধারণক্ষমতা রয়েছে। ৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটারের তৃতীয় টার্মিনালটি যুক্ত হলে বছরে ২ কোটি পর্যন্ত যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। টার্মিনালটিতে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্কিং করা যাবে। ১৬টি ব্যাগেজ বেল্টসহ অত্যাধুনিক সব সুবিধা রয়েছে নতুন এ টার্মিনালে।