![পর্যাপ্ত সরবরাহ, কমছে না দাম](uploads/2024/01/16/1705421450.Bazar.jpg)
রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি বাজার থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মোকামেও পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে ধান, চাল, আলু, পেঁয়াজ, ডাল, ছোলা। বিভিন্ন মিলেও তেল এবং চিনির কোনো ঘাটতি নেই। তারপরও ভোটের পর থেকে এসব নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে। এসব পণ্যের দাম বাড়ায় ভোক্তাদের নাভিশ্বাস শুরু হলেও কেউ এর দায়ভার নিচ্ছেন না। চলছে পারস্পরিক দোষারোপ।
খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পাইকারি ও আড়তদাররা বাড়িয়ে দিচ্ছেন দাম। অপরদিকে পাইকারি ও আড়তদাররা দুষছেন খুচরা ব্যবসায়ীদের। কেউ বলছেন, শীতের কারণে উৎপাদন কমে গেছে। আমদানিকারকরা বলছেন, এখনো ডলার সংকট বিদ্যমান। সহজে খোলা যাচ্ছে না এলসি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমনই তথ্য জানা গেছে।
গতকাল সরেজমিনে গেলে রাজধানীর কৃষি মার্কেটে দেখা যায় দুই শতাধিক আড়ত চালের বস্তায় ঠাসা। নতুন ধান ওঠায় এসব দোকানে চালের সরবরাহ বেড়ে গেছে। তারপরও চালের দাম চড়া। দামের ব্যাপারে বিক্রেতারা বলছেন, মিল থেকে বাড়ানো হচ্ছে দাম। তাই কমছে না। এ ব্যাপারে প্রত্যাশা রাইস এজেন্সির মো. শিপন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভোটের পরে প্রতি বস্তায় ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রশিদসহ ভালো কোম্পানির চালের দামও বেড়েছে।’ একই সুরে কথা বলেন বিক্রমপুর স্টোরের রিপন। তিনি বলেন, ‘মিল থেকে বাড়ার কারণে আমাদের বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। এ জন্য বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে।
মিলমালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। এ ব্যাপারে রশিদ গ্রুপের কর্ণধার ও বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাঁসকিং মিলমালিক সমিতির সভাপতি আ. রশিদ এ প্রতিবেদককে বলেন, ভোটের পরে প্রতি বস্তা চালে ১৫০ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। ভোটের সময় ধানের সংকটের কারণে দাম বেড়ে গিয়েছিল। তবে গতকাল মঙ্গলবার বস্তায় ৫০-১০০ টাকা কমানো হয়েছে। কাজেই বাজার যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থায় আবার ফিরে যাবে। ভয়ের কিছু নেই। চালের সরবরাহ বাড়ায় দাম কমে আসছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা মজুতদারি বাড়াইনি। কর্পোরেটরা বাড়াতে পারে। কারণ তাদের অনেক টাকা। আমরা অর্থসংকটে আছি। সরকার অভিযান করলে ভালো। কারণ নজরদারি, তদারকি থাকলে আমরা সচেতন থাকব।
একই অবস্থা আলুর ক্ষেত্রেও। গতবছর এ সময়ে আলুর দাম অনেক কম ছিল। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বাজারেই আলুর সরবরাহ অনেক বেড়ে গেছে। কারওয়ান বাজারে দেখা যায়, আড়ত থেকে শুরু করে পাইকারি পর্যায়ে আলুর সরবরাহ প্রচুর। কিন্তু বছরের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণের বেশি দাম ৫৫-৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। বেশি দাম কেন জানতে চাইলে বিক্রমপুর ভাণ্ডারের মো. সবুজ এ প্রতিবেদককে বলেন, আগের চেয়ে দাম অনেক কমেছে। ৪০-৪২ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি করা হচ্ছে। সরবরাহ আগের তুলনায় অনেক বাড়ায় কমছে দাম। কিন্তু গতবারের তুলনায় অনেক বেশি কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৫ দিন সিজন পিছিয়েছে। এবার বীজের দামও ছিল বেশি। তাই প্রতি বিঘায় খরচও বেশি পড়েছে। তাই দাম বাড়তি।
পেঁয়াজেও ঝাঁজ কম নয়। এই পণ্যটিও রক্ষা পাচ্ছে না বেশি দামের ঝক্কি থেকে। গতবছর এই সময়ে ৩৫-৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে সরবরাহ পর্যাপ্ত হলেও দ্বিগুণের বেশি দামে ৮০-৯০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। কারওয়ান বাজারের সাগর বলেন, বেশি দামে কেনা। তাই প্রতি কেজি ৮০-৯০ টাকা বেচতে হচ্ছে।
খুচরা পর্যায়ে এত বেশি হলেও আড়তে দাম কম বলে জানান শ্যামবাজারের আড়তদার ও শ্যামবাজার কৃষিপণ্য মালিক সমিতির সহসভাপতি আ. মাজেদ। তিনি বলেন, পেঁয়াজের দাম কমেছে। ৫০-৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। মোকাম থেকে দাম বেঁধে দেওয়া। আমরা শুধু কমিশন পাই। রসুনের দাম বেড়েছে। দেশের বাইরেও বেশি দাম। ডলারসংকটের কারণে আমদানিতে সমস্যা আছে।
কয়েক বছর ধরে আমদানি করা হয় এমন কয়েকটি জরুরি পণ্যের বাজার গুটিকয়েক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ জন্য কোনো কারণ ছাড়াই তারা দাম বাড়াচ্ছে। কয়েকটি কর্পোরেটও নিয়ন্ত্রণ করছে এসব বাজার। এরই অংশ হিসেবে ডিমের দামও ডজনে বেড়ে গেছে ১০ টাকা পর্যন্ত। টাউনহল বাজারের কামাল ডিম আড়তের কামাল বলেন, ভোটের পর ডিমের ডজনে দাম বেড়েছে ১০ টাকা। আগে কম দামে বিক্রি করা হলেও বর্তমানে ১২৫-১৩০ টাকা ডজন। অন্যান্য বাজারেও বেশি দামে ডিম বিক্রি করা হচ্ছে বলে বিক্রেতারা জানান।
তেজগাঁও ডিম আড়ত সমিতির সাবেক সভাপতি আমান উল্লাহ বলেন, ঠাণ্ডা বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন কমে গেছে। তাই কয়েক দিনের ব্যবধানে ১০০ ডিমে ২০-৩০ টাকা বেড়ে গেছে। বর্তমানে ১০০ পিস ডিম ৯৪০-৯৯০ টাকা।
বিভিন্ন দোকানে থরে থরে সাজানো রয়েছে সয়াবিন তেলের বোতল। তারপরও স্বস্তির খবর নেই। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়েক দিন আগে বাড়ানো হয়েছে তেলের দাম। আল অমিন স্টোরের আনোয়ার জানান, তীর, রূপচাঁদাসহ অন্য কোম্পানির লোকেরা বলে গেছেন, আবারও বাড়বে তেলের দাম। বিভিন্ন কোম্পানির ডিলারসহ খুচরা দোকানেও বস্তা ও আটার প্যাকেটের সরবরাহ প্রচুর। কিন্তু দাম কমে না। এখনো ২ কেজির প্যাকেট আটা ১২৫-১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ভোটের আগে অনেক খুচরা ব্যবসায়ী বলেছিলেন, চিনি নেই। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন বাজারের অনেক দোকানেই চিনি পাওয়া যাচ্ছে। তবে দাম ১৪০-১৫০ টাকা কেজি। কারওয়ান বাজারের আল্লাহর দান স্টোরের শাহ আলম বলেন, চিনি পাওয়া যাচ্ছে। তবে দাম বেশি। ১৪০ টাকা কেজি, খোলাটা ১৪৫ টাকা। বেশির ভাগ দোকানে ছোলার সরবরাহও অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু সরবরাহ বাড়লেও দাম চড়ে গেছে। ভোটের আগে ৮৫-৯০ টাকা কেজি ছিল। বর্তমানে ১১০-১২০ টাকা কেজি হয়ে গেছে।
সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপসহ অনেকের ম্যাটেরিয়াল আমদানি করে পরিশোধন করে। সয়াবিন তেল, চিনি এবং গম আমদানি করে তারা বাজারে আটা বিক্রি করে। বর্তমানে এসব পণ্যের সরবরাহও বেড়েছে আগের চেয়ে। কিন্তু দাম কমেনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ঘোষণা দিয়ে তেল, চিনির দাম বাড়ানো হয়। কে কি বলল, সেটা দেখার বিষয় নয়। সামনে রমজান মাস। তাই এ মুহূর্তে আমাদের তেল, চিনি, আটার দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। যে দাম আছে, সেই দামই থাকবে। কমবে না, বাড়বে না। এসব পণ্য আমদানিনির্ভর, এ জন্য বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয়। এখনো ডলারসংকট আছে। এটা স্বাভাবিক হলে দামও কমে যাবে।’
সার্বিক ব্যাপারে জানতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ব্যস্ত থাকায় কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই খাদ্যদ্রব্যের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে মিটিং হয়েছে।’ সব কিছু জানার চেষ্টা করেছেন নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী। আশা করি, এর একটা সুফল পাওয়া যাবে। সবাই সহযোগিতা করলে বাজার স্থিতিশীল হবে।