![বিদ্রোহীদের শক্তি বাড়লে জটিল হতে পারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন](uploads/2024/02/10/1707538526.Rohingga.jpg)
মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা দখলে নিচ্ছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীর এই লড়াই ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে। রাখাইনে আগের তুলনায় বিদ্রোহীদের জোরালো উপস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের গতি কোন পথে যাবে তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। এ অবস্থায় আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বসছে রোহিঙ্গাবিষয়ক ন্যাশনাল টাস্কফোর্সের বৈঠক।
আরাকান আর্মি বলছে, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খারাপ নয়। তবে ভালোও নয়। বাংলাদেশের সরকার আমাদের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক রাখতে চায়, সেটা স্পষ্ট নয়।’
বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যবাাসন নিয়ে আলোচনা অনেকটা থমকে গেছে। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে ন্যাশনাল টাস্কফোর্সের মিটিং। সেই মিটিংয়ে বিষয়গুলো নিয়ে হয়তো আলোচনা হবে।’
রাখাইন রাজ্যটির আগের নাম আরাকান। আরাকানের নাম বদল হলেও আগের নাম অনুযায়ী জনগোষ্ঠীর নাম আরাকানি। এরা থেরোবাদী বৌদ্ধ। এই বৌদ্ধরা মায়ানমারের মূল ভূখণ্ডের বৌদ্ধদের থেকে নিজেদের আলাদা বলে দাবি করে। ভূখণ্ডটি আরাকান পর্বতমালা দিয়ে মায়ানমারের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটাই আলাদা।
রাখাইন রাজ্যে লড়াইরত দুই পক্ষই রোহিঙ্গাদের নিজেদের জাতিভুক্ত বলে মনে করে না। আরাকান তথা রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধরা সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর ক্ষুব্ধ। তাদের নেতৃত্বেই ২০১২ সালে রাখাইনে দাঙ্গা সৃষ্টি করে মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরাও মনে করে না যে, রোহিঙ্গারা মায়ানমারের নাগরিক। মায়ানমারের জান্তা সরকার স্বীকার করে না যে, রোহিঙ্গা মুসলিমরা সে দেশের নাগরিক।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এমনিতেই সেখানে প্রত্যবাসনের অনুকূল পরিবেশ নেই তারপর এখন এই গৃহযুদ্ধ অনিশ্চয়তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।’
বছর দুয়েক আগে হংকংভিত্তিক গণমাধ্যম এশিয়া টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আরাকান আর্মির কমান্ডার-ইন চিফ থোয়ান ম্রা নাইং বলেন, ‘আরাকানের সব বাসিন্দার মানবাধিকার ও নাগরিকত্বের অধিকার আমরা স্বীকার করি। তবে শরণার্থীরা যে নামে নিজেদের পরিচয় নির্ধারণ করতে চায়, তা নিয়ে অধিকাংশ আরাকানির বড় ধরনের আপত্তি রয়েছে। রোহিঙ্গা পরিভাষাটা আরাকানের অধিকাংশ জনগণ মেনে নিতে চায় না। এ পরিভাষাটিকে তারা আপত্তিকর মনে করে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সঙ্গে আরাকান আর্মির কোনো সম্পর্ক নেই।’
আরাকান আর্মির কমান্ডার-ইন চিফ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ নয়। তবে এখনো এতটা ভালোও বলা যাবে না। বাংলাদেশ সরকার আমাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে কীভাবে সম্পর্ক রাখতে চায়, তা নিয়ে তাদের কোনো নীতি বা কৌশল এখনো আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাখাইন অঞ্চলে জান্তা সরকারকে হটিয়ে দিয়ে আরাকান আর্মি যদি শক্ত অবস্থান নেয়, তাহলে রোহিঙ্গা সংকটের জন্য ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যেকোনো কিছুই হতে পারে। তবে পরিস্থিতি জটিল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বেইজিংয়ে সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ বাড়াতে হবে। কারণ মায়ানমারের জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মিসহ বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক ভালো।’
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে মায়ানমারের জান্তা সরকারের ভালো সম্পর্ক হলেও বিদ্রোহী সব জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। শুধু সীমান্তকেন্দ্রিক কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে ভারতের।’
ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) একটি নিবন্ধে বলা হয়, “সম্প্রতি আরাকান আর্মির শীর্ষ নেতৃত্ব রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছে। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের শত্রু হিসেবে দেখে না। যদিও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে না আরাকান আর্মি।”
এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। খবরের কাগজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, ‘প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কোনো একটি দেশের সঙ্গে কথা বলা ঠিক হবে না। চীন ও ভারতের পাশাপাশি আসিয়ান জোটভুক্ত দেশ এবং জাপানের সঙ্গেও বাংলাদেশের যোগাযোগ বাড়াতে হবে।’