বাবা ঠিকাদার হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই বিলাসী জীবনযাপন ছিল নাটোর-২ (সদর-নলডাঙ্গা) আসনের সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের। বাড়ি নাটোর শহরে হওয়ায় ছাত্রজীবনেই জেলা ছাত্রলীগে ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক পদ দিয়ে শুরু হয় নেতৃত্ব। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কাউন্সিলের মাধ্যমে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। ২০০৮ সালে তিনি নাটোর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন। ২০১৪ সালে নির্বাচিত হন নাটোর-২ (সদর-নলডাঙ্গা) আসনের এমপি। ২০১৮ ও ২০২৪ সালেও এমপি হন শিমুল। পাশাপাশি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদেও আসীন হন তিনি। এতে তার শক্তি ও ক্ষমতা দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
নাটোরের রাজনৈতিক-সচেতন মহলের দাবি, একসময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রেনে উঠে নাটোর রেলস্টেশনে নেমে রাজনৈতিক সমাবেশ করতে চাইলে সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু তা প্রতিরোধ করেন। ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা নাটোরে আওয়ামী লীগের শক্ত নেতৃত্ব চান, যাতে দুলু নাটোরে টিকতে না পারেন।
এমপি শিমুল শেখ হাসিনার ওই মনোভাব জানতেন। তাই তিনি দুলুমুক্ত নাটোর ঘোষণা করেন এবং তা বাস্তবায়নও করেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের আগ পর্যন্ত শিমুল নাটোর বিএনপি-জামায়াতমুক্ত রাখতে পুলিশি ও রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহারে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি। ওই একটি কারণেই শেখ হাসিনা বারবার শিমুলকে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছেন।
তবে শেখ হাসিনার মাধ্যমে বারবার এমপি মনোনয়ন পেলেও জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবার, স্বজন ও পছন্দের মানুষদের বসানো, জেলার আর্থিকভাবে লাভবান প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব বলয়ের মানুষকে বসানো, নিজ পছন্দের মানুষদের নেতৃত্বে দল ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠন ইত্যাদি কারণে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং অন্য এমপিসহ জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের একাংশের প্রতিপক্ষে পরিণত হন শিমুল।
এরই ধারাবাহিকতায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ হারাতে হয় শিমুলকে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ ও শিমুলের কাছের মানুষদের দাবি, দীর্ঘ ১৬ বছর জনপ্রতিনিধি থাকার সুবাদে অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন। নাটোরে এক রাজকীয় বাড়ি, কানাডায় বাড়ি, জমি, প্লটসহ কোটি কোটি টাকার ব্যাংক-ব্যালান্স রয়েছে শিমুলের। পাশাপাশি তার পরিবার, স্বজন ও পছন্দের কিছু মানুষও দুর্নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন। তবে শিমুল ও তার স্বজনরা এসব দাবি অস্বীকার করেছেন।
তথ্যমতে, ২০০৮ সালে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় ঠিকাদারি করে বছরে ২ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছিলেন শফিকুল। তখন সব মিলিয়ে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল সাড়ে ১৪ লাখ টাকার মতো। স্ত্রীর সম্পদ ছিল সাড়ে ৪ লাখ টাকার কিছু বেশি। ওই সময় তাদের কোনো গাড়ি ছিল না। নিজ নামে কোনো বাড়িও ছিল না।
২০১৩ সালের হলফনামায় শিমুল নিজের নামে ১১ লাখ ও স্ত্রীর নামে ৫১ লাখ টাকার হিসাব দেখান। ২০১৮ সালে দুজনের নামে মোট সম্পদ দেখান ৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
২০১৮-১৯ সালে তিনি ২ কোটি ১৪ লাখ টাকা আয় দেখালেও পরের বছর ওই আয় দেখানো হয় ১৬ লাখ টাকা। দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হওয়ার পর পরই শহরের কান্দিভিটুয়া পিটিআই রোডে ‘জান্নাতি প্যালেস’ নামে বিশাল বাড়ি করেন। ২৮ শতক জমির ওপর নির্মিত বাড়িটি দেখতে রাজপ্রাসাদের মতো, যা নির্মাণে ৩ কোটি টাকা খরচের দাবি করেন স্থানীয়রা। ২০২০-২১ অর্থবছরে তার সম্পদ বেড়ে হয় ৪ কোটি ২২ লাখ টাকারও বেশি।
জানা যায়, কানাডার ব্যাংকে শিমুলের দুটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি কানাডার ব্যাংকের অ্যাকাউন্টগুলোতে টাকার পরিমাণ ছিল ৬১ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি টরন্টোতে পাঁচ বেড, পাঁচ বাথরুম ও তিনটি পার্কিংসহ ওই বাড়িটি কেনেন প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকায়।
২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামা অনুসারে তার বার্ষিক আয় প্রায় ৫৩ লাখ ৩ হাজার ১০৯ টাকা। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৪ কোটি ৯৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা। অর্থাৎ দেড় দশকে তার সম্পদ বেড়েছে ৩৪ গুণের বেশি। একই সময় স্ত্রীর সম্পদ ১৬৩ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা। আগে তার স্ত্রীর কোনো আয় ছিল না। তবে এখন আয় বছরে ২৮ লাখ ২৮ হাজার ৩৬০ টাকা।
জেলা আওয়ামী লীগের একাংশের দাবি, নাটোর ও কানাডায় স্ত্রী জান্নাতির নামে বাড়ি ছাড়াও দেশ-বিদেশের ব্যাংকে রয়েছে কোটি কোটি টাকা। আয়কর রিটার্নে জান্নাতিকে গৃহবধূ উল্লেখ করলেও ব্যবসা থেকে তার আয় বেড়েছে- এমন দাবি করতেন শিমুল। তবে কী ব্যবসা তা প্রকাশ করেননি।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হয় শিমুলের নাটোরের বাড়ি। সঙ্গে তিনটি পাজেরো গাড়ি। ওই দিনই আত্মগোপনে যান শিমুল, তার পরিবারের সদস্যরা, স্বজন ও আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী নেতারা।
ওই দিন সকালেও ‘নাটোরের রাজপথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে ব্যস্ত ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল। ওই দিন বিকেলেই তিনি আত্মগোপনে যান। এরপর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা শহরের কান্দিভিটুয়া মহল্লায় ‘জান্নাতি প্যালেস’ নামে তার প্রাসাদোপম বাড়িতে হামলা চালান। ভাঙচুর, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগে ধ্বংসস্তূপে পরিণত বাড়িটি দেখতে এখন প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সেখানে আসেন। ওই সময় আগুন দেওয়া হয় শিমুলের বাড়ির পাশে তার ভাই সাগরের বাড়িও।
এদিকে দুদক সূত্রে জানা যায়, অর্থ পাচারের মাধ্যমে কানাডায় বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ২ সেপ্টেম্বর শিমুলের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
জানা যায়, দুদকের কমিশন সভায় সাবেক এই এমপির দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, শফিকুল ইসলাম শিমুলের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, প্রকল্পে অনিয়মসহ দেশে-বিদেশে বিপুল অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের তথ্য আমলে নিয়ে কমিশন তার দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শিমুলের নামে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে অর্থ পাচার করে কানাডায় বাড়ি কেনার অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে বলে দুদকসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
আরও জানা যায়, গত ১৫ আগস্ট শফিকুল ইসলাম শিমুল এবং তার স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতির ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ।
দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের তথ্যমতে, কানাডার টরন্টোর নিকটবর্তী স্কারবরো শহরে তার নামে একটি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, শিমুল সংসদ সদস্য হওয়ার পরই নাটোরে জান্নাতি প্যালেস নির্মাণ করেন। এ ছাড়া স্থানীয় ভেদরার বিলে তিনি ১৬ বিঘা জমি কিনেছেন। নাটোরের নীচাবাজার এলাকায়ও রয়েছে প্লট।
গত নির্বাচনের আগে নাটোরের কয়েকজন নেতা দলীয়প্রধানের কাছে শিমুলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয়, ঢাকার আদাবর রিং রোডে স্ত্রী, শাশুড়ি ও ভগ্নিপতির নামে পাঁচটি ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, মালেয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে নামে-বেনামে তার সম্পদ রয়েছে।
শিমুলের অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের বিষয়টি অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন মহলে আলোচনায় আছে। গত বছর এ ব্যাপারে শিমুলের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, সবই ‘অপপ্রচার’। যা কিছু দেখা যাচ্ছে, তা তার বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ ও ঠিকাদারি ব্যবসা থেকে করা। তিনি আরও দাবি করেছিলেন, তার স্ত্রী ব্যবসা করেন। কী ব্যবসা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব তো বলা যাবে না। ট্যাক্স ফাইলে সব বলা আছে।’ তিনি ওই সময়ে আরও দাবি করেন, তার পরিবার কানাডায় থাকে। পরিবারের খরচের প্রয়োজনীয় টাকা তিনি বৈধভাবেই পাঠান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দাবি, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন শফিকুল ইসলাম শিমুল। নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে তিনি পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মামলা-হামলার মাধ্যমে হয়রানি করেছেন। নিজ দলের প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতা-কর্মীরাও তার নির্যাতন থেকে বাদ যাননি। দলের সিনিয়র ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে দলীয় পদে বসিয়েছেন নিকটাত্মীয় ও বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে।
জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শফিকুল ইসলামের আয়ের মূল উৎস ছিল বিভিন্ন প্রকল্প থেকে কমিশন গ্রহণ, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ-বাণিজ্য, পরিবহনে চাঁদাবাজি, সরকারি প্রণোদনা ও টিআর-কাবিখার লোপাট করা অর্থ।
জেলা আওয়ামী লীগের এক পদবঞ্চিত সাবেক নেতার দাবি, ২০১৫ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার আগ পর্যন্ত শফিকুলের পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন না। ওই বছর তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। তখনই তিনি তার স্ত্রী শামীমা সুলতানাকে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, বড় ভাই শরিফুল ইসলামকে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, বড় ভাবি সীমা পারভিনকে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, ভাই সিরাজুল ইসলামকে পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, আরেক ভাই সাজেদুল আলমকে জেলা যুবলীগের সদস্য, ভাইয়ের স্ত্রী সিনথিয়া ইসলামকে জেলা যুব মহিলা লীগের সহসভাপতি, বোন নাছিমা রহমানকে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ভগ্নিপতি সাজেদুর রহমান ওরফে বুড়া চৌধুরীকে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, বোন নাজলী রহমানকে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, দুলাভাই আমিরুল ইসলাম জাহানকে জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ, ভাগনে নাফিউল ইসলামকে পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক, বোনের দেবর খন্দকার ওমর শরীফ চৌহানকে জেলা আওয়ামী লীগের সমাজ কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক পদে বসান।
তার অভিযোগ, জেলা বিএনপি ও জামায়াতের অনেকে শিমুলের হাত ধরে আওয়ামী লীগে পুনর্বাসিত হন।
জেলার এক ঠিকাদার জানান, শফিকুল তার ভগ্নিপতি মীর আমিরুল ইসলাম ওরফে জাহানের মাধ্যমে ঠিকাদারি খাত নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমপির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপে আমিরুল ইসলাম ও তার দুই ভাই ২০১৪ সালের পর থেকে প্রায় ৩৮০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ পেয়েছেন।
জেলা মৎস্যজীবী লীগের এক নেতার দাবি, শিমুলের ভগ্নিপতি সাজেদুর রহমান ওরফে বুড়া চৌধুরী আগে থেকেই সরকারি জলাশয় ইজারা নিয়ে মাছ চাষের ব্যবসা করতেন। শ্যালক সংসদ সদস্য হওয়ার পর বেশির ভাগ সরকারি জলাশয় তার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের এক নেতা দাবি করেন, শিমুলের ছোট ভাই সাজেদুল ইসলাম ২০১৬ সালে অনেকটা জোর করেই পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হন। তার মাধ্যমে পরিবহন খাত থেকে বিপুল চাঁদা উঠত, যার বড় অংশ পেতেন শিমুলও।