ঈদের পর মানুষ এখনো পুরোপুরি বাজারমুখী হননি। তার পরও ভরা মৌসুমে কমছে না পেঁয়াজের দাম। আগের মতোই খুচরা বাজারে ৬০-৬৫ টাকায় কেজি বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। তাদের অভিযোগ, মোকামে বেপারিরা ইচ্ছামতো পেঁয়াজ ও আলুর দাম আদায় করছেন। এ জন্য পেঁয়াজ, আলুর দাম কমছে না। আলুর ভরা মৌসুমেও কেজি ৫০-৫৫ টাকা। তাদের না ধরলে কমবে না দাম, বরং আরও বাড়বে। তবে ঈদের পর চাহিদা কম থাকায় মুরগি, গরুর মাংস, বেগুন, করলা, পটোলসহ সবজির দাম কমেছে। আগের মতোই অপরিবর্তিত ডিমের ডজন ১১০-১২০ টাকা। সরকার চালের বাজারের সিন্ডিকেট ঠেকাতে পয়লা বৈশাখ থেকে চালের মূল্য, ধানের জাতসহ সাত তথ্যযুক্ত চালের বস্তা রাইস মিল থেকে সরবরাহের নির্দেশনা দিলেও বাজারে তার বালাই নেই। এখনো পুরোনো বস্তায় ৭০-৭৫ টাকা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে। সোমবার (১৫ এপ্রিল) রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঈদের ছুটি শেষে এখনো জমে ওঠেনি রাজধানীর বাজারগুলো। ব্যবসায়ীরা বাড়ি থেকে না আসায় অনেক দোকান এখনো বন্ধ। তবে বেশির ভাগ দোকানই খোলা ছিল। কিন্তু ক্রেতার সমাগম খুবই কম ছিল। এর ফলে কোনো কোনো দোকানে বিক্রেতাদের ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায়। তারা বলেন, দাম কমলেও কাস্টমার নেই।
দামের ব্যাপারে জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা এরশাদ বলেন, ঈদের আগে কম থাকলেও দুই দিন থেকে পেঁয়াজের কেজিতে ৪-৫ টাকা বেড়েছে। আগে ৬০ টাকা কেজি বিক্রি করা হলেও বর্তমানে ৬৫ টাকা কেজি। তবে পাল্লা (৫ কেজি) ধরে নিলে দাম একটু কমের দিকে আছে। তা ৩০০ টাকা। কেজিতে ৬০ টাকা পড়বে। অন্য খুচরা বিক্রেতারাও বলছেন, মানভেদে ৬০-৬৫ টাকা।
এদিকে আলুর দামও ৫০-৫৫ টাকা কেজি বলে খুচরা বিক্রেতারা জানান। তারা বলেন, মোকাম থেকেই বাড়াচ্ছে দাম। এ জন্য পাইকারিতে বেশি। বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আড়তদারও বলছেন একই কথা। জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের বিক্রমপুর বাণিজ্যালয়ের হানিফ এ প্রতিবেদককে বলেন, এলাকাভেদে আলু ৪০-৪৪ টাকা কেজি; যা ঈদের আগে ৪০ টাকার কম ছিল। গত বছরে এই সময়ে আলুর কেজি অর্ধেক ২৫ টাকা ছিল। এত দাম কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে এই পাইকারি বিক্রেতা বলেন, ‘গোড়াতে ধরতে হবে। এত দাম বেশি হলেও আমরা বস্তায় (৬০-৬৫ কেজি) শুধু ৫০ টাকা কমিশন পাই। যা লাভ সব বেপারিরাই খাচ্ছেন। তারাই দাম নির্ধারণ করে দেন।
ভরা মৌসুমে এত বেশি হওয়ার কথা না। কিন্তু দাম তো মোকাম থেকে বেঁধে দিচ্ছে। তাদের না ধরলে আলুর দাম আরও বাড়বে। কারণ বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজে লাখ লাখ বস্তা আলু রয়েছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি করে আলু রাখছেন কোল্ড স্টোরেজে। এ সুযোগে বেপারিরা বেশি দাম নিচ্ছেন। তাতে আমাদের কোনো লাভ নেই।’
মোহাম্মদপুরের টাউনহল বাজারেও বেশি দামে আলু ও পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে বলে বিক্রেতারা জানান। দামের ব্যাপারে মিজানুর রহমান বলেন, ‘ভরা মৌসুমেও আলু, পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। অবাক লাগছে। তবে আগের মতোই আদার কেজি ২০০-২২০ টাকা, আমদানি করা রসুন ২০০ টাকা ও দেশি রসুন ১২০-১৩০ টাকা কেজি।’
এদিকে ধানের মৌসুমেও কমে না চালের দাম। বরং রমজান মাসেই কেজিতে ৫-৬ টাকা বেড়েছে। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে নতুন কর্মকৌশল হাতে নিয়েছে সরকার। ২১ ফেব্রুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চালের বস্তায় জাত ও মূল্যসহ সাত ধরনের তথ্য লিখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়, যা ১৪ এপ্রিল থেকে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। তা না মানলে জরিমানাসহ শাস্তির আওতায় আনা হবে। কিন্তু রাজধানীর কোনো বাজারে মানা হচ্ছে না এই নির্দেশনা। সরেজমিনে দেখা যায়, কোনো দোকানে চালের নতুন বস্তা আসেনি।
জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের হাজি রাইস এজেন্সির জহির খবরের কাগজকে বলেন, আগের বস্তার চালই বিক্রি করা হচ্ছে। সরকারের সাত তথ্যসংবলিত কোনো বস্তার চাল মিল থেকে আসেনি। প্রতি কেজি নাজিরশাইল মানভেদে ৭০-৮০ টাকা, মিনিকেট ৭২-৭৫, আটাশ চাল ৫৫-৫৮ ও মোটা চাল ৫০-৫২ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। অন্যান্য খুচরা চাল বিক্রেতারাও বলছেন, নতুন বস্তার কোনো চাল আসেনি। প্রাণ, আকিজের মতো নামিদামি ভালো মানের পোলাওয়ের প্যাকেট চাল ১৭০-১৮০ টাকা কেজি। তবে তাদের বস্তার চাল ১৪০-১৪৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
গরু ও খাসির মাংসের বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭৫০ টাকা করে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। তবে ৭৮০ টাকা কেজির মূল্যতালিকা ঝোলানো ছিল প্রায় দোকানে। ঈদের আগে কেজি ছিল ৮০০-৮২০ টাকা পর্যন্ত।
ঈদের সময় ১০০ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত খাসির মাংস বিক্রি হলেও বর্তমানে প্রতি কেজি খাসির মাংস ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজারের বিক্রেতারা জানান, ঈদ উপলক্ষে দাম কিছুটা বাড়ানো হয়েছিল। এখন আবার দাম কমে গেছে। কোরবানির আগে আর বাড়বে না।
গরুর মতো মুরগির দামও কেজিতে ৩০-৪০ টাকা কমেছে ঈদের পর। বর্তমানে ব্রয়লার মুরগি ২৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া সোনালি মুরগি কেজিতে ৫০ টাকা কমে ৩৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ান বাজারের জনপ্রিয় পোলট্রির জসিমসহ অন্য মুরগি বিক্রেতারা বলেন, ঈদে ঢাকায় মানুষ না থাকায় মুরগির চাহিদা কমে গেছে। যে কারণে দামও ঈদের পর কমে গেছে। তবে হোটেল, রেস্তোরাঁ, অফিস পুরোদমে খুললে চাহিদা বাড়বে। তখন দামও বাড়বে।
এদিকে চাহিদা না থাকায় কমেছে সবজির দামও। বর্তমানে প্রতি পিস ফুলকপি ২৫ টাকা, বাঁধাকপি ৩০, ঢ্যাড়শ ৪০-৫০ টাকা কেজি, করলা ৬০-৮০ টাকা, শিম ৪০ টাকা, পেঁপে ৪০-৫০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৩০ টাকা, টমেটো ৪০ টাকা, শসা ৪০ টাকা, ঝিঙে ৬০ টাকা, সজনে ডাঁটা ৮০-১০০ টাকা, বেগুন ৪০-৬০ টাকা, পটোল ৫০-৬০ টাকা, গাজর ৫০ টাকা, কাঁচা আম ১৪০ টাকা, বরবটি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। টাউনহল বাজার ও কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতারা বলেন, চাহিদা না থাকায় সবজির দাম কিছু্টা কমেছে। আবার কখন বাড়ে বলা যায় না।
বিভিন্ন দোকানে দেখা যায়, আগের মতোই ছোলা ১১০ টাকা কেজি, বেসন ১২০ টাকা, ১৬৩ টাকা লিটার সয়াবিন তেল, পাঁচ লিটার ৭৯০ টাকা, চিনি ১৪০ টাকা ও প্যাকেট চিনি ১৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মসলা ব্যবসায়ীরা বলেন, কিশমিশের কেজি ৫৮০-৭০০ টাকা কেজি, কাঠবাদাম ১ হাজার ১০০, দারুচিনি ৫৫০, লবঙ্গ ১ হাজার ৭০০ ও জিরার কেজি ৭৫০ টাকা।
গরমে বেড়েছে তরমুজের দাম
মানুষ রাজধানী ছাড়তে থাকায় রমজান মাসের শেষ দিকে দাম কমলেও ঈদ-বৈশাখের উৎসব ও চলমান তাপপ্রবাহের কারণে বেড়েছে তরমুজের চাহিদা। এ বাড়তি চাহিদার সুযোগে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে তরমুজের দামও অনেক বেড়ে গেছে। কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, মিরপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, ইব্রাহীমপুরে এই চিত্র দেখা গেছে। ঈদের আগে ঢাকার খুচরা বাজারে তরমুজের দাম ৩৫-৫০ টাকা কেজি হয়েছিল। কিন্তু গত রোববার থেকে বৈশাখী উৎসব শুরু হওয়ায় চাহিদা বাড়তে থাকে। এ জন্য তরমুজের কেজি ৫০-৬৫ টাকায় ঠেকে গেছে। কারওয়ান বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী সবুজ বলেন, ‘ঈদের আগে ৪০ টাকা কেজি দরে তরমুজ বিক্রি করেছি। কিন্তু ঈদের পর চাহিদা বাড়তে থাকায় পাইকারি দাম বেড়ে গেছে তরমুজের। এ জন্য খুচরা বাজারেও বেড়ে গেছে দাম।’