![গরম লোডশেডিংয়ে হাঁসফাঁস](uploads/2024/04/20/1713594970.loadshedding.jpg)
চলতি এপ্রিল মাসের প্রতিদিনই বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগের দিনের রেকর্ড হওয়া সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) চুয়াডাঙ্গা জেলায় রেকর্ড করা হয়েছে সাড়ে ৪১ ডিগ্রি, যা ২০২৪ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ। টানা তাপপ্রবাহের কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বাতাস। মাত্রাতিরিক্ত গরমে কাহিল জনজীবন। তাপপ্রবাহ থেকে সতর্ক থাকতে আবহাওয়া অধিদপ্তর সারা দেশে তৃতীয় দফায় হিট অ্যালার্ট জারি করেছে। বছরের উষ্ণ মাস হওয়ায় এপ্রিলজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে অতিরিক্ত গরমে বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে লোডশেডিং। তবে শহরের তুলনায় এই দুর্ভোগ গ্রামে বেশি। অনেক এলাকায় ৬-৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী দুই সংস্থা ডিপিডিসি ও ডেসকো জানিয়েছে, ঢাকায় সরবরাহ ঘাটতির কারণে লোডশেডিং হচ্ছে না। কারিগরি ত্রুটির কারণে কিছু কিছু এলাকায় বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎবিভ্রাট হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্র বলছে, দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট। গত বুধবার দিনের বেলায় সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। ওই সময়ে সরবরাহ ঘাটতি ছিল ২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি, যা লোডশেডিং দিয়ে পূরণ করা হয়েছে। এদিকে তাদের ধারণা এ বছর চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট ছাড়াতে পারে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে। বিদ্যুৎ বিভাগের এক হিসাবে দেখা গেছে, সারা দেশে এক ঘণ্টা লোডশেডিং করা হলে ৯৭৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎসাশ্রয় হয়। এ হিসাবে ২ হাজার মেগাওয়াট ঘাটতির জন্য ২ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং করতে হয়।
সারা দেশে ততৃীয় দফায় হিট অ্যালার্ট জারি
আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির খবরের কাগজকে বলেন, ‘গরমের কারণে বাতাস উত্তপ্ত। এ কারণে অনুভূতিটা বেড়েছে। তাপমাত্রা কমে এলে তখন আরামদায়ক পরিস্থিতি তৈরি হবে। আমরা আবারও ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট দিয়েছি। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রাজশাহী ও চুয়াডাঙ্গায় এটি অব্যাহত থাকবে। এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম। এ কারণে টানা তাপপ্রবাহ থাকবে। যেসব এলাকায় বৃষ্টিপাত হবে সেখানকার পরিবেশ সাময়িকভাবে সহনশীল হবে। কিন্তু খুব বেশি পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। কারণ এপ্রিল মাসটা বছরের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই বছর ধরেই গ্রীষ্ম মৌসুমে লোডশেডিংয়ে ভুগছে দেশবাসী। এবার পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। গরমে চাহিদা বাড়লেও জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। পাওয়ার সেলের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার ৬৭ মেগাওয়াট। এটা ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ। গত বছর ১৯ এপ্রিল সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। দেশে বর্তমানে গ্রাহকসংখ্যা ৪ কোটি ৬৬ লাখ। আর বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী শতভাগ।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মাদ হোসাইন বলেন, বিভিন্ন জেলায় তাপপ্রবাহ হচ্ছে। প্রতিবছর এই সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে। সে হিসেবেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, সমস্যা হবে না। চাহিদা অনেক বাড়লে কিছুটা ঘাটতি হতে পারে।
পিডিবির পরিচালক (জনসংযোগ পরিদপ্তর) মো. হাসান জানিয়েছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ও ফ্যানের ব্যবহার বেড়ে গেছে। বৃষ্টি হলে বা তাপমাত্রা কমে গেলে বিদ্যুতের বাড়তি চাপও কমে যাবে। বিদ্যুতের উৎপাদন ১৬ হাজার মেগাওয়াটে নেওয়ার জন্য পিডিবি চেষ্টা করছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় কয়েক দিন ধরে দেশে লোডশেডিং বেশি হচ্ছে। তবে তাপমাত্রা কমে এলে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হবে বলে জানান তিনি।
পিডিবির (উৎপাদন) বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। কয়লা থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদন করা হচ্ছে। এলএনজি টার্মিনাল চালু হলে গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে বিদ্যুৎ খাতে। তেলচালিত কেন্দ্রগুলোকে উৎপাদন বাড়াতে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে তিনি আশা করেন।
তবে ঢাকার বাইরে শহর এলাকায় লোডশেডিং তুলনামূলক কম বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা পিডিবি, নেসকো ও ওজোপাডিকো। ঢাকায় বিদ্যুতের ঘাটতি না থাকায় লোডশেডিং নেই বলে জানিয়েছে ডেসকো ও ডিপিডিসি। কারিগরি কারণে কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। গতকাল দিনে ডেসকোর সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট ও ডিপিডিসির চাহিদা ছিল ১ হাজার ৮৫০ মেগাওয়াট। পুরোটাই সরবরাহ পেয়েছে তারা। সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং করছে দেশের অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। এ সংস্থার দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। গত বুধবার দুপুরে তাদের বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। একই সময় তারা সরবরাহ পেয়েছে ৬ হাজার ১০০ মেগাওয়াট। মানে ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে আরইবির এলাকায়।
তবে বিতরণ সংস্থাগুলো বলছে, যেসব অঞ্চলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা বেশি, সেখানে সরবরাহ বেশি। এ কারণে বরিশাল অঞ্চলের গ্রাম এলাকায় লোডশেডিং নেই। সিলেটে গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বেড়েছে লোডশেডিং। কয়েক দিন ধরে দিনে দুই ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং হলেও মঙ্গলবার থেকে দিনের বেলা গ্রামে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে।
তবে গ্যাসসংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না দেশে। বিদ্যুৎ খাতে দিনে গ্যাসের চাহিদা ২৩২ কোটি ঘনফুট। এবার গ্রীষ্মে পিডিবি অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের দাবি জানিয়েছে। বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে প্রায় ১০০ কোটি ঘনফুট। এতে সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। গত বুধবার দিনের বেলায় গ্যাস থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদন করা হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কক্সবাজারের মহেশখালীতে একটি এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্যাস আমদানি করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা। আজ শনিবারের মধ্যে এটি চালুর কথা রয়েছে। এটি চালু হলে গ্যাস সরবরাহ বাড়বে।
কয়লা থেকে উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট। সক্ষমতার প্রায় পুরোটা ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া থাকায় নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা আছে। বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া জটিলতাও কাটেনি। জ্বালানি তেল আমদানির জন্য নিয়মিত ডলার পাচ্ছে না তারা। তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা আছে প্রায় ৭ হাজার মেগাওয়াট। দিনের বেলায় এক হাজার মেগাওয়াটের কম উৎপাদন করা হচ্ছে। রাতে উৎপাদন হচ্ছে সর্বোচ্চ তিন হাজার মেগাওয়াট।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, গরমে যখন মানুষের বেশি করে বিদ্যুৎ দরকার; তখন বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়লেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
রাজধানীতে কষ্টে আছে নিম্ন আয়ের মানুষ
তীব্র গরমে ভোগান্তিতে আছে রাজধানীর অধিকাংশ মানুষ। তবে বেশি কষ্টে রয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের রোজগারে ব্যাপক টান পড়েছে। আয় নেমে এসেছে অর্ধেকে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক যানবাহন না থাকায় অফিসগামী মানুষেরও দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। বাসে সিট না পাওয়ায় ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে গন্তব্য যেতে হচ্ছে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকায় অতিরিক্ত ঘেমে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এয়ারপোর্ট রুটে চলা একটি পরিবহনের যাত্রী জামশেদ আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আগে বাসে জানালার পাশের সিটে বসলে ঠাণ্ডা বাতাস লাগত। এখন গরম বাতাস আসে। মরুভূমির মতো হয়ে যাচ্ছে।
গরমে ক্লান্ত থাকায় অনেকে ভ্রাম্যমাণ ও অস্থায়ী দোকানগুলোতে লেবুর শরবত বা ঠাণ্ডা পানীয় পান করতেন। কিন্তু চাহিদা বাড়ায় সেসবের দামও বেড়ে গেছে। নেত্রকোনা জেলার বাসিন্দা রিকশাচালক হোসেন মিয়া খবরের কাগজকে বলেন, সকাল বেলা রিকশা নিয়ে বের হতেই হাঁফিয়ে উঠি। তখন লেবুর শরবত খেলে ভালো লাগে। কিন্তু এখন সেটার দাম ১৫ টাকা হয়ে গেছে। বেশি গরম আবার ঠাণ্ডা খাওয়ার কারণে জ্বরও আসে। শরীর খারাপ থাকে বেশি।’
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গায় ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানী ঢাকায় ছিল ৩৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে সিলেট ও কুমিল্লায়।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, কুমিল্লা ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলসহ ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা-ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি-বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে।
শনিবার (২০ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি-বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। বিরাজমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে।