![আন্তর্জাতিক রীতি মেনে ব্যাংক একীভূত করতে হবে](uploads/2024/04/26/1714120328.IMF.jpg)
ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ওয়াশিংটনভিত্তিক ঋণদানকারী সংস্থাটি বলেছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশ ব্যাংক একীভূত করে সফল হয়েছে এবং ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট প্র্যাকটিস বা আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে তা করা হয়েছে। বাংলাদেশ যেন এই ক্ষেত্রে একই নিয়মে ব্যাংক একীভূত করে। বাংলাদেশ ব্যাংককে সেই পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ মিশন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ পরামর্শ দেয় সফররত আইএমএফ মিশন। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বৈঠকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. সলীমউল্লাহসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কর্মকর্তা, চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে সকালে অর্থ বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। এ বৈঠকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে গরিবদের সংখ্যা বাড়ানো, একই সঙ্গে ভাতার পরিমাণ আরও বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণের শর্ত পূরণের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে আইএমএফের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক কৃষ্ণা শ্রীনিবাসনের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি দল গত মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছে। প্রথম দিন অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। গতকাল আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আগামী রবিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে বসবে আইএমএফ দল। আগামী ৮ মে পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করবে প্রতিনিধিদলটি।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সাড়ে তিন বছরের মেয়াদে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কার্যক্রমের বিপরীতে আইএমএফ অনেক শর্ত দেয়। রিজার্ভ ছাড়া প্রায় সব শর্তই পূরণ করে দুই দফায় দুই কিস্তির অর্থ পেয়েছেও বাংলাদেশ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের শর্ত কতখানি কী পূরণ হলো, তার মূল্যায়ন করতে আইএমএফ মিশনের এই ঢাকা সফর।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বলেছে আইএমএফ। বিশেষ করে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বিশেষ নজর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ব্যাংক খাতে ‘রাইট অফ’ বা পৃথকভাবে রাখা ঋণকে খেলাপি ঋণের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে আইএমএফ। এর ফলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র জানা যাবে বলে মনে করে সংস্থাটি। ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়ে সরকার বলেছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করেছে। ওই নীতিমালার ভিত্তিতে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সরকার নিয়মের বাইরে কিছু করবে না এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনেই তা করা হবে।
উল্লেখ্য, গত ২ এপ্রিল ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ বা বাংলাদেশ উন্নয়ন হালনাগাদ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা দরকার। সম্পদের মান ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা উচিত। ব্যাংক খাত সংস্কারে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে বলে জানায় বিশ্বব্যাংক।
ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে ও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে পথনকশা দেওয়ার পর এই ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ মাসের শুরুর দিকে ব্যাংক একীভূতকরণ-সংক্রান্ত নীতিমালা ঘোষণা করেছে। তবে সেই নীতিমালা প্রকাশের আগেই তিনটি ব্যাংক ও পরে দুটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। নীতিমালা অনুযায়ী এই পর্যায়ে ব্যাংক একীভূত হওয়ার কথা স্বেচ্ছায়; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই এই নীতিমালা মানছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। বলা হয়েছে, কার্যত কিছুটা সবল ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দুর্বল ব্যাংকের বোঝা।
যেভাবে ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া চলছে, তা নিয়ে ব্যাংক খাতে ইতোমধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্বল সূচকের অধিকারী ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি কিছুটা ভালো তালিকায় থাকা ব্যাংকগুলোও বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে।
তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আপাতত স্বেচ্ছায় নতুন করে আর কোনো ব্যাংক একীভূত হবে না। এমন পরিস্থিতিতে, ব্যাংক একীভূত করার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আইএমএম মিশন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে তারা (আইএমএফ) সরকারের অবস্থান জানতে চেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিয়েছে। সন্তোষ প্রকাশ করেছে তারা।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিষয়ে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। জবাবে আর্থিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিআর) প্ল্যান করেছে। এতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হয়েছে। এ ছাড়া ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে অ্যাকশন প্ল্যানে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো গ্রাহক ঋণ জালিয়াতি করলেই তিনি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন। একই সঙ্গে ঋণের টাকা অন্য খাতে স্থানান্তর করলে, বন্ধকি জামানতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ছাড়া অন্যত্র স্থানান্তর করলে বা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করলেও তারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন।
বৈঠকে আর্থিক খাত সম্পর্কিত বিভিন্ন আইনের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। জবাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, ব্যাংক কোম্পানিসহ কিছু আইন বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিছু আইন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
টার্গেট গ্রুপের কাছে ভাতাপ্রাপ্তি নিশ্চিতের পরামর্শ: গতকাল সকালে অর্থ বিভাগের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করে আইএমএফ দল। সরকার বর্তমানে বয়স্ক ও বিধবাসহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে মাসিক নগদ ভাতা দিচ্ছে। ভাতার পরিমাণ এত কম কেন? তা জানতে চেয়েছে আইএমএফ। জবাবে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সরকার ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংকোচন নীতি অনুসরণ করছে। তা ছাড়া সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। তবে ভাতার অঙ্ক না বাড়ালেও আগামী বাজেটে সুবিধাভোগীর সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে।
আইএমএফ বলেছে, প্রকৃত সুবিধাভোগীরা (টার্গেট গ্রুপ) যাতে ভাতা পান, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। জবাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, ভাতা বিতরণ প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজড বা স্বয়ংক্রিয় করা হয়েছে। এ ছাড়া উপকারভোগীদের পরিচয়পত্রে (এনআইডি) যে মোবাইল নাম্বার উল্লেখ করা হয়েছে, তার নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে উপকারভোগীদের ভাতাপ্রাপ্তি আরও নিশ্চিত হবে।