![গতিসীমা নীতিমালা বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন](uploads/2024/05/13/Road-01-1715584182.jpg)
সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ‘মোটরযানের গতিসীমা নীতিমালা’ প্রণয়ন করলেও তা আদৌ বাস্তবায়ন করা যাবে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। গতিসীমা নীতিমালা বাস্তবায়ন করার আগে সড়ক অবকাঠামো ও হাইওয়ে পুলিশের জনবলসংকট নিরসনে সড়ক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা নানা অভিমত দিলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ এসেছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে গতিসীমা নীতিমালা করার আগে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছিল। নানা সূত্রে জানা গেছে, সড়ক-মহাসড়কের নানা অবকাঠামোগত ত্রুটি, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিগত সক্ষমতার অভাবকে প্রকট করে দেখিয়ে গতিসীমা নীতিমালায় নানা সুপারিশ দিয়েছিলেন কমিটির সদস্যরা। কিন্তু মন্ত্রণালয় সেসব সুপারিশ আমলে নেয়নি।
‘মোটরযান গতিসীমা নির্দেশিকা-২০২৪’- তে বলা হয়েছে, এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেটকার, বাস ও মিনিবাসের গতিসীমা হবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার, মোটরসাইকেল ৬০ কিলোমিটার এবং ট্রাক চলবে ৫০ কিলোমিটার গতিতে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং জেলা শহরের মধ্যে গতিসীমা ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। অঞ্চলভেদে মোটরসাইকেলের গতিসীমা ৩০-৫০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম হাদিউজ্জামানের ভাষ্যে, মোটরযান গতিসীমা নীতিমালা পুরোপুরি ‘অবৈজ্ঞানিক’। সড়কের অবকাঠামো, যানবাহনের প্রকৃতি বিবেচনায় না নিয়ে যে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে তা আদৌ কার্যকর হবে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘যে পরিবহনটি বেশি গতিতে চলার অনুমতি পেয়েছে সেটি কম গতির যানকে ওভারটেক করতে যাবে। আর যেহেতু আমাদের অধিকাংশ মহাসড়ক দুই লেনের, এতে ওভারটেকিং প্রবণতা বাড়বে। মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা আরও বাড়বে। পৃথিবীর নানা দেশের সড়কে ১৪০-১৫০ কিলোমিটার গতিতেও যানবাহন চলে, অ্যাক্সিডেন্ট কিন্তু হয় না। আমাদের হচ্ছে কারণ আমাদের চালকরা এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চালাতে দক্ষ নয়। আমাদের পরিবহনের ফিটনেসও তেমন নয়। আমরা চালক আর যানবাহন নিয়ন্ত্রণ না করে গতিসীমা কমাতে চাই। আমি বলব এটি সড়কে বিশৃঙ্খলা তৈরির নতুন আয়োজন।’
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান মহানগরের সড়ক অবকাঠামো নিয়েও সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রাইমারি রোডের গতিসীমা ৫০ কিলোমিটার নির্ধারণ করলাম, কিন্তু যে যানবাহনগুলো প্রাইমারি রোডে চলাচলের উপযুক্ত না সেগুলো আমরা সড়কে রেখে দিলাম! মোটরসাইকেল আর রিকশা নিয়ন্ত্রণের কথা বলছি, কিন্তু সড়কে তাদের জন্য আলাদা কোনো ইনক্লুসিভ বা এক্সক্লুসিভ কোনো লেন তৈরি করতে পারলাম না। তাহলে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের কথা বলা অযৌক্তিক।’
তিনি বলেন, সড়কে গতিসীমা নির্ধারণ করতে হলে আগে নির্দিষ্ট এলাকার সড়কভেদে চলাচলের উপযোগী যানবাহন চলাচলের উদ্যোগ নিতে হবে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. আরমানা সাবিহা হক বলেন, ‘গতি নিয়ন্ত্রণে গত ২০১৫ সালে যানবাহনে স্পিড গভর্নর ডিভাইস বসানোর সিদ্ধান্ত নিলেও সেটি তো আদৌ বাস্তবায়িত হয়নি। নসিমন-করিমন নিষিদ্ধ করা যায়নি। আঞ্চলিক মহাসড়কে স্পাইরাল কার্ভ রয়ে গেছে। এগুলো সমাধান না করেই হুট করে গতিসীমা নির্ধারণ করা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হলো।’
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়ে, মহাসড়কে বাসের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এখন এ গতিসীমা কীভাবে মনিটর করবে বিআরটিএর এনফোর্সমেন্ট বিভাগ, সেটি দেখার বিষয় আছে। ঢাকা মহানগরীতে যানজট নিয়ন্ত্রণ করা গেল না। বাস চালাতে পারি ৬-৭ কিলোমিটার গতিতে। এখানে সর্বোচ্চ গতিসীমা বলা হয়েছে ৪০ কিলোমিটার। এত গতিতে বাস চলাচলের মতো সড়ক কাঠামো কি আছে ঢাকায়?’
সড়ক ও মহাসড়কে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে বিআরটিএর এনফোর্সমেন্ট বিভাগ প্রতিদিন ৬০-৬৫টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে প্রতিদিন। অথচ এনফোর্সমেন্ট বিভাগে ১৯ জন ম্যাজিস্ট্রেটের স্থলে সারা দেশে কাজ করছেন মাত্র ৮ জন। সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন কিংবা পুলিশের পক্ষ থেকে কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘এটি তেমন কোনো সংকট না। আমরা যখনই অভিযানে যাচ্ছি সরকারের নানা দপ্তর থেকে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়া হচ্ছে।’
গতিসীমা নীতিমালা নিয়ে নানা সমালোচনা হলেও আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়ের গতিসীমা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা এখন তা বাড়াব না। আগে সড়ক দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনি, তারপর সেটি বিবেচনা করা যাবে।’
জাতীয় কমিটির সুপারিশমালা নিয়ে সড়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। জানা গেছে, জাতীয় কমিটির সদস্যরা সংবাদ সম্মেলন করে তাদের অভিযোগ উত্থাপন করবেন।
এপ্রিলে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ২২.৪৫%: রোড সেফটি ফাউন্ডেশন
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গতকাল এপ্রিল মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে জানা যায়, গত মার্চ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৭৩ জন নিহত হয়েছেন। প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছেন ১৮.৪৮ জন। এপ্রিল মাসে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছেন ২২.৬৩ জন। এই হিসাবে এপ্রিল মাসে প্রাণহানি বেড়েছে ২২ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
সংগঠনটি বলছে, গত এপ্রিল মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬৭২টি। নিহত হয়েছেন ৬৭৯ জন এবং আহত হয়েছেন ৯৩৪ জন। তবে বিআরটিএর হিসাব বলছে, গত এপ্রিল মাসে ৬৫৮টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬৩২ জন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ২৩৫টি জাতীয় মহাসড়কে, ২৬৬টি আঞ্চলিক সড়কে, ৮৭টি গ্রামীণ সড়কে এবং ৭৯টি শহরের সড়কে এবং ৫টি (০.৭৪%) অন্যান্য স্থানে সংঘটিত হয়েছে।
রোড সেফটির তথ্য বলছে, ৩১৬টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২৫৯ জন, যা মোট নিহতের ৩৮.১৪ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৭ শতাংশ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৩২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৭৬ জন নিহত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ৩৪টি দুর্ঘটনায় ৪৭ জন নিহত হয়েছেন। একক জেলা হিসাবে চট্টগ্রাম জেলায় সবচেয়ে বেশি ৪৩টি দুর্ঘটনায় ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম শরীয়তপুর ও বান্দরবান জেলায়। রাজধানী ঢাকায় এপ্রিল মাসে ৪৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭ জন নিহত ও ৬৬ জন আহত হয়েছেন।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।