![রাজস্ব ঘাটতির কারণ জানতে চেয়েছে আইএমএফ](uploads/2024/05/21/IMF-1716273686.jpg)
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে রাজস্ব ঘাটতির কারণ জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ঘাটতি এড়ানো সম্ভব হলো না কেন সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের কাছেও তার ব্যাখা দিতে হবে এনবিআরকে।
এনবিআর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে, এমন অঙ্গীকার করেই আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। অথচ এ শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এনবিআরের সক্ষমতা না বাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোয় প্রতি অর্থবছরেই রাজস্ব ঘাটতি এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। রাজস্ব ঘাটতি থাকায় দেশে অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, এখানে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে যারা আছেন তারা বাজেটের আকার বড় করে কাগজেকলমে হিসাব মিলাতে এনবিআরের অঙ্কের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা চাপিয়ে দেন। ঋণ পরিশোধের জন্যও এনবিআরের ওপর আদায় বাড়ানোর চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু এখানে শুধু লক্ষ্যমাত্রা বাড়ালেই হবে না। এনবিআরকে আদায়ের সক্ষমতা বাড়াতে মনোযোগী হতে হবে। এতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও ঘাটতি কমবে। অর্থনীতিতে ভারসাম্য আসবে।
এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, চলতি অর্থবছরের শুরুতে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে না পারায় এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এ ক্ষেত্রে রাজস্ব আদায়ের বিভিন্ন খাতের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে কমিয়ে আমদানি শুল্ক ৪৩ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা, আমদানি পর্যায়ের ভ্যাট ৫২ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা, আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক ১৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক ৬৩ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক ৪ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা, স্থানীয় পর্যায়ের ভ্যাট ১ লাখ ৫ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা, স্থানীয় পর্যায়ের সম্পূরক শুল্ক ৪১ হাজার ৬১ কোটি টাকা, টার্নওভার কর ৪৫ লাখ টাকা করা হয়। একইভাবে আয়কর কমিয়ে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা এবং ভ্রমণ কর কমিয়ে ১ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা করা হয়।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের গত ১০ মাসে যে সংশোধিত লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে ২৬ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা কম আদায় করতে পেরেছে এনবিআর। মূল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এই আদায় ৪৬ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা কম। গত জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত সব মিলিয়ে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৩২১ কোটি টাকার শুল্ক কর আদায় হয়েছে। এই সময় সংস্থাটির রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩ লাখ ১৩ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা।
আমদানি কর, ভ্যাট ও আয়কর- এই তিন খাতের মধ্যে কোনোটিই গত ১০ মাসে লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। এর মধ্যে আমদানি পর্যায়ে ৮২ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা, ভ্যাটে ১ লাখ ১১ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা ও আয়করে ৯৩ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে এনবিআর।
চলতি অর্থবছর শেষ হতে চলতি মে এবং জুন মাস বাকি আছে। এনবিআর থেকে পাওয়া তথ্য খতিয়ে দেখে এবং এনবিআরের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের শেষ মাস জুনে এনবিআরের পরিকল্পনামতো বা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আদায় হলেও রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি এড়ানো যাবে না। বাকি দুই মাস মে ও জুনে এনবিআরকে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হলে এনবিআরকে আরও ১ লাখ ২২ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। যা অসম্ভব বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঘাটতির কারণ ব্যাখ্যা করে আইএমএফের কাছে পাঠানো এনবিআরের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, অর্থবছরের শেষ মাসে আদায় বাড়ার সম্ভাবনা আছে। বিশেষভাবে উৎসে কর খাতে বড় ধরনের আদায় হবে। রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে এমন সব প্রতিষ্ঠানে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং শুল্ক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর থেকে অভিযান চালানো হচ্ছে। আর এতেও বড় অঙ্কের অর্থ আদায় হচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে রাজস্ব ঘাটতি কমবে বলে আশা করা যায়।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এনবিআরের সঙ্গে আইএমএফের বৈঠকে চলতি অর্থবছরের জন্য আইএমএফ থেকে ৪ লাখ কোটি টাকার কম রাজস্ব আদায় করা যাবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাজস্ব ঘাটতির কারণ হিসেবে ডলারসংকটকে দায়ী করে এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অর্থনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। বিশ্বব্যাপী ডলারসংকট চলছে। ডলারসংকটের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক ধারা রয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে আয় বাড়েনি। বরং অনেকের আয় কমেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছে না। বেশির ভাগ শিল্প মুনাফা করতে পারছে না। নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধ করেছে এমন অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ডলারসংকটের কারণে সঠিক হিসাবে এনবিআরের পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না। এতে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আদায় হচ্ছে না। ফলে রাজস্ব ঘাটতি হচ্ছে। তবে এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও এনবিআরের অনেক খাতে প্রবৃদ্ধি আছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে দেশে রাজস্ব আদায়ে কিছুটা নেতিবাচক ধারা রয়েছে। তবে এনবিআর হতাশ না। যেকোনো পরিস্থিতির মধ্যেই রাজস্ব আদায় বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে। আশা করি ভালো ফল আসবে।