![ঘূর্ণিঝড় এলেই চট্টগ্রামের পাহাড়ে বাড়ে আতঙ্ক](uploads/2024/05/28/Ctg-pic-26-May-1716876796.jpg)
বর্ষা এলেই চট্টগ্রামে শুরু হয় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরানোর তোড়জোড়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। গত রবিবার থেকে পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
জানা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকায় নগরের ২৬টি পাহাড় থেকে বেশ কিছু লোকজন নিরাপদ স্থানে সরে গেছে। অনেকেই ঘরবাড়ির জিনিসপত্র ফেলে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে রাজি হননি।
সরকারি সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তার কারণে পাহাড়ে বেড়ে যাচ্ছে অবৈধ বসতি। অনেকেই পাহাড় দখল করে ভাড়া দিয়েছেন। বসতি গড়ে নিজের মতো করে ব্যবহার করছেন। আবার পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস করছেন। পাশাপাশি মানুষের জীবনকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। অনেক বাসিন্দা দখলদার নন। কিন্তু তারা ভাড়া হিসেবে কম টাকায় থাকছেন পাহাড়ে। যেহেতু চট্টগ্রামের নগরজুড়েই এসব পাহাড়ের অবস্থান। ফলে অবৈধ বসতিদের সুবিধা মতো বসবাস করছেন পাহাড়গুলোতে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের হালনাগাদ তালিকা অনুসারে বন্দরনগরীর সরকারি-বেসরকারি ২৬টি পাহাড়ে এখন অবৈধ স্থাপনার সংখ্যা ৬ হাজার ৫৫৮টি। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের মালিকানাধীন ১৬টি পাহাড়ে বসবাস করছে ছয় হাজার ১৭৫টি পরিবার। আর ব্যক্তি মালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩৮৩টি।
নগরীর বায়েজিদ লিংক রোড ও সলিমপুর, আকবর শাহ, অক্সিজেন, রৌফবাদ, লালখান বাজার মতিঝর্ণা, ফয়’স লেক এলাকায় অবৈধ বসতি রয়েছে।
দেশে যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলেই এসব এলাকায় মাইকিং করা হয়। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরে যেতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। অনেকেই সরে যান আবার অনেকেই সরেন না তাদের অবৈধ বসতি হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে।
চট্টগ্রাম নগরীতে সবচেয়ে বেশি অবৈধ পরিবারের বসবাস ফয়’স লেক এলাকার ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিল পাহাড়ে। এখানে মোট চার হাজার ৪৭৬টি পরিবার থাকে। ওই পাহাড়ের মালিকও বাংলাদেশ রেলওয়ে।
এটিসহ বাংলাদেশ রেলওয়ের মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসতি আছে। এর মধ্যে মতিঝরনা ও বাটালি হিল এলাকায় বসবাস ৪৩১টি পরিবারের। লেকসিটি আবাসিক এলাকাসংলগ্ন বিজয়নগর পাহাড়ে বসবাস ২৮৮টি পরিবারের।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দীনমনি শর্মা খবরের কাগজকে বলেন, পাহাড়ে পাহাড়ে মাইকিং করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে সরে যেতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেকেই পাহাড় ছেড়ে যাননি। পরে বিপদ এলেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম. রেজাউল করিম চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তর সব দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে। কিন্তু তারা কী কাজ করে তা আমরা কেউ জানি না। অথচ পাহাড় বেদখল, পাহাড় কাটা ইত্যাদি বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার পরিবেশ অধিদপ্তরের রয়েছে।’
তিনিও এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে বারবার তাগাদা দিয়ে থাকেন।
জানতে চাইলে সিডিএ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ খবরের কাগজকে বলেন, পাহাড় রক্ষার আইনি দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। তারাই চট্টগ্রামের পাহাড় দেখভাল করে। তবুও তিনি পাহাড় রক্ষায় যতটুকু সম্ভব কাজ করবেন। কারণ পাহাড় হলো চট্টগ্রাম শহরের প্রাণ। পাহাড় এবং বন রক্ষা না হলে চট্টগ্রাম মরুভূমিতে পরিণত হবে। ইতোমধ্যে তিনি পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত দুই দিনে পাহাড় থেকে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের জন্য শুকনা এবং রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাসের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর পরই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় ও অবৈধ বসতির তালিকা করা হয়েছে।
সর্বশেষ গত বছর আগস্টে নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন ষোলশহর আইডব্লিউ কলোনিতে পাহাড়ধসে বাবা সোহেল (৩৫) ও তার সাত মাস বয়সী মেয়ে বিবি জান্নাতের মৃত্যু হয়। গত বছরের এপ্রিল মাসে আকবর শাহ এলাকায় মুজিবুর রহমান খোকা নামে একজনের মৃত্যু হয় পাহাড়ধসে। এ ঘটনায় আরও তিনজন আহত হয়েছিলেন।
২০২২ সালে ১৭ জুন পাহাড়ধসে নিহত হন আরও চারজন। ওই দিন রাত ২টায় এবং ১৮ জুন ভোর ৪টায় নগরীর আকবর শাহ থানাধীন ১ নম্বর ঝিল ও ফয়’স লেক সিটি আবাসিক এলাকায় এ পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আরও পাঁচজন আহত হন।
২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের লালখানবাজার মতিঝরনা এলাকায় পাহাড়ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগারপাস এলাকার বাটালি হিল পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
২০১২ সালের ২৬ ও ২৭ জুন পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে মতিঝরনায় দেয়াল ধসে দুজন মারা যান। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড়ধসে মারা যান তিনজন, একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় মারা যান মা-মেয়ে।
২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরীর আকবর শাহ থানাধীন ফিরোজ শাহ কলোনিতে পাহাড়ধসে মারা যান চারজন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ আবাসিক এলাকা পাহাড়ধসে এক শিশু প্রাণ হারায়।
পাহাড়ধসে এত প্রাণহানির পরও বন্ধ হয়নি পাহাড় কাটা, দখল ও বসতি স্থাপনা। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাহাড়ধস এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আরও ১২৫ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সব মিলে ২০০৭ সাল থেকে গত ১৭ বছরে নগরে ও আশপাশে পাহাড়ধসে ২৫১ জন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় রিমালের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে বসতি সরানো হয়েছে। মাইকিং করা হয়েছে, বসতিদের সতর্ক করা হয়েছে। পাহাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে থাকি। নগরের বিভিন্ন পাহাড়ে লিংক রোড ও সলিমপুর অংশে পাহাড় কাটা বন্ধে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে।’