![আইএমএফের চাপ ঠেকাতে ব্যবসায়ীদের দৌড়ঝাঁপ](uploads/2024/06/04/inmf-1717478701.jpg)
বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপনের শেষ সময়ে এসেও আইএমএফের চাপ ঠেকাতে দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা নতুন কাস্টমস আইন বাস্তবায়নের বিরোধিতা করে বেশ কয়েকটি খাতে রাজস্ব ছাড় ও করবহির্ভূত সুবিধা আগের মতো বহাল রাখার আবেদন করেছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখনো ইতিবাচক সাড়া মিলছে না।
বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার থেকে করের চাপ কমানোর দাবি করলেও কাজে আসেনি। এভাবে শিল্পোদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগ মতামত না মেনেই আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ৬ জুন ঘোষণার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ী নেতাদের দাবি, এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের বেশির ভাগ খাতে খরচ বাড়বে। গোটা অর্থনীতিতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
অর্থসংকটে থাকা সরকার এ পর্যায়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। ঋণ অনুমোদনের আগেই সংস্থাটি কিছু শর্ত দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল, এসব বাস্তবায়ন করা না হলে ঋণের কিস্তি দেওয়া হবে না। সব শর্ত মেনে নেওয়ার অঙ্গীকার ছিল সরকারের। এসব শর্তের বেশির ভাগেই আছে ব্যবসায়ীদের আপত্তি। তাদের আপত্তি সত্ত্বেও আইএমএফের চাপে এসব শর্ত প্রস্তাবিত বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হচ্ছে নীতিনির্ধারকদের।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের মতামত নিয়েই বাজেট করতে হবে। আমরা প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে আমাদের মতামত তুলে ধরেছি। আশা করি এর প্রতিফলন হবে। যদি প্রস্তাবিত বাজেটে এসব আনা হয়, তবে অবশ্যই বাজেট চূড়ান্ত করার সময় এসব বাদ দিতে হবে। আমরা সরকারের ওপরের মহলের কাছে এ বিষয়ে আশ্বাস চেয়েছি।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মো. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার ও ব্যবসায়ী- আলাদা কোনো পক্ষ না। ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের ছাড় ও সুবিধা দিয়ে মুনাফার মধ্যে রাখতে হবে। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে এদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যাবে না।’
সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরের কাছ থেকে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা এবং এনবিআরবহির্ভূত খাত থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গিয়ে প্রায় সব ধরনের রাজস্ব ছাড়ের সুবিধা কমানো হয়েছে। আর এতে শিল্প-ব্যবসায়ে খরচ বাড়বে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট চেয়েছেন। কিন্তু আমলাতন্ত্রের কারণে ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়ছেন। রাজস্ব আদায়ের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে আওতা বাড়াতে হবে। এখনো পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রে সফলতা দেখাতে পারেনি। যারা রাজস্ব দিচ্ছে, তাদের ওপর চাপ বাড়িয়ে আদায় বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কাউকে খুশি করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সমস্যায় ফেলা যাবে না। ব্যবসায়ীরা রাজস্ব দেন বলেই সরকারের আয় হয়। সরকারের ওপরের মহলে আমাদের দাবি জানিয়েছি। আমরা আশ্বাস চেয়েছি যে চূড়ান্ত বাজেটে এসব থাকবে। মনে রাখতে হবে, ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা পিছিয়ে যাওয়া মানে দেশের অর্থনীতি পিছিয়ে যাওয়া।’
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডলারসংকট চলছে। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিও ভালো না। এসব আমাদের নিয়ন্ত্রণে না। আমাদের নীতি প্রণয়ন আমাদের হাতে। তৈরি পোশাকসহ সব রপ্তানি খাতের উৎসে কর কমানো এখন সময়ের দাবি। আইএমএফ কী বলল আর কিসে খুশি হলো তা দিয়ে ব্যবসায়ীরা কী করবেন? তাদের ব্যবসা করে টিকে থাকতে হবে।’
তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ আবেদনে জানিয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ পোশাকশিল্প থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে আগামী বাজেটে রপ্তানির বিপরীতে উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ, নগদ সহায়তার ওপর আয়কর কর্তনের হার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ, ইআরকিউর ওপর আয়কর ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা, ২০২৯ সাল পর্যন্ত প্রণোদনা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে আইএমএফের সুপারিশে অনেক খাতে নতুনভাবে ভ্যাট বসবে। ভ্যাটের হার বাড়বে। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে বেশি হারে ভ্যাট দিতে হবে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে ভ্যাট অব্যাহতি কমবে। ছোট-বড় শতাধিক শিল্প খাতে রাজস্ব ছাড়ের সুবিধা বাতিল হবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এসএমই খাতের গতিশীলতায় পদক্ষেপ না নিলে দেশের অর্থনীতিতে ধস নামবে। বাজেটে এসএমই খাতের জন্য ভ্যাট, কর ও শুল্ক মওকুফ সুবিধা দিতে হবে। রাজস্বের ভার চাপিয়ে দেওয়া হলে এসএমই খাত শেষ হয়ে যাবে। এ ছাড়া পুঁজিবাজারে মুনাফার ওপর কর আরোপ মানে হলো বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করা। চূড়ান্ত বাজেটে এসব দাবির বাস্তবায়ন প্রয়োজন।’
এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক মাহবুব চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘৬ জুন বাজেট প্রস্তাব পেশ করা হবে। এই দিন থেকেই নতুন কাস্টমস আইন কার্যকর করা হবে। আইনটির অনেক ধারায় আমাদের আপত্তি আছে। এসব সংশোধন না করলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতে খরচ বাড়বে, লোকসান হবে।’
এফবিসিসিআই থেকে নতুন কাস্টমস আইন সংশোধনের আবেদন জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘নতুন কাস্টমস আইন বাস্তবায়নে ব্যবসার খরচ বাড়ার পাশাপাশি আমদানিকারকদের ভোগান্তি বাড়বে। এ আইনে মিথ্যা, ভুল বা অসত্য তথ্য দিয়ে পণ্যের শুল্কায়ন হলে পাওনার কয়েক শ গুণ বেশি জরিমানা করা যাবে। এক টাকাও শুল্ক ফাঁকি দিলে জরিমানা ২০০ গুণও করা যাবে। তিন বছর আগের কোনো পণ্যের শুল্কায়ন ভুল হয়েছে দাবি করেও অর্থ চেয়ে চিঠি দিতে পারবে এনবিআর। ব্যবসায়ীদের ভুল হলে জরিমানা করা হবে, আর কর্মকর্তাদের ভুলকে নির্দোষ হিসেবে দেখা হয়েছে। নতুন আইনে পণ্য নিলামের কোনো ধারা রাখা হয়নি। শুল্কায়নের ১০ দিনের মধ্যে শুল্ক-কর পরিশোধ করে পণ্য বন্দর থেকে খালাস না করলে ওই পণ্য আমদানি-রপ্তানিকারককে শুল্ক-কর পরিশোধের সর্বশেষ তারিখ থেকে খালাসের সময় পর্যন্ত বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে সাধারণ সুদ পরিশোধ করতে হবে। কাস্টমস স্টেশনে পণ্য নামার পর আমদানিকারককে পাঁচ দিনের মধ্যে পণ্যের ঘোষণা বা বিল অব এন্ট্রি জমা না দিলে আমদানিকারককে সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। তল্লাশির আগে ব্যাগেজে রক্ষিত পণ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হলে এবং তল্লাশিকালে ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হবে। তাকে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে।’