মোটরসাইকেলে চড়ে সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম অতিক্রম করছিলেন দুই যুবক। স্টেডিয়ামের বাইরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকা, ক্যাপসহ আরও কিছু বিক্রি করছিলেন কয়েকজন হকার। তাদের দেখে মোটরসাইকল থামিয়ে যুবকদের একজন এক হকারকে জিজ্ঞেস করেন আজ (গতকাল) এখানে খেলা নাকি? হকারের কাছ থেকে হ্যাঁ সূচক জবাব পাওয়ার পর তারা আবার জানতে চান কাদের খেলা। এবার হকার জানান, বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার খেলা। যুবকদ্বয় বেশ অবাক হয়ে তারা জানেন না বলে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে চলে যান।
সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ম্যাচ শুরু হওয়ার পর সব সময়ই খেলা নিয়ে সিলেটবাসীর মাঝে ব্যাপক আগ্রহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়। একটি টিকিটের জন্য দৌড়ঝাঁপ, ভোর হতে লাইনে দাঁড়ানো, টিকিট না পেয়ে চড়া দামে কালোবাজারির কাছ থেকে হলেও টিকিট কিনে খেলা দেখার দৃষ্টান্ত আছে সিলেটবাসীর। কিন্তু এবারের মতো এ রকম পরিস্থিতি অতীতে কখনো হয়নি। একটি আন্তর্জাতিক সিরিজ হচ্ছে, অথচ দুই যুবকের মতো না জানা মানুষের সংখ্যা অনেক। শহরের জিন্দাবাজার, আম্বরখানা, সুবিদবাজার, পীরমহল্লা, মির্জাজঙ্গল, বন্দর, উপশহর এলাকার অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তারা জানেনই না এই সিরিজের কথা। বিভাগীয় শহরের ব্যস্ততম এলাকা জিন্দাবাজারের খাবারের জন্য প্রসিদ্ধ পানসী, পাঁচভাই রেস্টুরেন্টে দুপুরে মধ্যাহ্নভোজের সময় প্রচুর ভিড় হয়। অতীতে এ রকম খেলা হলে অনেকেই এইসব হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে সরাসরি স্টেডিয়ামের দিকে চলে যেতেন। খাবারের সময়ও থাকত ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা। কিন্তু এবার খাবরের সময় তাদের অনেকের সঙ্গে আলাপ করে খেলার বিষয়টি তারা না জানার কথাই জানান। মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন জানেন, তাদের খুব একটা আগ্রহী দেখা যায়নি। তাদেরই একজন শাহদাত হোসেন। খবরের কাগজকে তিনি বলেন, ‘ভাই কতো আর খেলা দেখব। কয়েক দিন আগে বিপিএলে সিলেটের বেশ কয়েকটি খেলা দেখেছি। খেলা দেখতে গেলে কাজের অনেক ক্ষতি হয়। একটি দিনই চলে যায়।’ পাশে থাকা আলাহউদ্দিন বলেন, বিপিএল শেষ হওয়ার পর কিছুদিন গ্যাপ (বিরতি) দিয়ে হলে দর্শক মাঠে যেতেন। কিন্তু সবারইতো কাজ-কর্ম আছে।’ দর্শক কম হওয়ার জন্য বিপিএলের তিক্ত অভিজ্ঞতাকেও দায়ী করেছেন আনোয়ার হোসেন নামে এক ক্রিকেটপ্রেমী। তিনি বলেন, বিপিএলে সিলেটের খেলা দেখতে টিকিটের জন্য অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। সকালে লাইনে দাঁড়িয়েও টিকিট পাইনি। পরে অনেক বেশি দামে ব্লাকারদের কাছ থেকে টিকিট কিনে খেলা দেখেছি। এভাবে তো সব সময় এতো টাকা খরচ করে খেলা দেখা সম্ভব নয়। এই সিরিজেও টিকিট নিয়ে ভোগান্তি হবে মনে করে আমার পরিচিত অনেকেই যেতে আগ্রহী হননি।’
সিলেটে আন্তর্জাতিক ম্যাচ হলে মিডিয়ার কল্যাণে দর্শকরা এমনিতেই জেনে যান। কিন্তু এবার বিপিএলের ফাইনালের আগের দিন শ্রীলঙ্কা দল বাংলাদেশে আসে। কিন্তু বিপিএলের কারণে তাদের আসার সংবাদ মিডিয়াতে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার হয়নি। এটিকেও একটি কারণ বলে মনে করেন স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে আসা শাহ আলম। সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়ামে প্রায় ৪ বছর থেকে গেটে দর্শকদের টিকিট চেক করার দায়িত্ব পালন করে আসছেন কমলা রঙের ইউনিফর্ম পরা মদন মোহন কলেজের ছাত্র আসিফ আরমান। তিনি নিজেও অবাক এতো কম দর্শক দেখে। খবরের কাগজকে তিনি বলেন, ‘আজ (গতকাল) আমি যখন ইউনিফর্ম পরে মাঠে আসছি, তখন আমার পরিচিত অনেকেই ইউনিফর্ম পরার কারণ জানতে চেয়েছেন। আমি তাদের বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজের কথা বলতে তারা সবাই অবাক হয়ে যান। তারা আমাকে বলে, বাংলাদেশের খেলা হচ্ছে আর আমরা জানিই না!’ সিলেট প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ইকরমুল কবীর প্রচার-প্রচরণাকেই মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি নিজেও জেনেছি ঢাকা থেকে ফোন পাওয়ার পর। প্রচার-প্রচারণা খুবই কম হয়েছে। যে কারণে লোকজন জানতে পারেনি।’
দর্শক কম হওয়ার বিষয়টি হয়তো বেশ ভালোই আঁচ করতে পেরেছিলেন সিলেটি বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তারা। যে কারণে তারা শনিবার শহরে মাইকিং করেছেন। কিন্তু তাতেও দর্শকরা সাড়া দেননি। তাদের মাইকিং শুনে আবার অনেকেই জানতে পেরেছেন বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজের কথা। এই মাইকিং করাটাকেও হাস্যকর মনে হয়েছে এমসি কলেজের ছাত্র আকাশের। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন যে পর্যায়ে চলে গেছে, তাতে করে মাইকিং মানায় না। দর্শকরা এমনিতেই নিজেদের টানে খেলা দেখতে আসে। বিপিএলের পরপরই না হলে দর্শকের আগ্রহ আরও বেশি থাকত। আবার দর্শকরা খেলা দেখতে গিয়ে টিকিটের জন্য যেভাবে কষ্ট করেন, সে সবও দূর করতে হবে।’ সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও বিসিবির কাউন্সিলর মাহিউদ্দিন আহমেদ সেলিম নিজেও অবাক দর্শক এতো কম দেখে। ব্যবসায়িক কাজে তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। শনিবারই ফিরেছেন দেশে। কাল গিয়েছিলেন মাঠে খেলা দেখতে। খবরের কাগজকে তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই অবাক এতো কম দর্শক দেখে। এতো কম দর্শক আগে কখনো হয়নি। এর প্রধান কারণ বিপিএল। বিপিএল শেষ হওয়ার অন্তত ১৫ দিন পর হলে দর্শকরা ঠিকই আসতেন।’ সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও বিসিবির পরিচালক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল এমপিকে ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ না করাতে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
খেলা শুরু হওয়ার সময় দর্শক উপস্থিতি খুবই কম থাকলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা বাড়তে থাকে। তারপরও গ্যালারির প্রায় অর্ধেক শূন্য ছিল।