মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্কের মহাকাশযান প্রস্তুতকারক ও মহাকাশ যাত্রায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স ধ্বংস করবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন, যা ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আইএসএস)’ নামে পরিচিত। এই মহাকাশ স্টেশনের জীবনকাল শেষে, এটিকে ধ্বংসের জন্য স্পেসএক্সকে দায়িত্ব দিয়েছে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি নাসার বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে বিষয়টি জানিয়েছে।
স্পেসএক্স প্রশান্ত মহাসাগরে ৪৩০ টন ওজনের মহাকাশ কাঠামোটিকে নিরাপদে অবতরণ করার জন্য আগামী কয়েক বছরের মধ্যে একটি যান নির্মাণ করবে। সম্প্রতি এই কাজের জন্য স্পেসএক্সের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৮৪ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের একটি চুক্তির ঘোষণা দিয়েছে নাসা।
২০৩০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। এরপরের বছর অর্থাৎ ২০৩১ সালের শুরুর দিকে এটিকে কক্ষচ্যুত করে প্রশান্ত মহাসাগরে ফেলা হবে। কিছু প্রতিষ্ঠান স্টেশনটির বিভিন্ন মডিউল পুনরায় ব্যবহার করতে চাইছে। আইএসএসের জায়গা নিতে পারে তুলনামূলকভাবে ছোট একাধিক বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন।
১৯৯৮ সালে আইএসএস প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। সর্বপ্রথম রাশিয়ার জারিয়া নামক মডিউল পাঠানোর মাধ্যমে এ স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। মহাকাশে মানুষ নির্মিত সর্ববৃহৎ স্থাপনাটি তৈরিতে বিশ্বের প্রায় এক ডজনের বেশি দেশ একত্রে কাজ করেছে। ২০০০ সালের নভেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো কোনো নভোচারী মহাকাশ স্টেশনটিতে পা রাখেন। এরপর থেকে নিয়মিতই তাদের আনাগোনা ছিল সেখানে।
প্রতি ৯০ মিনিটে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে চলা এই মহাকাশ স্টেশন ৪০০ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এখানে মানবদেহে বার্ধক্যের প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নতুন ধরনের উপকরণের সূত্র আবিষ্কারসহ সব ধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন নিয়ন্ত্রিতভাবে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি বিশেষ যান তৈরি করবে। নাসা ও এর আন্তর্জাতিক অংশীদাররা যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ফলে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে আইএসএসের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর নিরাপদে এটি অপসারণ করা সম্ভব হবে। নতুন এই যানের নাম রাখা হয়েছে ‘ইউএস ডিওরবিট’। এই যান তৈরির জন্য ২০২৩ সালে প্রথম প্রস্তাব গ্রহণ করে নাসা। এটি অনেকটা নদী বা সমুদ্রে চলমান টাগবোটের মতো কাজ করবে। বড় বড় জাহাজকে যেমন টাগবোটের মাধ্যমে নদীর তীরে টেনে আনা হয়, এই যান তেমনই কাজ করবে।
নাসার স্পেস অপারেশনসের পরিচালক কেন বোয়ারসক্স এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ‘আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ইউএস ডিওরবিট যানটি তৈরি করা হচ্ছে। নাসা পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে আরও কার্যকর বৈজ্ঞানিক, পরীক্ষা পরিচালনা করতে চায়। সেই লক্ষ্যে আরও আধুনিক আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন তৈরি করতে চায় মহাকাশ সংস্থাটি।’
আইএসএস প্রকল্পের নেতৃত্বে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। ইউরোপ, কানাডা ও জাপান এই প্রকল্পে সহযোগী ভূমিকা পালন করছে। পশ্চিমা অংশীদাররা ২০৩০ সাল পর্যন্ত স্টেশনটির জন্য অর্থায়ন করতে সম্মত হয়েছে। রাশিয়া কমপক্ষে ২০২৮ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্পে যুক্ত থাকার কথা জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের আয়ুষ্কাল শেষে এটি নিষ্ক্রিয় করার বিভিন্ন সমাধান খুঁজছে নাসা। এই সমাধানগুলোর মধ্যে রয়েছে স্টেশনটির পুরোনো অংশগুলো ভেঙে ফেলা এবং নতুন প্রজন্মের মহাকাশ কাঠামো তৈরিতে কিছু অংশ ব্যবহার করা। অপর একটি সমাধান হলো এটি চালু রাখা এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া। তবে প্রতিটি সমাধানেই খরচের পাশাপাশি মালিকানা নিয়ে আইনি জটিলতা রয়েছে।
মহাকাশ স্টেশন নিয়ন্ত্রিতভাবে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য যে যান তৈরি করা হচ্ছে, তার নকশা প্রকাশ করেনি স্পেসএক্স ও নাসা। তবে নিরাপদে সঠিক সময় এবং জায়গায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করানোর জন্য নতুন যানটির শক্তিশালী গতিবেগ লাগবে।
স্টেশনটির বিশাল আকৃতি ও ভরের কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় তীব্র তাপ সহ্য করে কিছু কাঠামো এবং যন্ত্রাংশ ভূপৃষ্ঠে পৌঁছাতে পারে। এর আয়তন প্রায় একটি ফুটবল মাঠের সমান।
মহাকাশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণকারীরা ধীরে ধীরে কক্ষপথ পরিবর্তন করবে। এতে অবস্থান করা সর্বশেষ মহাকাশচারীদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার পর চূড়ান্তভাবে এটিকে অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
নিষ্ক্রিয় মহাকাশযানগুলোকে প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত ‘পয়েন্ট নিমো’ নামের স্থানকে লক্ষ করে নিক্ষেপ করা হবে। জুল ভার্নের বিখ্যাত বই ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’-এর সাবমেরিন চালকের নামানুসারে লক্ষ্যস্থলটি সবচেয়ে কাছের স্থলভাগ থেকে আড়াই হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরে অবস্থিত।
নাসা আশা করছে, আইএসএস নিষ্ক্রিয় হওয়ার আগেই বেশ কয়েকটি বেসরকারি বাণিজ্যিক সংস্থা বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন উৎক্ষেপণ শুরু করবে। এরপর মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলোর মনোযোগ থাকবে ‘গেটওয়ে’ নামের প্রকল্পের দিকে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে এমন একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। সূত্র: বিবিসি