![বুয়েটে অনড় সাধারণ শিক্ষার্থীরা, প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি](uploads/2024/04/03/1712081386.buetkk.jpg)
বুয়েটকে স্মার্ট বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির মডেল থেকে শুরু করে আধুনিক, যুগোপযোগী, বৈচিত্র্যময়-সৃষ্টিশীল, জ্ঞান-যুক্তি-তথ্য-তত্ত্বনির্ভর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ছাত্রলীগ। তবে ছাত্রলীগের এমন প্রতিশ্রুতিতে মন গলেনি আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের। দাবি পূরণ ও রাজনীতিমুক্ত বুয়েট গড়ার দাবিতে অনড় এসব শিক্ষার্থী। এদিকে বুয়েটকে ছাত্ররাজনীতি মুক্ত রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) সন্ধ্যায় বুয়েটের ড. এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এক খোলা চিঠিতে এই দাবি জানান তারা।
‘দেশের সর্বোচ্চ অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাসের দাবি জানানো’ ওই খোলা চিঠিতে শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক দিক উল্লেখ করে বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে আমরা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নামে ক্ষমতার নেতিবাচক দিকগুলোই প্রত্যক্ষ করেছি। ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মাঝে সূচনা ঘটেছে আধিপত্য, দাপট, র্যাগিং, শিক্ষকদের অপমান, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নিপীড়ন, খুনোখুনিতে মেতে ওঠার মতো ঘটনা এবং এর ব্যাপ্তি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এর চরমতম মূল্য হিসেবে কেমিকৌশল ৯৯ ব্যাচের সাবেকুন্নাহার সনি, যন্ত্রকৌশল ৯ ব্যাচের আরিফ রায়হান দ্বীপ এবং সর্বশেষ তড়িৎকৌশল ১৭ ব্যাচের আবরার ফাহাদের মতো মেধাবীদের হারিয়েছি।’
শিক্ষার্থীরা র্যাগিং-মারধরের ঘটনায় ছাত্ররাজনীতির দিকে অভিযোগের তীর তুলে আরও বলেন, ‘শুধুমাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডই নয়, এর আগেও অসংখ্য শিক্ষার্থীকে র্যাগিং কিংবা ছাত্ররাজনৈতিক দাপটের মাধ্যমে অমানুষিকভাবে নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা রয়েছে। যা বুয়েটের র্যাগিং স্টোরি আর্কাইভে সারি সারি আকারে লিপিবদ্ধ আছে। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার শাহরিয়ারকে স্ট্যাম্প দিয়ে রাতভর বেধড়ক মারধর করা হয়। ১৭ ব্যাচের মেহজাদ গালিবকে নগ্ন করে সোহরাওয়ার্দী হলের ছাদে তুলে স্ট্যাম্প দিয়ে সারারাত মারা হয়। ১৫ ব্যাচের সামিউত তৌসিফকে মেরে হাত পা ভেঙে দেয়। মারতে মারতে তিনটা স্ট্যাম্প ভেঙে ফেলা হয়। এই সামিউত তৌসিফ ছিল এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান, তার চাচা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহিদ। তার লিগামেন্ট ছিঁড়ে পায়ে ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। সালাম না দেওয়াতে সাখাওয়াত অভির হাত ভেঙে ফেলে আবরার ফাহাদের হত্যাকারী অমিত সাহা। সৌমিত্র লাহিড়ী থাপ্পড় দিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলে একজনের। এরকম আরও অসংখ্য কাহিনি রয়েছে।’
ছাত্ররাজনীতিবিহীন বুয়েটের পরিবেশ ছিল সর্বোচ্চ নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব। মৌলবাদী শক্তিকেও রুখে দিতে ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন ওই শিক্ষার্থীরা।
এ ছাড়া এতে দেশ-বিদেশে বুয়েটের বিভিন্ন সাফল্যের গল্প উল্লেখ করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুয়েট শিক্ষার্থী মনে-প্রাণে ধারণের কথা বলা হয়। শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতীয় মূল্যবোধ, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ আমাদের সবার জন্যই প্রযোজ্য এবং একান্ত পালনীয়। আমরা সাংগঠনিক রাজনীতির ঊর্ধ্বে এসেই এই সচেতনতা রাখি। অথচ অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কতিপয় ব্যক্তি বা গণমাধ্যমের তৎপরতায় ছাত্ররাজনীতিবিহীন বুয়েট ক্যাম্পাসকে জাতীয় চেতনার বিরোধী মতাদর্শের স্থান হিসেবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বিষয়টিতে আমরা অত্যন্ত ব্যথিত।’
দাবি পূরণ ও ছাত্ররাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস দাবিতে চলমান আন্দোলন দুর্দিন আখ্যা দিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আপনার কাছে সবিনয়ে অনুরোধ, আপনি আমাদের পাশে দাঁড়ান। আপনি সব সময় শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছেন, আমরা জানি এই দুর্দিনে আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না।’
বুয়েটের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাতের একটি বক্তব্য এতে তুলে ধরা হয়। ওই বক্তব্যে বলা হয়, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন অধ্যাদেশ করে শিক্ষকদের রাজনীতি, রাজনৈতিক কার্যকলাপ ইত্যাদির অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের জন্য অধ্যাদেশের খসড়া যখন বঙ্গবন্ধুর সামনে উপস্থাপন করা হয়, তখন তিনি বলেছিলেন যে এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয় নষ্ট করা চলবে না। খসড়া অর্ডিন্যান্স বঙ্গবন্ধু ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বুয়েটের শিক্ষকরা তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন। এই এজেন্ডাতে তিনি দেখা করতে রাজি হননি। তখন শিক্ষকরা কথা বলতেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীর সঙ্গে।’
প্রধানমন্ত্রী প্রতি আবেদন জানিয়ে শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলনে পাঠ করা ওই খোলা চিঠিতে বলেন ‘আপনার প্রতি আমাদের আকুল আবেদন, বুয়েটকে নিয়ে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে পলিসি গ্রহণ করেছিলেন, তার বাস্তবায়ন করুন। বুয়েটকে ছাত্র রাজনীতির বাইরে রাখুন, প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে হলেও। কারণ সুবিচারের জন্যই আইনের সৃষ্টি। আমাদের অনুরোধ, আপনি দয়া করে আমাদের ক্যাম্পাসে আসুন; ছাত্ররাজনীতিহীন বুয়েট গত কয়েকবছর ধরে শিক্ষার্থীদের জন্য যে আদর্শ ক্যাম্পাস হয়ে উঠেছে, সেটা আমরা আপনাকে দেখাতে চাই। আমরা আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমরা প্রযুক্তিবিদ্যায় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পেছনে ফেলে দিব শিগগিরই।’
আগামী ৫-৬ বছরের ভেতরে বুয়েট র্যাংকিং ৫০ এর মধ্যে চলে আসবে বুয়েট উপ-উপাচার্যের বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়, ‘শেষ কয়েকবছর এই প্রত্যয় নিয়েই প্রতিটি প্রকৌশল বিভাগে আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছি, ইতোমধ্যে যার ফলও পেতে শুরু করেছি। আমাদের এই পথচলা আপনিই নির্বিঘ্ন রাখতে পারেন। সেই আশাতেই এই চিঠি। আমরা, আপনার হাজারও সন্তান আপনার সহযোগিতার প্রতীক্ষায় আছি।’
চতুর্থ দিনের মতো ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন
বুয়েট শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের পঞ্চম দিন পার হতে চলছে। অন্যদিকে দাবি পূরণে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের চতুর্থ দিনেও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনে ছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তবে ওই দিন কোনো ব্যাচের পরীক্ষা না থাকলেও ক্লাস বর্জনে ছিলেন শিক্ষার্থীরা। যদিও অন্যান্য দিনের মতো প্রশাসনিক কার্যক্রম যথারীতিতে চালু ছিল।
আন্দোলনকারীদের সূত্রে জানা যায়, আজ বুধবারে একটি পরীক্ষা রয়েছে। বাকি পরীক্ষাগুলো ঈদের পর অনুষ্ঠিত হবে। তবে বুধবারের ক্লাস-পরীক্ষাতে অংশ নিবেন কি না এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে ক্লাস-পরীক্ষাগুলো বিগত দিনের মতই বর্জন থাকবে।
হ্যাশট্যাগ আন্দোলন
এদিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজেদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে বুয়েটে রাজনীতি না চেয়ে ‘হ্যাশট্যাগ’ আন্দোলন শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্ট্যাটাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেখানে বর্তমান থেকে শুরু করে সাবেক শিক্ষার্থীরা হ্যাশট্যাগে- ‘নো স্টুডেন্টস পলিটিক্স ইন বুয়েট’ লিখে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এ ছাড়া নাম পরিচয়, বিভাগ ব্যাচ উল্লেখ করে স্ট্যাটাসগুলোতে বলা হয়েছে, ‘একজন প্রাক্তন ছাত্র এবং এলামনাই হিসেবে, আমি বুয়েটে সব প্রকার সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে। বুয়েটের বর্তমান শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে আমি একাত্মতা ঘোষণা করছি এবং তাদের সফলতা কামনা করছি।’