‘বাবা-মা অনেক কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেছেন। ছয় বছর চলছে, এখনো অনার্স শেষ হয়নি। জানি না কবে শেষ হবে। বিভাগের এখন যে অবস্থা তাতে এ বছরও শেষ হবে বলে মনে হয় না। এক সঙ্গে ভর্তি হয়ে অন্য বিভাগের বন্ধুরা বিসিএসসহ অন্য সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন। কিন্তু আমরা পারছি না।’ আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী হৃদয় (ছদ্মনাম)। শ্রেণিকক্ষ-সংকট, শিক্ষকদের উদাসীনতা, শিক্ষক রাজনীতি, নির্দিষ্ট একাডেমিক ক্যালেন্ডার না থাকাসহ একাধিক কারণকে এ সংকটের জন্য দায়ী করেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের ২৫টি বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে সেশনজটের কারণে ১৫টি বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ১ হাজার ৩০ শিক্ষার্থী ৪৬তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। অন্যদিকে, সেশনজটমুক্ত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি বিভাগের ৪৩৩ শিক্ষার্থী অ্যাপিয়ার্ড দিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। যেসব প্রার্থীর অনার্স চতুর্থ বর্ষের সব পরীক্ষা বিসিএস আবেদনের আগে শেষ হবে, কিন্তু ফলাফল প্রকাশিত হবে না, তাদের অ্যাপিয়ার্ড বা অবতীর্ণ প্রার্থী বলা হয়। আগামী শুক্রবার ৪৬তম বিসিএসের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
জানা গেছে, ওই শিক্ষাবর্ষের ১৫টি বিভাগের এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী সেশনজটের কবলে পড়েছেন। এর মধ্যে কয়েকটি বিভাগের ফাইনাল পরীক্ষা চলমান রয়েছে। আবার অনেক বিভাগে কবে নাগাদ অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে সেটাও নিশ্চিত নয়।
শিক্ষার্থীরা জানান, সেশনজটের কারণে বিসিএসসহ অনেক সরকারি চাকরির পরীক্ষায় তারা অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। মাত্র ৯টি বিভাগ স্নাতক ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করতে পারলেও বাকি বিভাগগুলোতে সেশনজট তৈরি হয়েছে। এতে তারা অন্য শিক্ষার্থীদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছেন।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ছয়টি বিভাগের মধ্যে চারটি (সিএসই, গণিত, রসায়ন, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা) বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা সেশনজটের কারণে বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। অন্যদিকে, পদার্থবিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পেরেছেন।
জীব বিজ্ঞান অনুষদের চারটি বিভাগের মধ্যে একটির (কোস্টাল স্টাডিস অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট) শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। অন্যদিকে, মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছেন। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের চারটি বিভাগের প্রত্যেকটিতে সেশনজট রয়েছে। এই চার বিভাগের (মার্কেটিং, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ফিন্যাস অ্যান্ড ব্যাংকিং) ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা বিসিএসে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ছয়টি বিভাগের মধ্যে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ছাড়া চারটি (অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও লোক প্রশাসন) বিভাগে সেশনজট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে সমাজবিজ্ঞান বাদে বাকি বিভাগের অনার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষা কবে নাগাদ অনুষ্ঠিত হবে সেটাও অনিশ্চিত। অন্যদিকে, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে চালু হওয়া সমাজকর্ম বিভাগের কোনো ব্যাচ এখনো বের হয়নি।
কলা ও মানবিক অনুষদের চারটি বিভাগের দুটিতে জট রয়েছে। এ কারণে ইংরেজি ও বাংলা বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষার আবেদনও করতে পারেননি। এই অনুষদের দর্শন, ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের শিক্ষার্থীরাই বিসিএসের আবেদন করতে পেরেছেন। আইন অনুষদের আইন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা চার মাসে সেমিস্টার শেষ করে বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ছয়টি অনুষদের ১০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছয় মাসের সেমিস্টার শেষ করতে সময় লাগে নয় মাস, কখনো দশ মাসও। এরপর ফলাফল ঘোষণা করতে সময় লাগে আরও ছয় মাস। শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও প্রশাসনের তদারকির অভাবকে সেশনজটের মূল কারণ হিসেবে দেখছেন তারা। প্রশ্ন করেছেন, এক বিভাগ পারলে অন্য বিভাগ কেন পারবে না?
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান, কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন তানভীর কায়ছার বলেন, ‘করোনার কারণে অনেক বিভাগ একটু পিছিয়ে ছিল। আগামী দেড় মাসের মধ্যে আমাদের বিভাগের (ইংরেজি) অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়া হবে।’
অনুষদভুক্ত অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা কেন বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করতে পারিনি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘না জেনে মন্তব্য করতে চাই না। বিভাগের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলে বলতে পারব।’
বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ডিন ড. শফিউল আলম বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজটের সমস্যা দীর্ঘদিনের। বর্তমানে তা অনেকাংশে কমে এসেছে।’ আগামী দিনে সেশনজট শূন্যের কোটায় নামবে বলে অশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমি নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। বিষয়টি আমার দৃষ্টিগোচর হলো। ডিনদের সঙ্গে আলোচনা করে বিস্তারিত বলতে পারব।’