কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণের ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় বাদীর স্বাক্ষর ও নথি জালিয়াতি করে নিজের নাম কেটে দিয়েছিলেন প্রধান আসামি সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. রুহুল আমিন। এ ঘটনায় তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ সাদিকুল ইসলাম তালুকদার তাকে সহায়তা করার প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত সোমবার (১ জুলাই) কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে এই দুই কর্মকর্তাসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দুদকের কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন। একই সঙ্গে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, হুলিয়া ও ক্রোক-পরোয়ানা জারির আবেদন করেন তিনি।
বিশেষ জজ আদালতের নাজির মো. বেদারুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৯ নভেম্বর মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জমি অধিগ্রহণের প্রায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এ কে এম কায়সারুল ইসলাম চৌধুরী নামে মাতারবাড়ীর এক বাসিন্দা কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিনকে। মামলাটি আমলে নিয়ে আদালত দুদককে তদন্তের নির্দেশ দেন। মামলা হওয়ার পর এক নম্বর আসামি রুহুল আমিনের নাম বাদ দিয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে নথিপত্র পাঠান তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ মো. সাদিকুল ইসলাম তালুকদার।
দুদকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, আদালতের রেজিস্টারে লিপিবদ্ধের সময় দরখাস্তে জেলা প্রশাসক রুহুল আমিনসহ ২৮ জন আসামি ছিলেন। পরে তিনটি পৃষ্ঠা পরিবর্তন করে রুহুল আমিনকে বাদ দিয়ে দুই নম্বর আসামি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. জাফর আলমকে এক নম্বর আসামি করা হয়। আসামি ২৮ জনের জায়গায় ২৭ জন করা হয়। এসব করার সময় বাদীর জাল স্বাক্ষর দেওয়া হয়। পুরো নথিতে কাটাছেঁড়া ও লেখায় ঘষামাজা করে দুদকে পাঠানো হয়।
দুদক কক্সবাজার আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুর রহিম জানান, জালিয়াতির ঘটনা জানতে পেরে কয়েক দিন পর একই আদালতে বাদী কায়সারুল ইসলাম চৌধুরী জেলা প্রশাসক রুহুল আমিন, জেলা জজ সাদিকুল ইসলাম তালুকদারসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার দীর্ঘ তদন্ত শেষে দুদক গত সোমবার আদালতে পাঁচজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। মামলার নথি জালিয়াতিতে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করায় সাবেক জেলা প্রশাসক ও জেলা জজ ছাড়াও বাদীপক্ষের আইনজীবী মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নাজির স্বপন কান্তি পাল এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতের স্টেনোগ্রাফার মো. জাফর আহমদকে আসামি করা হয়েছে।
এ ছাড়া মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা দুইজন হলেন দুদকের কক্সবাজার আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আবদুর রহিম ও কক্সবাজারের সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) এস এম শাহ হাবিবুর রহমান।
দুদক ও আদালত সূত্র জানায়, মাতারবাড়ীতে তাপভিত্তিক কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৪১৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে চিংড়িঘের, ঘরবাড়িসহ অবকাঠামোর বিপরীতে ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতে চিংড়ি চাষে ক্ষতিপূরণের বিপরীতে বরাদ্দ ছিল ৪৬ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ থেকেই ২৫টি চিংড়িঘের দেখিয়ে ১৯ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার ৩১৫ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়।
এ ছাড়া ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজার সদর মডেল থানায় সাবেক জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিনসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা হয়।
২০১৭ সালের ২২ মে দুর্নীতির মামলায় জামিনের আবেদন করে বরখাস্ত জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এর আগে, একই মামলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জাফর আলম, জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার (এলও) সাবেক উচ্চমান সহকারী আবুল কাশেম মজুমদার, সাবেক সার্ভেয়ার ফখরুল ইসলাম ও কক্সবাজার আদালতের আইনজীবী নুর মোহাম্মদ সিকদারকে গ্রেপ্তার করে দুদক। মামলাটি চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
মুহিববুল্লাহ মুহিব/সালমান/