ঢাকা ২১ কার্তিক ১৪৩১, বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪

আছাদুজ্জামানের কত সম্পদ?

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৪, ০১:৩৬ পিএম
আছাদুজ্জামানের কত সম্পদ?
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়ার এক ছেলে আসিফ মাহদিনের নামে কেনা একটি জমির দলিলে (দলিল নং ৩৬২২, ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়) তার নামের পাশে ‘নাবালক’ শব্দ উল্লেখ করা আছে। বয়সও উল্লেখ করা আছে মাত্র ‘১১ বছর’। অথচ সেখানে তার পেশা উল্লেখ করা হয়েছে ‘ব্যবসা’! দলিলটি সম্পাদন হয় ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর।

আবার আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় কেনা জমির দলিলে তার পেশা কোথাও ‘গৃহিণী, আবার কোথাও ‘গৃহকর্ম’ বলে উল্লেখ করা হয়। যদিও তার নামে অন্তত ১১৩ কোটি টাকার সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে।

অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পত্তির তথ্য সম্প্রতি গণমাধ্যমে আলোচনায় আসার মধ্যে এবার আলোচনায় এল সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামানের সম্পত্তির প্রসঙ্গ। অবসরের আগে পুলিশের সর্বোচ্চ পদে আসীন ছিলেন বেনজীর আহমেদ। প্রায় ৩৫ বছরের চাকরিজীবন তার। ১৯৮৮ সালে মাসিক ১ হাজার ৪৭০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে চাকরিজীবন শেষ করেন ৭৮ হাজার টাকা বেতনে। সব মিলিয়ে পুলিশের সর্বোচ্চ পদে চাকরি করা এই কর্মকর্তা বেতন-ভাতা বাবদ আয় করেন ১ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা। অর্থাৎ ২ কোটি টাকারও কম। 

সেই হিসাবে সর্বশেষ ডিএমপি কমিশনারের দায়িত্বে থেকে অবসরে যাওয়া আছাদুজ্জামানের চাকরি জীবনের আয় আর কতই! যদিও তার নিজের, স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের নামে তিনি কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

জানা গেছে, আছাদুজ্জামান নিজের নামে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্পত্তি কেনার পর স্ত্রী-সন্তানদের নামে এসব সম্পদ গড়েন। তবে সেখানেই থামেননি। এর বাইরেও আত্মীয়স্বজনের নামেও সম্পদ গড়েছেন।

আছাদুজ্জামানের নিজের নামে করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর পূর্বাচলে সাড়ে ৭ কাঠার সরকারি প্লট (দলিল নং ৮৯৫০/২৩)। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৮ কোটি টাকা। আর আফতাবনগরে একটি ৬ কাঠার প্লট, যার মূল্য ৭ কোটি টাকার মতো। আবার পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটির মধ্যে একটি ৬.৯ কাঠার প্লট রয়েছে, যার মূল্য কমপক্ষে সাড়ে ৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাজধানীর অদূরে সাভারে ২ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে, যার আনুমানিক মূল্য ২ কোটি টাকা। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে দুটি প্লট আছে, যেগুলোর আনুমানিক মোট মূল্য ১০ কোটি টাকার মতো।

আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে থাকা সম্পদের মধ্যে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ১০ কাঠা জমিতে নির্মিত একটি ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। যার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। তা ছাড়া তিনি ইস্কাটন গার্ডেন ও ধানমন্ডিতে একটি ফ্ল্যাটের মালিক।

আসাদুজ্জামানের তিন সন্তানের নামে প্রায় ৭০ কোটি টাকার সম্পদ কেনার তথ্য সামনে এসেছে। এর মধ্যে তার ৩২ বছর বয়সী মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে রূপায়ণ স্বপ্ন নিলয় কন্ডোমিনিয়ামে ৪ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর মৌজায় একটি ৫ কাঠার প্লট, পূর্বাচলের ১ নম্বর সেক্টরে একটি ১০ কাঠার প্লট এবং মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় একটি জমির মালিক।

পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তার আরেক ছেলে আসিফ শাহাদাতের নামেও বেশ কিছু প্লট, ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজধানীর পূর্বাচল নিউ টাউন, আফতাবনগর ও রূপগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সম্পত্তি। এসবের আনুমানিক মূল্য অন্তত ২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া তার নামে ফরিদপুরে ১.৬৫ একর জমি আছে বলেও জানা গেছে, যার মূল্য অন্তত ১ কোটি টাকা।

কাগজপত্রে ব্যবসায়ী দেখানো হলেও আসিফ মাহদিন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত। তবে তার নামেও রাজধানীর নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় একটি বিলাসবহুল ট্রিপলেক্স বাড়ি রয়েছে। যার মূল্য অন্তত ১০ কোটি টাকা।

কেবল আছাদুজ্জামান ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামেই নয়, তার শ্যালক, চাচাতো ভাইসহ আত্মীয়স্বজনের নামেও আছে অনেক সম্পদ।

এদিকে আছাদুজ্জামানের দাবি, তিনি তার বোনদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে ৩২২ ডেসিমেল জমি পেয়েছেন। 

তিনি আরও দাবি করেন, বোনদের কাছ থেকে তিনি ২০১১ সালের ৩ নভেম্বর ও ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর উপহার হিসেবে আরও ৬৮ ও ২১৫ ডেসিমেল জমি পেয়েছেন। যদিও তার বোনদের আয়কর নথি থেকে সন্দেহ হয়, এত মূল্যবান সম্পদ তারা উপহার দেওয়ার মতো সচ্ছল কি না।

আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানকে রাজধানীর পূর্বাচলে একটি ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এতে ২০১৮ সালে রাজউক বিধিবিধানের লঙ্ঘন হয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। কারণ বিধি অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে প্লট বরাদ্দ পান না। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে তা হয়েছে। 

এদিকে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার চাঁদখলা মৌজায় আফরোজার ৪১ ডেসিমেল জমি রয়েছে, যা ২০১৭ সালে কেনা হয়েছিল (ডিড নং ৯৯৯৮/১৭)। ওই বছর একই মৌজায় (ডিড নং ১০৪৭২/১৭) তার নামে একটি ২৬ ডেসিমেল জমি কেনা হয়। দুই বছর পর একই মৌজায় (ডিড নং ১১২৮) তার নামে আরও ৩৯ ডেসিমেল জমি কেনা হয়। ২০২০ সালে জোয়ার সাহারা মৌজায় আফরোজার নামে ৫ কাঠা জমি কেনা হয় (ডিড নং ৫২৩২/২০)। ওই বছর একই মৌজায় (ডিড নং ৯৬৯৫) আরও ১০ কাঠা জমি কেনা হয় এবং তার ওপর একটি ৬ তলা ভবন নির্মাণ করা হয়।

২০১৮ সালে আফরোজা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কাইয়ামসির-কায়েতপাড়া মৌজায় দুটি জমি কিনেছিলেন। একটি ০.২৮ একর (ডিড নং ১৩১৯০/১৮) এবং একটি ৩২ ডেসিমেল (ডিড নং ১৩১৮৯/১৮)।

সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামানের বেকার শ্যালক নূর আলম ওরফে মিলনের নামেও গাজীপুরের শ্রীপুরে দেড় একর জমি আছে, যার মূল্য ২ কোটি টাকার মতো। আবার আছাদুজ্জামানের ভাগ্নে কালাম গাজীপুরে দেড় একর জমির মালিক, যার আনুমানিক মূল্য ১ কোটি টাকা।

আছাদুজ্জামানের গ্রামের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক ইব্রাহিম শেখ। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের কামারগ্রামের এই তত্ত্বাবধায়কের নামেও তিনি সম্পত্তি কিনেছেন। এই তত্ত্বাবধায়কের নামে গাজীপুর এলাকায় ১০০ ও ৬০ ডেসিমেল জমি রয়েছে, যেগুলোর আনুমানিক মূল্য ৩ কোটি টাকার বেশি।

তবে এসব সম্পদ অবৈধ আয়ে বা অপ্রদর্শিত আয় নয় বলে দাবি আছাদুজ্জামানের। তিনি বলেন, বাবার সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী আমি। উত্তরাধিকার সূত্রে ১০০ বিঘার বেশি জমি পেয়েছি আমি। এই জমি থেকে ১০ বিঘার মতো বিক্রি করে এসব সম্পদ কিনেছি।

ডিএমপির সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদের কমিশনার আছাদুজ্জামান প্রায় পাঁচ বছর এ দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে অবসর নেওয়ার পর তিনি আরও তিন বছর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অধীনে জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভালো অফিসারদের একজন হিসেবে আছাদুজ্জামান ২০১৭ ও ২০১৯ সালে দুই বার বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (সাহসী) এবং দুই বার রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (সাহসিকতা) পান। 

আলোচনায় আসা সম্পদের ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য এসেছেন। তার সব সম্পদ বৈধ আয়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে কেনা। কয়েক দিন পর তিনি দেশে ফিরে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাবেন।

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ‘মুহূর্তেই পরিবেশ নীরব’

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২০ পিএম
আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৭ পিএম
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ‘মুহূর্তেই পরিবেশ নীরব’
রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় গত সোমবার রাতে চেকপোষ্ট বসিয়ে ডিএমপির ডগ স্কোয়াড দিয়ে দূরপাল্লার বাসে তল্লাশী চালানো হয়। ছবি: খবরের কাগজ

ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান ও তল্লাশি চালাচ্ছে যৌথ বাহিনী। যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছে সেনাবাহিনী। যৌথ বাহিনী যেখানেই অভিযান চালাচ্ছে, সেখানেই মুর্হূতেই পরিবেশ নীরব হয়ে যাচ্ছে। তাদের দেখে লোকজনের আনাগোনা কমে যাচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিকল্প পথে গাড়ি চলাচল। অপরাধীরা দ্রুতই ওই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার ধরাও পড়ছে। 

যৌথ বাহিনীর উপস্থিতিতে দখলদাররা তাদের দখলদারত্ব ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তবে নিরীহ লোকজন যৌথ বাহিনীর অভিযানকে স্বাগত জানাচ্ছে। কেউ আবার সেনাসদস্যদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলছেন। তাদের সাধুবাদ জানাচ্ছেন। কিছু বিষয়ে অভিযোগ করছেন সরাসরি। সেই সব অভিযোগ লিখে রাখছেন যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। রাজধানী ঢাকার ৩ এলাকায় সরেজমিনে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে। 

মিরপুর-১ নম্বর গোল চত্বর এলাকায় মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, যৌথ বাহিনীর তিনটি গাড়ি শাহ আলী প্লাজার সামনে এসেছে।

সেনাবাহিনীর গাড়িতে একজনকে হান্ডকাফ পরা অবস্থায় দেখা গেল। তার কাছে স্বল্প পরিমাণ গাঁজা পেয়েছে যৌথ বাহিনী। যৌথ বাহিনীর তিনটি গাড়ি দেখে ঘিরে ধরেছেন পথচারীরা। লোকজনের প্রচণ্ড ভিড়। সেনাসদস্যরা তাদের চলে যেতে জোরে ধমক দিলে মুহূর্তেই মানুষের ভিড় কমে যায়। চার সেনাসদস্যের হাতে লাঠি দেখা যায়। তারা ওই লাঠি দিয়ে সড়কে বিভিন্ন যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন। অন্যদিকে এক সেনাসদস্য ও এক পুলিশের সদস্য গাড়ির কাগজপত্র দেখছেন।

সোহেল নামে এক মোটরসাইকেলচালকের কাগজ মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে তাকে মামলা দিল ট্রাফিক পুলিশ। আরেক মোটরসাইকেলচালককে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। জানা গেল তার নাম সুমন। কেন তাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, তার হেলমেটটি ভাঙা। গলায় বাঁধানোর ফিতা নেই। এ জন্য তাকে দাঁড় করানো হয়েছে। তিনি বারবার যৌথ বাহিনীর সদস্যদের কাছে তাকে ছেড়ে দেওয়ার কাকুতি-মিনতি করছিলেন, কিন্তু তাকে ছাড়া হয়নি। 

তাকে বলা হয় দেড় ঘণ্টা একস্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে। তবেই তাকে ছাড়া হবে। এর আগে তাকে ছাড়া হবে না। এ ছাড়া যৌথ বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন গাড়ি থামিয়ে যানবাহনের কাগজ পরীক্ষা করতে দেখা গেল। গাড়ির ভেতর কোনো মাদক বা বিস্ফোরক পণ্য আছে কি না, তা তন্নতন্ন করে খোঁজ করলেন। 

যৌথ বাহিনীতে পুলিশের সদস্য এসআই নাজমুল জানান, বর্তমানে অপরাধের মাত্রা কমানোর জন্য অভিযান চলছে। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য মানুষের মন থেকে ভয় দূর করা। জনসচেতনতা সৃষ্টি করার পাশাপাশি অপরাধীদের কাছে বার্তা দেওয়া যে, কোনো ধরনের অপরাধ করে কেউ ছাড় পাবে না। 

আরিফ নামে এক ব্যবসায়ী জানান, ৫ বছর আগে এক ব্যবসায়ীর কাছে তিনি ৩ লাখ টাকা পাবেন। কিন্তু সেই টাকা তিনি ফেরত দিচ্ছিলেন না। যৌথ বাহিনীর সদস্যরা আসার পরেই ওই ব্যবসায়ী তার দোকান বন্ধ করে পালিয়ে গেছেন। 

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানালেন, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গত অক্টোবর মাস থেকে একটি প্রভাবশালী দল তাদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। তারা বিষয়টি যৌথ বাহিনীর সদস্যদের জানিয়েছেন। কারা তাদের কাছে চাঁদা দাবি করেন তাদের নাম জানানোর অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। 

গতকাল বিকেলে রাজধানীর সেগুনবাগিচার এনবিআরের অফিসের সামনে গিয়ে দেখা গেল, যৌথ বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে ফুটপাতের অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটি বুলডোজার দিয়ে সেগুলো ভাঙা হচ্ছে। আতঙ্কে ওই ফুটপাত থেকে তাদের দোকান সরিয়ে নিচ্ছেন অন্যরা। পাশাপাশি ওই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী গাড়িগুলোকে তল্লাশি চালাতে দেখা গেল। সাদা রঙের একটি গাড়িকে পাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। 

জানা যায়, ওই প্রাইভেট কারের কাগজপত্র ঠিক থাকলেও চালকের গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই। এ জন্য তাকে দাঁড় করানো হয়েছে। তাকে একটি মামলা দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে ট্রাফিক পুলিশকে দেখা গেল। স্থানীয় এক পান দোকানি জানান, ফুটপাতে কিছু দোকান থাকার কারণে পথচারীদের হাঁটতে কষ্ট হয়। বিষয়টি যৌথ বাহিনীর নজরে দিয়েছিল তারা। 

গত রবিবার রাতে খিলক্ষেত এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, খিলক্ষেত থানার একটু দূরেই যৌথ বাহিনীর সদস্যরা অভিযান শুরু করেছেন। সেনাবাহিনীর ৬ স্বতন্ত্র এডিএ ব্রিগেড, ট্রাফিক পুলিশ এবং খিলক্ষেত থানার পুলিশকে ওই অভিযানে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। যৌথ বাহিনীর সদস্যরা ওই সড়কে চলাচলকারী সব গাড়ির লাইসেন্স পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। একাধিক গাড়িকে মামলাও দেওয়া হয়। বিশেষ করে যেসব গাড়ি বিমানবন্দরে যাচ্ছে এবং বিমানবন্দর দিয়ে আসছে সেই সব গাড়িতে বিশেষ করে তল্লাশি চালাতে দেখা গেছে।

মোহাম্মদপুরের বিষফোড়া জেনেভা ক্যাম্প

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪০ পিএম
আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩২ পিএম
মোহাম্মদপুরের বিষফোড়া জেনেভা ক্যাম্প
রাস্তা দখল করে গড়ে উঠেছে জেনেভা ক্যাম্পের টোল মার্কেট। ছবি: খবরের কাগজ

মোহাম্মদপুরের বাবর রোড, হুমায়ুন রোডসহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের জন্য জেনেভা ক্যাম্প এখন একটি ‘বিষফোড়া’য় পরিণত হয়েছে। স্থানীয় জনগণের মতে, মোহাম্মদপুরে যত অপরাধ সংঘটিত হয়, তার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে এই জেনেভা ক্যাম্প। এখানকার টোল মার্কেট বিহারিদের দখলে চলে গেছে। মুরগিপট্টিতে জেঁকে বসেছে মাদক কারবার। এ ছাড়া প্রতিরাতেই শোনা যায় গুলির শব্দ। এ জন্য ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখেন স্থানীয়রা।

বাবর রোডের বাসিন্দারা বিভিন্ন সময়ে বিহারিদের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে মোহাম্মদপুর থানা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, র‌্যাব-২, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর- এই চার সংস্থা বরাবর তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা লিখিতভাবে জানিয়েছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সমস্যা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

স্থানীয়রা খবরের কাগজকে জানান, এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়াকে নিরুৎসাহিত করতে, সর্বোপরি তাদের শান্ত রাখা এবং মানবিক কারণেই এখানে বিহারিদের বসবাসের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

রিকশার ব্যাটারি চার্জ চলছে অবৈধভাবে 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেনেভা ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকার বেশ কয়েকটি সড়ক অত্যন্ত সরু। ফলে আগুন লাগলে তা সবার জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এমন পরিস্থিতির মধ্যেই এই এলাকায় ক্যাম্পের বাসিন্দারা অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহার করছেন। প্রতিদিনই এই এলাকা থেকে কয়েক শ রিকশার ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার জন্য সন্ধ্যা থেকেই লোকজনকে লাইন ধরতে দেখা যায়। কিন্তু বিল দেওয়ার প্রক্রিয়া চালু না থাকায় এখান থেকে সরকার কোনো আয় পাচ্ছে না। প্রতিটি রিকশার ব্যাটারি চার্জ দেওয়া বাবদ ২০০ টাকা করে নেওয়া হয়, যা চলে যায় বিহারিদের কয়েকজন সর্দার বা নেতার কাছে।

পরিবেশের কারণে অনেকেই বাসা ছাড়ছেন
সরেজমিনে দেখা যায়, বাবর রোডে পশু জবাই ছাড়াও এই সড়কের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা কয়েক শ মুরগির দোকান ও কাঁচাবাজারের জন্য এই এলাকার পরিবেশ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। ফলে এখানে বসবাস করা বাসিন্দাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে অনেকে নিজের ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্য এলাকায় ভাড়া বাসায় উঠছেন।

১৯৭১ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৫ একর জায়গায় এখন ৬০ হাজারের মতো মানুষ বসবাস করছে এই জেনেভা ক্যাম্পে। এলাকার জনসংখ্যাও ক্রমেই বেড়ে চলছে। ক্যাম্পের উত্তরে বাবর রোডের অভিজাত আবাসিক এলাকা, দক্ষিণ পাশে মোহাম্মদপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ, দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় মোহাম্মদপুর হাইস্কুল ও আবাসিক এলাকা এবং পূর্ব পাশে হুমায়ুন রোডের আবাসিক এলাকা। মাঝখানে ১৫ একর জায়গাজুড়ে জেনেভা ক্যাম্প। এখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সব সময়ই খারাপ ছিল। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আবারও অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে উঠছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, অবস্থাটা এমন, মনে হচ্ছে সবাই যেন স্বাধীন হয়ে গেছে। কেউ কাউকে তোয়াক্কা করছে না।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর তিনটি ক্যাম্প ছাড়াও সার্বক্ষণিক টহলে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অস্ত্রের ঝনঝনানি, মাদক কারবার, বাজার-ফুটপাত দখল, হত্যা, ছিনতাই ও গুলিবিনিময় নৈমিত্তিক ঘটনা। গত দুই মাসে রীতিমতো আতঙ্কের জনপদ হয়ে উঠেছে এই এলাকা। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

চার সংস্থাকে যেসব অভিযোগ দিয়েছিলেন স্থানীয়রা
২০২২ সালের এপ্রিলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে করা অভিযোগ থেকে জানা যায়, ফ্ল্যাট-বাড়ির সামনে রাস্তায় বিহারিদের হোটেল, মুরগির দোকান, কসাইখানাসহ বিভিন্ন দোকান রয়েছে। মুরগি, গরু, ছাগলের রক্ত, মলমূত্রে রাস্তা সব সময় নোংরা থাকে। বর্জ্যের কারণে স্যুয়ারেজ লাইন বন্ধ হয়ে নোংরা পানিতে রাস্তা ভেসে যায়। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নিয়মিত রাস্তা পরিষ্কার করেন না বলেও তারা লিখিত অভিযোগ করেন। 

গত ২৩ সেপ্টেম্বর আরেকটি অভিযোগে অসমাপ্ত রাস্তার কাজ শেষ করা, ফুটপাত দখলমুক্ত করা ও সিটি করপোরেশনের টোল প্রদান না করা দোকান উচ্ছেদ করার আবেদন করা হয়। এ ছাড়া বাবর রোডের দক্ষিণ পাশের সড়ক দখল করে গড়ে ওঠা টোল মার্কেট উচ্ছেদ করার দাবিও জানানো হয়। 

চলতি বছরের মার্চে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগে বাসিন্দারা জানান, ক্যাম্পের ভেতরে অপরিকল্পিতভাবে শত শত ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে। প্রতিটি ঘরেই রয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার, চোরাই গ্যাস লাইন, হিটার ও ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগ। এ ছাড়া বিয়ে, উরস ও জিয়াফতসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাঠ জ্বালিয়ে রান্নার কাজ করা হয়। এসব কারণে এই এলাকা অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে বাসিন্দারা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। 

এ ছাড়া র‌্যাব-২ ও মোহাম্মদপুর থানায় আরও জানানো হয়, অতিরিক্ত শব্দ করে সারা রাত গানবাজনা হয়। এছাড়া রাস্তায় মাদক বিক্রি করা হয়। 

বাবর রোডের একাধিক বাসিন্দা খবরের কাগজকে জানান, প্রতিদিন রাতে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। যে কারণে সব সময়ই তারা জানালা-দরজা বন্ধ রাখেন। এ ছাড়া বাসার সামনে  মাদক কারবারিদের আনাগোনা সব সময়ই থাকে। বাসা থেকে বের হলেই মাদক কেনার জন্য চারপাশ থেকে কারবারিরা ঘিরে ধরেন। ফলে দিনের বেলায় বিশেষ প্রয়োজনে বের হলেও সন্ধ্যার পরে তারা বাসা থেকে বের হন না। 

তারা আরও জানান, ক্যাম্পের বাসিন্দারা এখন তাদের জন্য বিষফোড়া। মুরগিপট্টির গোলাম কসাই, বাবু, আজগর, নাদিম, চট্টি, সোনিয়াসহ আরও বেশ কয়েকজন এই ব্যবসার আড়ালে আসলে মাদক ব্যবসা করেন। এ ছাড়া মাদক বিক্রি, রাস্তায় ময়লা ফেলা, পশু জবাই ও গাড়িতে হামলা করা প্রতিদিনের ঘটনা। এসবের প্রতিবাদ করলেই বাসিন্দাদের গায়ে হাত তোলা থেকে হত্যার হুমকিও দিয়ে থাকে দুর্বৃত্তরা। 

এ ধরনের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণের জন্য তারা মোহাম্মদপুর থেকে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিলেও কোনো প্রতিকার পাননি বলে জানান এই রোডের বাসিন্দারা। তবে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প হওয়ার পর এখন তারা স্বস্তিবোধ করছেন।

সম্প্রতি বাবর রোডের মুরগিপট্টির পাশে নিজ ফ্ল্যাট ছেড়ে ভাড়া বাসায় উঠেছেন নাজমুল ইসলাম। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিহারিরা কোনো শৃঙ্খলা মানতে চায় না। তারা সারা রাত জেগে গানবাজনা করে ও দিনের বেলায় ঘুমায়। বাসার সামনে নোংরা করে রাখে। আর মাদক বিক্রি তো সাধারণ ঘটনা। বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনকে তাদের বিষয়ে জানিয়ে কোনো লাভ হয়নি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তো বসবাস করা যায় না। এখন ভাড়া বাসায় থাকছি।’ 

বাবর রোডের অবসরে যাওয়া আরেক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকার আমাদের জন্য প্লটগুলো দিয়েছিল। এখানে বাড়ি বানিয়ে বিপদে পড়েছি। এই বিহারি ক্যাম্প এখান থেকে না সরালে কোনোভাবেই বসবাস সম্ভব নয়। সরকারের কাছে জোর দাবি, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক।’

জেনেভা ক্যাম্পের দক্ষিণ পাশের রাস্তা দখলে নিয়ে বিহারিরা গড়ে তুলেছে একটি টোল মার্কেট। এখানে মুদি দোকান দেওয়ার পাশাপাশি কাঁচাবাজারের ব্যবসা করছে তারা। এই টোল মার্কেটের দোকানগুলো তাদের আয়ের অন্যতম উৎস।

টোল মার্কেটে ৩৬৫টি দোকান রয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক মুদি দোকানদার। টোল মার্কেটের ভাই ভাই জেনারেল স্টোরের আবু তালেব খবরের কাগজকে বলেন, এই মার্কেটের দোকানগুলোর একাধিক মালিক ও তারা সবাই বিহারি। ৮ হাজার টাকা দোকান ভাড়া দেন। এ ছাড়া মাসে ৫০ হাজার টাকার মতো আয় হয় বলে জানান এ প্রতিবেদককে। 

এখানে তো প্রতিদিনই মাদক বিক্রি নিয়ে গোলাগুলি হয়, কীভাবে ব্যবসা করেন- উত্তরে আবু তালেব বলেন, ‘এইডা কোনো ব্যাপার না। এই হানে এইডা সাধারণ ঘটনা।’ 

বাবর রোডে প্রতিদিনই ভোর থেকে কয়েক শ গরু জবাই করা হয়। এই গরুর মাংস রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয়। গরু জবাইয়ের কাজটি করে থাকেন গোলাম কসাইসহ বেশ কয়েকজন। গোলাম কসাই খবরের কাগজকে বলেন, ‘এতটুকু জায়গার মধ্যে এত মানুষ থাকে। জায়গা না থাকায় রাস্তায় গরু জবাই করি।’ তবে কসাই পেশার আড়ালে মাদক বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্যাম্পে মাদক ব্যবসায় বেশি জড়িত নারীরা। এই কাজে তারা কোলের শিশুদেরও ব্যবহার করেন। মুরগিপট্টিতে ইয়াবা কারবারি হিসেবে পরিচিত চট্টি ও তার বোন সোনিয়া। সম্প্রতি ইয়াবাসহ সোনিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সোনিয়ার বিষয়ে চট্টি খবরের কাগজকে বলেন, ‘হুদাই (শুধু শুধু) ধরছে, ধরলে টাকা পাওন যায়।’ মাদকসহ ধরছে বলতেই তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘কী মাদক, কিচ্ছু না, ভুয়া।’ 

সম্প্রতি যৌথ বাহিনীর অভিযানে মোহাম্মদপুরসহ জেনেভা ক্যাম্পে শতাধিক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে বুনিয়া সোহেল নামের একজন নেতা রয়েছেন। 

মোহাম্মদপুর প্রধান সেনাক্যাম্পের একজন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে জানান, জেনেভা ক্যাম্প হচ্ছে অপরাধীদের আশ্রয়স্থল। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হয়েছে। তবে ক্যাম্পে প্রচুর অলিগলি থাকায় অপরাধীদের ধরতে বেগ পেতে হয়। অভিযানের পর এই এলাকায় অপরাধ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি। 

মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘মোহাম্মদপুর এখন অপরাধের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। যোগদানের পর থেকে আমি অপরাধ দমনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। জেনেভা ক্যাম্পসহ পুরো মোহাম্মদপুরে পুলিশ প্রতিদিনই টহল দিচ্ছে। অপরাধ এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।’

তিনি বলেন, ‘মাদক বিক্রির টাকা নিয়ে গোলাগুলি তাদের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দমনে পুলিশ কাজ করছে। খবর পাওয়া মাত্রই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এই থানাতে প্রতি মাসে গড়ে ২০০ মামলা হতো। আমি আসার পর শক্ত হাতে অপরাধ দমনের চেষ্টা করছি। ফলে মামলার সংখ্যাও কমে এসেছে।’ 

বাবর রোডের বাসিন্দাদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা থানা থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। তবে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের পুনর্বাসন করা না গেলে এই এলাকার অপরাধ পুরোপুরি দমন করা সম্ভব হবে না।’

প্রত্যাশিত ব্যক্তিদের নিয়ে ইসি কমিশন গঠনে শঙ্কা

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০০ পিএম
আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১৩ পিএম
প্রত্যাশিত ব্যক্তিদের নিয়ে ইসি কমিশন গঠনে শঙ্কা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

বাংলাদেশের ১৪তম নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে গত ৩১ অক্টোবর ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে সরকার। কিন্তু ২০২২ সালে করা বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন সংস্কারের আগেই এই কমিটি গঠন হওয়ায় এবারও ইসিতে যথাযথ ব্যক্তিদের মনোনয়ন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

তবে যে আইনেই গঠিত হোক, এবারের সার্চ কমিটি জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, সার্চ কমিটি গঠনের পরও আইনি সংস্কারে কোনো বাধা নেই। তার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব তৈরির কাজ অব্যাহত রয়েছে।

এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি ও সংস্কারকাজ একসঙ্গে এগিয়ে নিতে চলমান আইনেই সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। জনমতকে প্রাধান্য দিয়েই গঠিত হবে নতুন নির্বাচন কমিশন।

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের আগে কোনো ধরনের আইন ছাড়াই নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। মূলত ক্ষমতাসীন সরকারের পছন্দ-অপছন্দের তালিকা অনুসারে তখন নির্বাচন কমিশন গঠিত হতো। ২০২২ সালের আগে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে একটি সার্চ কমিটি হলেও তার ফলাফল ছিল ‘রাতের ভোটের’ নির্বাচন কমিশন। পরবর্তী সময়ে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে যে কমিশন গঠিত হয়, সেটিও একটি প্রহসনের নির্বাচন উপহার দেয়। ফলে পুরোনো আইনে গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে এবারে কেমন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয় এবং তারা নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে কতটা ভালো নির্বাচন উপহার দেয়, তার ওপরেই দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে। 

তারা বলছেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের প্রথম ধাপ হলো ইসি গঠনের সঠিক পদ্ধতি নির্ধারণ। আর ২০২২ সালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের বিদ্যমান আইনটি নানা মহলে বিতর্কিত। কারণ আইনটিতে রয়েছে নানা অসংগতি ও ফাঁকফোকর। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রস্তাব পাওয়ার আগেই কেন তাড়াহুড়ো করে সার্চ কমিটি গঠন করা হলো তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে। অনেকে বিতর্কিত আইনে গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত নতুন ইসি কমিশন গঠন হলে নতুন করে বিতর্ক উঠতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন। 

২০২২ সালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা আইনটি সম্পর্কে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মামুনুর রশীদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ওই আইনে রয়েছে নানা অসংগতি ও ফাঁকফোকর। সেটি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ আইন-২০২২’ নয়; শিরোনাম হওয়া উচিত ছিল, ‘নির্বাচন কমিশন আইন-২০২২’। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনে পূর্ণাঙ্গ আইন তথা ‘নির্বাচন কমিশন আইন-২০২৪’ প্রণয়ন করা জরুরি ছিল। অথচ সেটি না করে ওই আইনেই সার্চ কমিটি করা হলো। এতে নতুন ইসি কমিশনে যথাযথ ব্যক্তির মনোনয়ন নিয়ে শঙ্কা রয়েই গেল। নতুন আইন হলে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের স্পষ্ট বিধান অনুযায়ী ইসির কাজ, সংবিধান নির্দেশিত ক্ষমতার প্রয়োগ এবং স্বচ্ছতা, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণের নানা আইনি ও আইনবহির্ভূত রাজনৈতিক বাধা দূর হতো। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় বিধানাবলি সংযোজন, কমিশনের অর্থায়ন, নিয়োগ, নির্বাচনকালে নিজ বিবেচনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে স্পষ্ট আইনি বিধান সংযুক্ত করা দরকার ছিল। আর সেটা হলে কমিশন যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে তাদের সাহসী সিদ্ধান্তে অটল থাকতে সক্ষম হতো বলে মনে করি।’ 

ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচনব্যবস্থার আইনি সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধান বিষয় হচ্ছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি গঠনের বিধান করা। যতটুকু জানি সংস্কার কমিশন বিতর্কিত আইনটি সংস্কারের জন্য প্রস্তাব তৈরি করছে। অথচ সেই প্রাথমিক পদক্ষেপে সরকার তাড়াহুড়ো করায় জনমনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আর সংস্কার কমিশন তার রিপোর্ট শেষ করার আগেই পুরোনো আইনে সার্চ কমিটি গঠন হওয়ায় বোঝা গেল এখনো কোনো সংস্কার বাস্তবায়িত হয়নি। এটি সংস্কার কমিশন এবং সরকারের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ব্যাপার। তারপরও বলতে চাই, যেহেতু সার্চ কমিটি হয়েছে, তাই নির্বাচনি সংস্কার কমিশন যেন একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠায় করতে সার্চ কমিটিকে সহযোগিতা করে। নতুন কমিশন গঠনের পুরো প্রক্রিয়ায় যেন স্বচ্ছতা থাকে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের মতামতকে যেন প্রাধান্য দেওয়া হয়।’

রাজনৈতিক দলগুলোও চলমান আইনের সমালোচনা করে তা সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছিল। এই আইন পাসের আগে একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যসহ বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও গণফোরামের ১২ জন সংসদ সদস্য ৭৬টি সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২২টি সংশোধনী গ্রহণ করা হয়েছিল, যার সবই ছিল মূলত শব্দগত পরিবর্তন। পদ্ধতিগত পরিবর্তনের কোনো প্রস্তাব আমলে নেওয়া হয়নি।

সার্চ কমিটি প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘সিইসিসহ কমিশনাররা তো অনেক দিন আগেই পদত্যাগ করেছেন। ফলে সরকার চাইলে এই কমিটি অনেক আগেই করতে পারত। একই সঙ্গে নির্বাচনের অন্যান্য প্রস্তুতিও নেওয়া যেত। দেশের জনগণ নির্বাচন চায়। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে এখনো যদি সরকার নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করে, তাহলে দেশের জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে। তাই সংস্কার ও নতুন ইসি কমিশন গঠনের পাশাপাশি সরকারকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানাচ্ছি।’ 

সার্চ কমিটি গঠনকে সরকারের ইতিবাচক ও গঠনমূলক পদক্ষেপ উল্লেখ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘ইসি গঠনে আইনি পুরোনো সব ফাঁকফোকর রয়েই গেল। এখনো যদি বিদ্যমান আইনেই সার্চ কমিটি করা হয়, তাহলে এতসব সংস্কার উদ্যোগের উদ্দেশ্য কী ছিল? এই কমিটি গঠনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। তাড়াহুড়ো করে গঠিত এই সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত কমিশন সম্পর্কে জনগণের উদ্বেগ পুরোপুরি সমাধান কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’

এদিকে যে আইনেই গঠিত হোক না কেন, এবারের সার্চ কমিটি নিয়ে আশাবাদী সংস্কার কমিশন। কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘এমন ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠিত হয়েছে, যারা অত্যন্ত সম্মানিত এবং সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত। আশা করি এই কমিটির সদস্যরা নতুন নির্বাচন কমিশনে যোগ্য ব্যক্তিদের মনোনীত করবেন।’ 

বর্তমান আইনটি প্রকৃতপক্ষে দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি সংস্কারের বিকল্প নেই। সার্চ কমিটি তার নিজস্ব গতিতে কাজ করবে এবং আমরা আমাদের মতো কাজ করব। যে প্রস্তাবগুলো দেব তার কিছু সরকার এবং কিছু নির্বাচন কমিশন বাস্তবায়ন করবে। তাই সার্চ কমিটির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকায় ওই কমিটি গঠনের পর সংস্কারে কোনো বাধা নেই। সার্চ কমিটি আইনে সংশোধনীর প্রস্তাব তৈরির কাজ চলছে।’ 

সুনির্দিষ্ট পরিবর্তনগুলো বিবেচনা করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি। তবে বলতে পারি আইনে বিদ্যমান সব ঘাটতি পূরণে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংস্কারে আমাদের লক্ষ্য, অংশীজনদের (রাজনৈতিক দল) কাছ থেকে পাওয়া মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রস্তাব তৈরি করা।’

আইনি সংস্কারের আগেই কেন সার্চ কমিটি- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মো. শফিকুল আলম বলেন, ‘উদ্বেগ সম্পর্কে আমরা অবগত। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের কাজ একযোগে এগোবে। যদিও সংস্কারকাজ চলছে, নির্বাচনের প্রস্তুতিও এগিয়ে নিতে হবে। কারণ নির্বাচন আয়োজনের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়। নির্বাচনি প্রক্রিয়ার কাজে সময় বাঁচাতে আমরা সার্চ কমিটি গঠন ত্বরান্বিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় সব রাজনৈতিক দল সময়মতো নির্বাচনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। আমরাও সময় বাঁচাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘চলমান আইনে গঠিত হলেও এবারের সার্চ কমিটিতে নিযুক্ত ব্যক্তিরা সবার পরিচিত, জ্ঞানী এবং নিরপেক্ষ। তাদের লক্ষ্য সিইসি এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এমন প্রার্থীদের মনোনীত করা; যারা সবার কাছে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে নির্বাচনের সার্বিক প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি নিশ্চিত করা।’

গত আগস্ট মাসে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গত ৩ অক্টোবর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের কার্যকালের মেয়াদ ৯০ দিন আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে কমিশনকে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে প্রস্তাবিত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। একই মাসে গত ৩১ অক্টোবর, সরকার হঠাৎ করে একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’-এর অধীনে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। 

২০২২ সালে করা আইনে প্রথম গঠিত হয় কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন। সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত ১০ জনের নাম থেকে পাঁচজনকে বেছে নিয়ে নতুন কমিশন গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রাশেদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এক মাসের মাথায় শিক্ষার্থী-জনতার চাপের মুখে ৫ সেপ্টেম্বর বিদায় নেয় কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন, যাদের অধীনে এ বছরের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছিল।

পাপুলের স্ত্রী এক বছরে কেনেন ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৫ পিএম
আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ পিএম
পাপুলের স্ত্রী এক বছরে কেনেন ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের স্ত্রী সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলাম বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রায় হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। ৯ বছরে ১৬৪টি দলিলে বিশাল ওই সম্পত্তি গড়েছেন তিনি। ২০১৭ সালেই ৬১টি দলিলে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ কেনেন।

এর মধ্যে ঢাকার গুলশান, বারিধারা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, যাত্রাবাড়ী, দক্ষিণখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও প্লট। বসুন্ধরা শপিংমলেও রয়েছে একটি দোকান। এ ছাড়া কুমিল্লার মেঘনা থানার ৮টি মৌজায় প্রায় ১০০ একর জমি কিনেছেন। কক্সবাজারের একটি আবাসিক হোটেলের আংশিক মালিকানা রয়েছে। এ ছাড়া তার নামে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ৬৭০টি অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে। এসব অ্যাকাউন্টে প্রায় হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। সর্বশেষ ৬৯ কোটি টাকা স্থিতি রয়েছে।

সেলিনা ইসলামের কেনা বিশাল সম্পত্তির ১৬০টি দলিলের মধ্যে ২০১১ সালের ১৩টি ও ২০১২ সালের ৫টি দলিল এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এছাড়া ২০১৩ সালের একটি, ২০১৪ সালের ৪টি, ২০১৫ সালের ১৬টি, ২০১৬ সালের ২৯টি, ২০১৭ সালের ৬১টি, ২০১৮ সালের ২৩টি এবং ২০১৯ সালের ১২টি দলিল পাওয়া গেছে। এসব দলিলে যে মালিকানা রয়েছে সেগুলো হলো ঢাকার গুলশান-২ নম্বরে ৯৫ নম্বর রোডের সিইএন নামের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের দোতলায় (ডি/২) প্রায় ৩ হাজার স্কয়ার ফুটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ‘ডি’ ব্লকে ৮ নম্বর রোডে ৪৭৭ নম্বর প্লটে ৮ তলার বিশাল অট্টালিকা, পান্থপথে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে ১৫১ স্কয়ার ফুটের একটি দোকান, বারিধারায় ৫ কাঠার একটি প্লট, উত্তরার দক্ষিণখানে সাড়ে ৭ কাঠা করে দুটি প্লট, যাত্রাবাড়ীতে ৬ কাঠার একটি প্লট, কক্সবাজার জেলা শহরে একটি আবাসিক হোটেলের শেয়ার। এ ছাড়া কুমিল্লার মেঘনা থানার নারায়ণপুর, বলরামপুর, বড়লক্ষ্মীপুর, সেনেরচর, সোনাকান্দা, চালিভাঙ্গা, লুটেরচর ও মানিকারচর মৌজায় বাড়িভিটাসহ প্রায় ১০০ একর জমি কিনেছেন। সেখানে দোতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত অন্তত ৮টি বাড়ি রয়েছে। এক-একটি দলিলে ২ একর থেকে সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ জমি রয়েছে। 

এদিকে দুদক সূত্র জানিয়েছে, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তার স্ত্রী সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২০২০ সালের জুলাই মাসে তলব করেন দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দীন। অনুসন্ধান শেষে অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সেলিনা ইসলামের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ৭ জুন মামলা করা হয়। কিন্তু তৎকালীন সরকারের উচ্চ মহলের প্রভাবে সেই তদন্তকাজ এগোয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর তদন্তকাজ সচল হয়। বর্তমানে দুদক পরিচালক মোয়ানেম হোসেন মামলাটির তদন্ত করছেন। শিগগিরই সেলিনা হোসেনের যাবতীয় অর্থ-সম্পদ ফ্রিজ ও ক্রোকের আদেশ চেয়ে আদালতে আবেদন করা হবে। 

২০১৬ সালের আগে কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল ও তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামকে চিনতেন না কেউ। অথচ সেই কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলই লক্ষ্মীপুরের রায়পুরায় ‘টাকা ছড়িয়ে’ স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেন এবং লক্ষ্মীপুর-২ আসনে (রায়পুর-লক্ষ্মীপুর সদরের আংশিক) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর মানব পাচার ও ঘুষ লেনদেনের দুটি মামলায় ২০২১ সালে কুয়েতের ফৌজদারি আদালতে সাত বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ায় সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্য পদ হারান। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ে প্রভাব খাটিয়ে স্ত্রী সেলিনা ইসলামকে সংরক্ষিত মহিলা আসন-৪৯-এর সংসদ সদস্য করা হয়। 

কুয়েত আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক হিসেবে পরিচয় দেওয়া পাপুল ২০১৭ সালে দেশে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদের ফরম পূরণ করেন। এমপি হওয়ার পর ২০১৯ সালে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বর সদস্যপদ পান। নিজের পাশাপাশি স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও মেয়েকে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় নম্বরে সদস্য করেন। সেলিনা ইসলামের পৈতৃক নিবাস কুমিল্লায় এই তিন বছরে সবচেয়ে বেশি সম্পদ কেনা হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

মালয়েশিয়া যেতে না পারা ১৭ হাজার কর্মীর পাওনা আদায় অনিশ্চিত

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫০ এএম
মালয়েশিয়া যেতে না পারা ১৭ হাজার কর্মীর পাওনা আদায় অনিশ্চিত
ফ্লাইটের টিকিট না পেয়ে মালয়েশিয়া যেতে না পারা কর্মীদের বিমানবন্দরে ভিড়। ছবি : খবরের কাগজ

ফ্লাইটের টিকিট না পেয়ে মালয়েশিয়া যেতে না পারা প্রায় ১৭ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর পাওনা আদায় এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে গেছে। অথচ মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য প্রত্যেক কর্মী ৫ থেকে ৬ লাখ করে টাকা দালাল বা রিক্রুটিং এজেন্সির হাতে তুলে দিয়েছেন। সেই হিসাবে এসব কর্মীর প্রায় সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা এখন দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সির পকেটে। অর্থ ফেরতের জন্য কয়েকবার সময় বেঁধে দেওয়া হলেও বেশির ভাগ কর্মী কোনো টাকা বুঝে পাননি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মধ্যস্থতায় এসব টাকা ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসেনি। 

মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সাজ্জাদ হোসেন ভূঁইয়া এ বিষয়ে খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য টাকা জমা দেওয়া কর্মীরা প্রতারিত না হন। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার কর্মীর পাওনা আদায়ে রিক্রুটিং এজেন্সি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ে বৈঠক করেছি। তাদের পাওনা ফেরত না দিলে লাইসেন্স বাতিলের কথাও জানানো হয়। কিন্তু তারা নিজেরা আলোচনায় কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা আমরা এখনো জানতে পারিনি। বাকি ১২ হাজারের মধ্যে প্রায় ২ হাজার কর্মী আর মালয়েশিয়া যেতে চান না অথবা তারা তাদের কোনো নিকটাত্মীয়কে পাঠাতে চান। আর ১০ হাজারের মতো কর্মী আছেন যারা এখনো মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। কারণ গত মাসে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের ঢাকা সফরকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। দেশটির প্রধানমন্ত্রীও আশ্বাস দেন যে সে দেশে যেতে না পারা বাংলাদেশি কর্মীদের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবেন।’ 

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে খবরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে কর্মী নিয়োগ নিয়ে শিগগিরই যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হতে যাচ্ছে। সেখানে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগসংক্রান্ত সব বিষয়ে আলোচনা হবে। ভিসাসহ সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও ফ্লাইট স্বল্পতার কারণে যে ১৭ হাজার কর্মী যেতে পারেননি সেটা নিয়েও জোরালো আলোচনা হবে। এ ছাড়া প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলও মালয়েশিয়ার মানবসম্পদবিষয়ক মন্ত্রীর কাছে চিঠি দিচ্ছেন। চিঠিতে বঞ্চিত এসব কর্মীর ভিসা নবায়ন করার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাবে। 

মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র জানায়, ড. আসিফ নজরুল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর কয়েক দফা জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে জনশক্তি ব্যবসায়ীরা ১৭ হাজার কর্মীর পাওনা ফেরত দিতে সময় চান। তাদের অর্থ ফেরত দিতে ১০ দিনের সময় দেওয়া হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে এজেন্সির কাছে পাসপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে, সেই এজেন্সি টাকা ফেরত দেবে। 

সূত্র আরও জানায়, গত ৩১ মে পর্যন্ত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ জনকে মালয়েশিয়া যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ জন মালয়েশিয়া গেছেন। সেই হিসাবে ১৬ হাজার ৯৭০ জন যেতে পারেননি। এসব কর্মীর সম্পূর্ণ অর্থ রিক্রুটিং এজেন্টদের পরিশোধ করার কথা ছিল। কিন্তু এখনো সেটি নিষ্পত্তি হয়নি।

জানা গেছে, রিক্রুটিং এজেন্সিদের সংগঠন বায়রার অধিকাংশ নেতা ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে আছেন। এসব নেতার এজেন্সিকে যেসব কর্মী টাকা দিয়েছেন তা ফেরত দেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না কর্মকর্তারা। আর যারা দেশে আছেন এবং মন্ত্রণালয়ের শুনানিতে এসেছেন তাদের কাছ থেকে পুরো টাকা ফেরত পাচ্ছেন না কর্মীরা। কারণ মালয়েশিয়ার যাওয়ার জন্য মোট খরচ ৭৯ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু একজন কর্মী ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা দালাল বা রিক্রুটিং এজেন্সির হাতে তুলে দিয়েছেন। সেই হিসাবে সরকার নির্ধারিত ৭৯ হাজার টাকা বেশি দিতে না চাইলে মন্ত্রণালয়েরও খুব বেশি কিছু করার থাকে না। এ কারণে যারা টাকা ফেরত চান তারা এক থেকে দেড় লাখ টাকার বেশি ফেরত পাচ্ছেন না বলে সংশ্লিস্ট সূত্র জানিয়েছে। 

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, কর্মীরা বিদেশ যেতে দালালদের মাধ্যমে অনেকেই রিক্রুটিং এজেন্সির শরণাপন্ন হন। আবার কেউ কেউ সরাসরি দালালকে পুরো টাকা দিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে অর্থ বিনিময়ের কোনো প্রমাণ থাকে না। অর্থাৎ টাকা যে দেওয়া হয়েছে তার কোনো ডকুমেন্ট দেওয়া হয় না। এখন সরকার নির্ধারিত ফি হচ্ছে ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। কিন্তু বেশির ভাগই দিয়েছেন ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। তাহলে ওই টাকার ডকুমেন্ট বা প্রমাণ যদি না থাকে তাহলে ৭৮ হাজার টাকার বাইরে বাকি টাকা কর্মীরা কীভাবে পাবেন সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।