ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়ার এক ছেলে আসিফ মাহদিনের নামে কেনা একটি জমির দলিলে (দলিল নং ৩৬২২, ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়) তার নামের পাশে ‘নাবালক’ শব্দ উল্লেখ করা আছে। বয়সও উল্লেখ করা আছে মাত্র ‘১১ বছর’। অথচ সেখানে তার পেশা উল্লেখ করা হয়েছে ‘ব্যবসা’! দলিলটি সম্পাদন হয় ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর।
আবার আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় কেনা জমির দলিলে তার পেশা কোথাও ‘গৃহিণী, আবার কোথাও ‘গৃহকর্ম’ বলে উল্লেখ করা হয়। যদিও তার নামে অন্তত ১১৩ কোটি টাকার সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে।
অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পত্তির তথ্য সম্প্রতি গণমাধ্যমে আলোচনায় আসার মধ্যে এবার আলোচনায় এল সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামানের সম্পত্তির প্রসঙ্গ। অবসরের আগে পুলিশের সর্বোচ্চ পদে আসীন ছিলেন বেনজীর আহমেদ। প্রায় ৩৫ বছরের চাকরিজীবন তার। ১৯৮৮ সালে মাসিক ১ হাজার ৪৭০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে চাকরিজীবন শেষ করেন ৭৮ হাজার টাকা বেতনে। সব মিলিয়ে পুলিশের সর্বোচ্চ পদে চাকরি করা এই কর্মকর্তা বেতন-ভাতা বাবদ আয় করেন ১ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা। অর্থাৎ ২ কোটি টাকারও কম।
সেই হিসাবে সর্বশেষ ডিএমপি কমিশনারের দায়িত্বে থেকে অবসরে যাওয়া আছাদুজ্জামানের চাকরি জীবনের আয় আর কতই! যদিও তার নিজের, স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের নামে তিনি কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
জানা গেছে, আছাদুজ্জামান নিজের নামে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্পত্তি কেনার পর স্ত্রী-সন্তানদের নামে এসব সম্পদ গড়েন। তবে সেখানেই থামেননি। এর বাইরেও আত্মীয়স্বজনের নামেও সম্পদ গড়েছেন।
আছাদুজ্জামানের নিজের নামে করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর পূর্বাচলে সাড়ে ৭ কাঠার সরকারি প্লট (দলিল নং ৮৯৫০/২৩)। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৮ কোটি টাকা। আর আফতাবনগরে একটি ৬ কাঠার প্লট, যার মূল্য ৭ কোটি টাকার মতো। আবার পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটির মধ্যে একটি ৬.৯ কাঠার প্লট রয়েছে, যার মূল্য কমপক্ষে সাড়ে ৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাজধানীর অদূরে সাভারে ২ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে, যার আনুমানিক মূল্য ২ কোটি টাকা। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে দুটি প্লট আছে, যেগুলোর আনুমানিক মোট মূল্য ১০ কোটি টাকার মতো।
আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে থাকা সম্পদের মধ্যে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ১০ কাঠা জমিতে নির্মিত একটি ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। যার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। তা ছাড়া তিনি ইস্কাটন গার্ডেন ও ধানমন্ডিতে একটি ফ্ল্যাটের মালিক।
আসাদুজ্জামানের তিন সন্তানের নামে প্রায় ৭০ কোটি টাকার সম্পদ কেনার তথ্য সামনে এসেছে। এর মধ্যে তার ৩২ বছর বয়সী মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে রূপায়ণ স্বপ্ন নিলয় কন্ডোমিনিয়ামে ৪ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর মৌজায় একটি ৫ কাঠার প্লট, পূর্বাচলের ১ নম্বর সেক্টরে একটি ১০ কাঠার প্লট এবং মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় একটি জমির মালিক।
পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তার আরেক ছেলে আসিফ শাহাদাতের নামেও বেশ কিছু প্লট, ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজধানীর পূর্বাচল নিউ টাউন, আফতাবনগর ও রূপগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সম্পত্তি। এসবের আনুমানিক মূল্য অন্তত ২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া তার নামে ফরিদপুরে ১.৬৫ একর জমি আছে বলেও জানা গেছে, যার মূল্য অন্তত ১ কোটি টাকা।
কাগজপত্রে ব্যবসায়ী দেখানো হলেও আসিফ মাহদিন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত। তবে তার নামেও রাজধানীর নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় একটি বিলাসবহুল ট্রিপলেক্স বাড়ি রয়েছে। যার মূল্য অন্তত ১০ কোটি টাকা।
কেবল আছাদুজ্জামান ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামেই নয়, তার শ্যালক, চাচাতো ভাইসহ আত্মীয়স্বজনের নামেও আছে অনেক সম্পদ।
এদিকে আছাদুজ্জামানের দাবি, তিনি তার বোনদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে ৩২২ ডেসিমেল জমি পেয়েছেন।
তিনি আরও দাবি করেন, বোনদের কাছ থেকে তিনি ২০১১ সালের ৩ নভেম্বর ও ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর উপহার হিসেবে আরও ৬৮ ও ২১৫ ডেসিমেল জমি পেয়েছেন। যদিও তার বোনদের আয়কর নথি থেকে সন্দেহ হয়, এত মূল্যবান সম্পদ তারা উপহার দেওয়ার মতো সচ্ছল কি না।
আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানকে রাজধানীর পূর্বাচলে একটি ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এতে ২০১৮ সালে রাজউক বিধিবিধানের লঙ্ঘন হয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। কারণ বিধি অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে প্লট বরাদ্দ পান না। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে তা হয়েছে।
এদিকে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার চাঁদখলা মৌজায় আফরোজার ৪১ ডেসিমেল জমি রয়েছে, যা ২০১৭ সালে কেনা হয়েছিল (ডিড নং ৯৯৯৮/১৭)। ওই বছর একই মৌজায় (ডিড নং ১০৪৭২/১৭) তার নামে একটি ২৬ ডেসিমেল জমি কেনা হয়। দুই বছর পর একই মৌজায় (ডিড নং ১১২৮) তার নামে আরও ৩৯ ডেসিমেল জমি কেনা হয়। ২০২০ সালে জোয়ার সাহারা মৌজায় আফরোজার নামে ৫ কাঠা জমি কেনা হয় (ডিড নং ৫২৩২/২০)। ওই বছর একই মৌজায় (ডিড নং ৯৬৯৫) আরও ১০ কাঠা জমি কেনা হয় এবং তার ওপর একটি ৬ তলা ভবন নির্মাণ করা হয়।
২০১৮ সালে আফরোজা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কাইয়ামসির-কায়েতপাড়া মৌজায় দুটি জমি কিনেছিলেন। একটি ০.২৮ একর (ডিড নং ১৩১৯০/১৮) এবং একটি ৩২ ডেসিমেল (ডিড নং ১৩১৮৯/১৮)।
সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামানের বেকার শ্যালক নূর আলম ওরফে মিলনের নামেও গাজীপুরের শ্রীপুরে দেড় একর জমি আছে, যার মূল্য ২ কোটি টাকার মতো। আবার আছাদুজ্জামানের ভাগ্নে কালাম গাজীপুরে দেড় একর জমির মালিক, যার আনুমানিক মূল্য ১ কোটি টাকা।
আছাদুজ্জামানের গ্রামের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক ইব্রাহিম শেখ। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের কামারগ্রামের এই তত্ত্বাবধায়কের নামেও তিনি সম্পত্তি কিনেছেন। এই তত্ত্বাবধায়কের নামে গাজীপুর এলাকায় ১০০ ও ৬০ ডেসিমেল জমি রয়েছে, যেগুলোর আনুমানিক মূল্য ৩ কোটি টাকার বেশি।
তবে এসব সম্পদ অবৈধ আয়ে বা অপ্রদর্শিত আয় নয় বলে দাবি আছাদুজ্জামানের। তিনি বলেন, বাবার সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী আমি। উত্তরাধিকার সূত্রে ১০০ বিঘার বেশি জমি পেয়েছি আমি। এই জমি থেকে ১০ বিঘার মতো বিক্রি করে এসব সম্পদ কিনেছি।
ডিএমপির সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদের কমিশনার আছাদুজ্জামান প্রায় পাঁচ বছর এ দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে অবসর নেওয়ার পর তিনি আরও তিন বছর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অধীনে জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভালো অফিসারদের একজন হিসেবে আছাদুজ্জামান ২০১৭ ও ২০১৯ সালে দুই বার বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (সাহসী) এবং দুই বার রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (সাহসিকতা) পান।
আলোচনায় আসা সম্পদের ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য এসেছেন। তার সব সম্পদ বৈধ আয়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে কেনা। কয়েক দিন পর তিনি দেশে ফিরে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাবেন।