দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সঞ্চিতির উন্নতি হয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করার মতো সক্ষমতা আবারও হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার (২ জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ২ জুলাই শেষে সর্বমোট বা গ্রস রিজার্ভ সঞ্চিতি দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৬৮৮ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া হিসাব পদ্ধতি ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ম্যানুয়াল-৬ (সংক্ষেপে বিপিএম-৬) আমলে নিলে রিজার্ভ রয়েছে ২১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১৭৯ কোটি ডলার। আর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী নেট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভের (এনআইআর) পরিমাণ ১৬ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬৭৭ কোটি ডলার।
সাম্প্রতিক আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ আমলে নিলে বিদ্যমান নেট রিজার্ভ ব্যবহার করে কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করার সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে।
এনআইআর বা নেট রিজার্ভ কি?
গ্রস রিজার্ভ থেকে দুই পর্যায়ের অর্থ বাদ দিলে যা থাকে তাই নেট রিজার্ভ। এর একটি হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বিনিয়োগের পরিমাণ। দ্বিতীয়টি হলো, আগামী এক বছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ, সুদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যান্য দায়ের পরিমাণ।
রিজার্ভের বিনিয়োগ ও দায় কত?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রিজার্ভ থেকে আয় বা মুনাফা সৃজনমূলক বিনিয়োগ রয়েছে ৫ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন বা ৫০৯ কোটি ডলার। আর সরকারের ডেট সার্ভিস ও অন্যান্য দায়ের পরিমাণ রয়েছে ৫ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন বা ৫০২ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দাবি, দেশে ব্যবহারযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর পরিমাণ বাড়তে বা কমতে পারে। আবার একই সঙ্গে আগামী এক বছরে এখন যে পরিমাণ দায় নির্ধারণ করা আছে সেটিও সাময়িক এবং এর পরিমাণও বাড়তে পারে। এই মুহূর্তে বিনিয়োগের পরিমাণ আপাতত বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘হিসাবায়ন দুই ধরনের। একটি ম্যানেজারিয়াল অপরটি অ্যাকাউন্টিং পদ্ধতি। হিসাব যাই হোক, রিজার্ভ নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো অতিরঞ্জিত রিপোর্ট করেছে। নিজেদের মতো করে যা ইচ্ছা তাই হিসাব করার খবরও ছাপা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করে নিজেদের হিসাবমতো সংবাদও প্রকাশ হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হলো সামষ্টিক অর্থনীতি সচল রাখতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রয়োগ করা। সেটিই বাংলাদেশ ব্যাংক করেছে। কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তো বন্ধ হয়ে যায়নি!’
তিনি বলেন, বিগত মাসগুলোর তুলনায় রিজার্ভের সক্ষমতা এখন বেড়েছে। ট্রেন্ড বা প্রবনতা বিশ্লেষণ করে ধারণা করা যায় রিজার্ভ পুনর্গঠন হতে শুরু করেছে। আগামী দিনগুলোতে রিজার্ভ পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।
তিনি বলেন, গড়ে প্রতি মাসে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় ধরলে বিদ্যমান রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার করে চার মাসের আমদানি সক্ষমতা আছে বাংলাদেশের। আইএমএফ কর্তৃক নির্ধারিত সতর্কতামূলক আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের অর্থ রিজার্ভে থাকা দরকার।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘রিজার্ভ হলো একটি দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার সূচক। বিদেশি ব্যাংকগুলো রপ্তানি আয়ের বিপরীতে ডিসকাউন্টিং সুবিধা থেকে শুরু করে ঋণ দেওয়া পর্যন্ত রিজার্ভের পরিমাণকে বিবেচনায় নেয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিদেশি বিনিয়োকারীরাও রিজার্ভকে বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
তাই আমাদের রিজার্ভ যখন ক্ষয় হতে থাকল তখন এ সমস্যাগুলো আমরা ব্যাংক হিসেবে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। তবে পরিস্থিতির এখন পরিবর্তন হচ্ছে। গত মাসে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, এআইআইবি, আইএফসি ও উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থ ছাড় হওয়ায় আমাদের রিজার্ভ আবারও বাড়তে শুরু করেছে। এটি আমাদের আশাবাদী হতে উৎসাহ জোগায় যে আগামী মাসগুলোতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো কেটে যাবে। সাধারণভাবেই ডলারের সরবরাহ বাড়লে বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ফিরবে।’
ডলারসংকটের শুরুটা ২০২২ সালের প্রথম দিকে শুরু হলেও ২০২৩ সালজুড়ে তীব্র আকার ধারণ করেছিল। ডলারসংকটের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রিজার্ভের বড় পতন হয়। একপর্যায়ে রিজার্ভ নেমে আসে ২৪ বিলিয়ন ডলারে। এতে বিপিএম-৬-এর হিসাবায়নে ও নিট পরিমাণে রিজার্ভ কমে যথাক্রমে ১৮ বিলিয়ন ও ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়।
এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনাও চলে সারা বছর। সর্বশেষ বছরের শেষ ভাগে অর্থাৎ ডিসেম্বরে এসে আইএমএফ, এডিবি ও আরও কিছু উন্নয়ন সহযোগী দেশ থেকে ঋণ ও বাজেট সহায়তা হিসেবে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার রিজার্ভে যোগ হলে সাময়িক স্বস্তি ফিরে আসে। এরপর আবারও পরিস্থিতির অবনতি হয়। সবশেষ গত মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করে। এতে ডলারের দর বৃদ্ধি পেয়ে ১১৭ টাকা হয়।
বেশি দর পেয়ে প্রবাসীরা বেশি করে ডলার দেশে পাঠান। এতে মে-জুন মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ে। রিজার্ভ পুনর্গঠনে রেমিট্যান্সের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ক্রলিং পেগ চালু করার মাধ্যমে ডলারের বিনিময় হার বাড়ানো বা বাজারমুখী করার বিষয়টি প্রশংসিত হয়। ব্যবসায়ী নেতারা অবশ্য তাৎক্ষণিক ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ও ডলারের দর একলাফে ৭ টাকা বৃদ্ধির সমালোচনা করেছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা এক্সটার্নাল সেক্টর বা বৈদেশিক খাতের চ্যালেঞ্জ এবং মুল্যস্ফীতিকে বৃহৎ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তা সমাধানে সঠিক নীতিমালা প্রয়োগের কথা বলে আসছি।’
তিনি বলেন, ‘যেকোনো নীতি প্রয়োগের ফলাফল আসতে একটা ম্যাচিউরিটি পিরিয়ড দরকার হয়। এ সময়টি শুরু হয়েছে এবং আমরা ইতিবাচক ফলাফল পাব। ডলারের সরবরাহ পরিস্থিতি খানিকটা উন্নতি হয়েছে। ২০২৪ সালের শেষ ভাগে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।’