![সিরাজগঞ্জে বোরা ধান সংগ্রহ নিয়ে সংশয়](uploads/2024/07/02/Sirajganj-LSD-godown-1719899369.jpg)
আমনের পর এবার সিরাজগঞ্জের খাদ্যগুদামগুলোতে বোরো ধান সংগ্রহ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত ২৬ জুন পর্যন্ত জেলায় ১ হাজার ৭২০ টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। যদিও জেলার ৯টি উপজেলায় ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯১৬ টন। গত দুই বছরের মতো এবারও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে ৭ মে থেকে শুরু হয়ে ৩১ আগস্টের মধ্যে এই মৌসুমের ধান সংগ্রহ কার্যক্রম শেষ করার কথা রয়েছে। এদিকে ধান বিক্রির জন্য বিভিন্ন নিয়মকানুন ও হয়রানির কারণে সরকারিভাবে ধান বিক্রিতে আগ্রহ নেই বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। এ ছাড়া ধান সংগ্রহ কার্যক্রমে প্রকৃত কৃষকদের অন্তর্ভুক্ত করতে সরকারের প্রচার-প্রচারণারও অভাব রয়েছে। এসব কারণে সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না। তবে খাদ্য বিভাগ বলছে, ধান সংগ্রহের অবশিষ্ট সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চেষ্টা করবেন তারা।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী চলতি বছরের গত ৭ মে থেকে বোরো ধান ও চাল সংগ্রহের অভিযান শুরু হয়। এতে প্রতি কেজি ধানের মূল্য ৩২ টাকা এবং প্রতি কেজি বোরো চালের দাম ৪৫ টাকা করে নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সেই আলোকে সারা দেশের মতো সিরাজগঞ্জের ৯টি উপজেলার খাদ্যগুদামগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ধান ও চাল সংগ্রহ শুরু করেন। কিন্তু গত দুই মাসে কৃষকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ ধান সংগ্রহ করতে পারেনি সিরাজগঞ্জের খাদ্যগুদামগুলো। এখন পর্যন্ত ৯টি খাদ্যগুদামে মাত্র ১ হাজার ৭২০ টন ধান সংগ্রহ করতে পেরেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার যতসামান্য।
সিরাজগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ জেলায় সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ৮ হাজার ৯১৬ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় খাদ্য বিভাগ। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৮৯৮ টন নির্ধারণ করে দিলেও এখন পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পেরেছে মাত্র ১১৯ টন, উল্লাপাড়া উপজেলার ধানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৯১৮ টন, এখন পর্যন্ত তাদের ধান সংগ্রহের পরিমাণ মাত্র ৩৯৬ টন। তাড়াশ উপজেলার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৪১১ টন, এখন পর্যন্ত গুদামের ধান সংগ্রহের পরিমাণ মাত্র ৭২ টন, রায়গঞ্জ উপজেলার লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ২৫২ টন হলেও এখন পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ১৮৭ টন, শাহজাদপুর উপজেলার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৪৩০ টন, তার মধ্যে এখন পর্যন্ত সংগ্রহের পরিমাণ মাত্র্ ৬০ টন, কাজীপুর উপজেলার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮১৯ টন, এর মধ্যে ধান সংগ্রহের পরিমাণ মাত্র ২১ টন, কামারখন্দ উপজেলার লক্ষ্যমাত্রা ৪৪১ টন, তার বিপরীতে সংগ্রহের পরিমাণ ৩৪৫ টন। অন্যদিকে বেলকুচি উপজেলায় ৫১৯ ও চৌহালী উপজেলায় ৩৪৫ টন ধান সংগ্রহ করেতে পেরেছে গুদামগুলো।
সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এই মৌসুমে সিরাজগঞ্জে ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৭৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষাবাদ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ১৭৫ হেক্টর বেশি। এতে প্রায় ৬ লাখ ১৪ হাজার ৫৩ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে।
অন্যদিকে এ অর্থবছরে জেলার চালকল মালিকদের কাছ থেকে ২৪ হাজার ২৮২ টন চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এতে চাল দিতে ৪১৯ জন চালকল মালিক চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। গত দুই মাসে ১২ হাজার ৪৯০ টন চালও সংগ্রহ করতে পেরেছে উপজেলার গুদামগুলো।
সরেজমিনে জেলার সদর, কামারখন্দ, উল্লাপাড়া ও তাড়াশ উপজেলার খাদ্যগুদামগুলো ঘুরে দেখা গেছে, গুদামগুলোতে কোনো বোরো ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে না। শ্রমিকদের শুধু ট্রাকের চাল লোড-আনলোড করতে দেখা যায়।
তবে স্থানীয় বাজার ঘুরে জানা গেছে, কৃষকরা প্রতি মণ ধান বিক্রি করছেন ১ হাজার ১২০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা দরে। এদিকে বাজারের চেয়ে সরকার-নির্ধারিত মূল্যে ধানের দাম বেশি হলেও কিছু ভোগান্তির কারণে সরকারি গুদামগুলোতে ধান দিচ্ছেন না কৃষকরা।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাগুরা বিনোদ ইউনিয়নের কৃষক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘এ বছর সাত বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করেছিলাম। ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু সরকার-নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বাজারে মূল্য তুলনামূলক কম হলেও কিছু ভোগান্তির কারণে গুদামে ধান দেওয়ার ইচ্ছা নেই। তাই ধান হাট-বাজারে বিক্রি করছি।’
উল্লাপাড়া উপজেলার কৃষক রহমান আলী বলেন, ‘গুদামে ধান দিলে পরিবহন খরচ আছে। তা ছাড়া টাকা পেতে হয় ব্যাংকের মাধ্যমে, অনেক দেরিও হয়। আর এসব সমস্যা বা ঝামেলার কারণে বাজারে ধান বিক্রি করে থাকি।’
আর চালকল মালিকরা জানান, এ বছর সব খরচ বেড়ে গেছে, কিন্তু চালের দাম বাড়েনি। তাই লোকসান গুনলেও মিলের লাইসেন্স রক্ষার্থে বাধ্য হয়ে খাদ্যগুদামগুলোতে চাল দিতে হচ্ছে তাদের।
এ বিষয়ে শাহজাদপুর উপজেলার খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (এলএসডি) আশরাফুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘এ বছর উপজেলার দুটি খাদ্যগুদামে ১ হাজার ৪৩০ মেট্রিন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিলেও এখনোও কোনো ধান সংগ্রহ করতে পারিনি। কৃষকরা গুদামে ধান দিতে চান না, তাদের কাছে থেকে জোর করে ধান নেওয়ার অধিকারও আমাদের নেই। তা ছাড়া তারা বাজারে ধানের ভালো দাম পাচ্ছেন, এ জন্য গুদামে ধান দিতে আগ্রহী নয়।’
এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ সদর খাদ্যগুদামের সংরক্ষণ ও চলাচল কর্মকর্তা মো. মঈন উদ্দিন বলেন, ‘গত দুই মাসে লক্ষ্যমাত্রা ৮৯৮ মেট্রিক টনের মধ্যে মাত্র ১১৯ টন বোরো ধান সংগ্রহ হয়েছে। ধান সংগ্রহ নিয়ে সংশয় থাকলেও চাল সংগ্রহ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। সরকারের উদ্দেশ্য, কৃষক যেন ধানের ন্যায্যমূল্য পান। সে হিসাবে কৃষক বাজারে বিক্রি করলে তার ন্যায্য দাম পাচ্ছেন।’
সিরাজগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা রিয়াজুর রহমান রাজু বলেন, ‘বাজারে ধানের দাম মোটামুটি ভালো রয়েছে। এ জন্য গুদামগুলোতে ধান সংগ্রহ কম হচ্ছে। এ ছাড়া জেলার চারটি উপজেলায় কৃষকের অ্যাপস ও বাকি পাঁচ উপজেলায় লটারির মাধ্যমে ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে বিগত বছরের চেয়ে এবার ধানের মূল্য বেশি হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে মনে করছি।’