![বিশ্বের বৃহত্তম ক্যামেরা স্থাপিত হচ্ছে চিলির মরুভূমিতে](uploads/2024/06/14/wwwcc-1718369063.jpg)
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির উত্তরের খোলা আকাশের নিচে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য তৈরি সবচেয়ে বড় ডিজিটাল ক্যামেরা স্থাপনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি এখন পর্যন্ত নির্মিত সবচেয়ে বড় ক্যামেরা, যা এক দশকব্যাপী জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য অনুসন্ধান পরিচালনা করবে।
চিলির রাজধানী সান্টিয়াগোর ৫৬৫ কিলোমিটার উত্তরে কোকিম্বো অঞ্চলের আতাকামা মরুভূমির প্রান্তে সেরো পাচোনের (Cerro Pachón) শৃঙ্গে ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরি স্থাপনের কাজ চলছে। এই অবজারভেটরিতে থাকবে একটি গ্রাউন্ডভিত্তিক টেলিস্কোপ এবং এক বিশাল ক্যামেরা। এর অংশগুলো ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি যানবাহনে পৌঁছেছে।
নোয়াল্যাব (NoirLab) সেন্টার পরিচালনা করবে এই অবজারভেটরি। নোয়াল্যাবের উপ-পরিচালক ও অরা সংস্থার চিফ সায়েন্স অফিসার স্টুয়ার্ট কর্ডার বলেন, ‘এই অবজারভেটরি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই পৌঁছে গেছে। আশা করা যাচ্ছে, এই বছরের শেষদিকে এটি স্থাপন করা হবে।’
ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এটি একটি জটিল ও সমন্বিত ব্যবস্থা। এটি একটি আট মিটারের গ্রাউন্ডভিত্তিক টেলিস্কোপ, একটি ক্যামেরা ও একটি সমন্বিত তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা নিয়ে গঠিত। প্রতি দিন প্রায় ২০ টেরাবাইট ডেটা উৎপন্ন করবে এই অবজারভেটরি। দশ বছর ধরে চলা অনুসন্ধানের ফলে ১৫ পেটাবাইটের একটি ক্যাটালগ ডেটাবেস তৈরি হবে।
এই অনুসন্ধান অভিযানের লক্ষ্য হলো মহাবিশ্বের ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জির প্রকৃতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। বর্তমানে এসব বিষয়ে খুবই কম তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া এই অভিযান পৃথিবীর গ্রহাণু, উল্কা, সূর্যের নিকটবর্তী নক্ষত্র বা গ্রহের সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করবে।
কর্ডার বলেন, ‘এটি একটি সত্যিই অনুপ্রেরণামূলক মুহূর্ত। আমরা বলতে পারি- আমরা শুরু করছি। আমরা এখন সীমানার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। এমন একটি অভিযান শুরু করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, আশা করি যা দশ বছরের মধ্যে মহাবিশ্ব কখন সৃষ্টি ও গতিশীল হয়েছিল... এবং ভবিষ্যতে এটি কীভাবে বিবর্তিত হতে থাকবে সেসব প্রশ্নের উত্তর দেবে।’
অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটি ফর রিসার্চ ইন অ্যাস্ট্রোনমি (অরা) যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭টি প্রতিষ্ঠান ও ৩টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত। এটি ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন ও নাসার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণাগার পরিচালনা করে। অরা পরিচালিত করছে এর মধ্যে অন্যতম হলো নোয়াল্যাব সেন্টার। পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক মরুভূমি আতাকামার পরিষ্কার আকাশের কারণে জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণায় বিশ্বের বেশির ভাগ বিনিয়োগ চিলিতে করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের এসএলএসি ন্যাশনাল অ্যাক্সিলারেটর ল্যাবরেটরির গবেষক ও প্রকৌশলীরা এই বৃহত্তম ক্যামেরা নির্মাণ করেছেন। দুই দশকের গবেষণার পর এটি তৈরি করছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এটির মাধ্যমে মহাবিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটন করা যাবে। মূলত জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের জন্য এ ডিজিটাল ক্যামেরা তৈরি করা হয়েছে।
লিগ্যাসি সার্ভে অব স্পেস অ্যান্ড টাইম (এলএসএসটি) ক্যামেরার রেজ্যুলশন ৩ হাজার ২০০ মেগাপিক্সেল বা ৩ দশমিক ২ গিগাপিক্সেলেরও বেশি। আইফোনের সর্বশেষ মডেলের স্মার্টফোনের রয়েছে মাত্র ৪৮ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা, যা এলএসএসটি ক্যামেরার তুলনায় মাত্র ০ দশমিক ০১ শতাংশ ডিটেইল ক্যাপচার করতে পারে।
ক্যামেরাটির ওজন ৩ হাজার কেজি বা ৩ মেট্রিক টন। গড়পড়তা এশিয়ান নারী হাতির ওজনের প্রায় সমান। ক্যামেরাটির লেন্সও বিশাল— ১ দশমিক ৫৭ মিটার বা ৫ দশমিক ১ ফুট। এই ক্যামেরার রেজ্যুলুশন এত উচ্চ যে, এর একটি ছবি পুরোপুরি দেখাতে কয়েক শ হাই-ডেফিনিশন টেলিভিশন প্রয়োজন হবে। এটির ছবি এত বিস্তৃত যে, প্রায় ১৫ মাইল দূর থেকেও একটি গলফ বলের ছবি তোলা যায়। এমনকি এটি দিয়ে চাঁদের চেয়ে ৭ গুণ বড় আকাশের একটি অংশের ছবি তোলা যাবে। এটি ব্যবহার করে আকাশের ৩ দশমিক ৫ ডিগ্রিজুড়ে ছবি তোলা যাবে।
এলএসএসটির মোট চারটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে। ডার্ক ম্যাটার সন্ধানের পাশাপাশি এর দ্বিতীয় কাজ মহাবিশ্বের বিভিন্ন বস্তুর আরও পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরিতে সাহায্য করা। এর আরেকটি কাজ, নিয়ত পরিবর্তনশীল আকাশের বিভিন্ন বস্তু আবিষ্কার করা। কী ধরনের পরিবর্তন ঘটছে, সেগুলো খেয়াল রাখা। সেই সঙ্গে সৌরজগতের সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চল, কুইপার বেল্টের শত-সহস্র নতুন বস্তুকেও এটি চিহ্নিত করতে পারবে বলেই আশা করা হচ্ছে। এটি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের আরও পূর্ণাঙ্গ ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরিতে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করবে। ছোট, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিভিন্ন বস্তুর যে স্পষ্ট ছবি তোলার ক্ষমতা এলএসএসটির আছে, আগের কোনো টেলিস্কোপেরই তা ছিল।
এ ক্যামেরা তৈরিতে মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭ হাজার ৪৪২ কোটি ২২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ২০১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন প্রকল্পটির জন্য তহবিলের অনুমোদন দেওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি এ ক্যামেরা নির্মাণে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছে।
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের তথ্যমতে, এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ রেজ্যুলুশন-সমৃদ্ধ ক্যামেরা। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, ২০২৫ সালের প্রথম দিকে এটি ছবি তোলার কাজ শুরু করবে। তবে সাধারণ মানুষের জন্য তা প্রকাশ করা হবে ২০২৭ সালের দিকে। সূত্র: রয়টার্স