জাতীয় নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ঢাকাসহ সারা দেশে নাশকতার ভয়াবহতাও তত বাড়ছে। এসব নাশকতায় প্রাণ যাচ্ছে অনেকের। যার সর্বশেষ নজির, গতকাল মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ভোরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে ট্রেনে আগুনের ঘটনায় নারী-শিশুসহ চারজনের মৃত্যু। এ ছাড়া গতকালের হরতালে রাজধানীতে ও চট্টগ্রামে দুটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। গাইবান্ধায় পাঁচটি যানবাহন ভাঙচুর করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ম্যারাথন অভিযানেও বন্ধ হচ্ছে না নাশকতা।
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো দেশব্যাপী হরতাল ও অবরোধের ডাক দেয়। এরপর থেকেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে ঘটে অগ্নিসংযোগের ঘটনা। বিএনপি ও জামায়াতের অবরোধ ও হরতাল ঘোষণার পর ঢাকা থেকে কোনো দূরপাল্লার গাড়ি চলাচল করছে না।
রেল পুলিশ সূত্র জানায়, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ছোট-বড় ৫২টি ঘটনা ঘটেছে। আর দিনে দিনে এ ঘটনাগুলোর ভয়াবহতা বেড়েছে। প্রথমদিকে হালকা ইটপাটকেল মারা, টায়ার জ্বালানোর মধ্যে থাকলেও পরে তা অগ্নিসংযোগে গড়ায়। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার গাজীপুরের বনখড়িয়া এলাকায় রেললাইন কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া নীলফামারীর ডোমারে রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলে তারা। তার কয়েক দিন আগে গাজীপুরের রেলে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ করে দুর্বৃত্তরা। পরে পুলিশ গেলে তারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এর আগে গত ১৬ নভেম্বর টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনে আগুন দেয়। এতে ৩টি বগি পুড়ে যায়। এবার রাজধানীতে ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটল। এতে মা ও তার শিশুপুত্রসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি (রেলওয়ে) মো. দিদার আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ট্রেনের নিরাপত্তার জন্য আমরা কাজ করছি। নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।’ ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি ফেরদৌস আহামেদ বিশ্বাস জানান, ঘটনার তদন্ত অব্যাহত আছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৪টা ৫৪ মিনিটে তেজগাঁও স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস নামে একটি ট্রেনে আগুন লাগার সংকেত পেয়ে থামে। আগুন লাগার বিষয়টি ট্রেনের চালক বুঝতে পারেননি। ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে আসার পর স্টেশন মাস্টারের সিগন্যাল পেয়ে তিনি ট্রেনটি থামান। আগুনে মা ও তার শিশুপুত্রসহ চারজন পুড়ে মারা গেছেন। ট্রেনটির ছ, জ ও ঝ মোট তিন বগি পুড়ে যায়। ট্রেন থেকে নিহতদের মরদেহ উদ্ধারের পর তেজগাঁও স্টেশনে ১ ঘণ্টার মতো অবস্থান করে কমলাপুরে চলে যায়। ট্রেনটিতে মোট ১৪টি বগি ছিল। ট্রেনটি বর্তমানে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে রাখা হয়েছে। বগিগুলো আলাদা করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী তেজগাঁও রেলস্টেশনে চায়ের দোকানদার শামসুল ইসলাম জানান, ট্রেনটি তেজগাঁও আসার পর বগি থেকে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছিল। এ সময় স্টেশনমাস্টার সংকেত দিলে সেটি থামে। এটি তেজগাঁওয়ে থামার কথা ছিল না। সবুজ নামে আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আগুনের আতঙ্কে যাত্রীরা চিৎকার করতে থাকেন। অনেকেই লাফ দিয়ে নেমে আসেন।
তেজগাঁও স্টেশনের সহকারী স্টেশনমাস্টার মো. পর্বত আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ৪টা ৫০ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন ছেড়ে আসে। তেজগাঁও স্টেশনে পৌঁছায় ৪টা ৫৪ মিনিটে। যেসব ট্রেন তেজগাঁও স্টেশনে থামে না সেগুলোর জন্য আমরা সবুজ বাতি জ্বালিয়ে পার হওয়ার সংকেত দিই। কিন্তু বগিতে আগুন দেখে ট্রেন থামানোর সংকেত দেওয়া হয়।’
গতকাল তেজগাঁও স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছেন। পাশাপাশি স্টেশনের আশপাশে থাকা বিভিন্ন সিসি ক্যামেরা ফুটেজ তারা সংগ্রহ করেছেন। আগুনের আতঙ্কে গতকাল স্টেশনে কম লোকজন দেখা গেছে। তবে কিছু উৎসুক মানুষ স্টেশনে গেলে তাদের সেখান থেকে পুলিশ সরিয়ে দেয়। রেল পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশ, র্যাব, পিবিআইসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সংস্থা আগুনের ঘটনাটি তদন্ত করছে।
প্রত্যক্ষদর্শী আল মদিনা স্টোরের দোকানি জানান, এই স্টেশনে সব ট্রেন থামে না। মোহনগঞ্জের ট্রেনও থামার কথা ছিল না। সব যাত্রী দ্রুত নেমে পড়েন। যারা বের হতে পারেননি তারা আগুনে পুড়ে গেছেন।
ভ্রাম্যমাণ এক বাদাম বিক্রেতা জানান, ভোরে ট্রেনটি যখন থামে, তখন সবাই চিৎকার করতে থাকেন। ফায়ার সার্ভিস দ্রুত স্টেশনে আসার কারণে আগুন অন্য বগিতে ছড়াতে পারেনি।
তদন্তে দায়িত্ব পালনকারী পিবিআইর এসপি মিজানুর রহমান বলেন, ‘সিসি ক্যামেরা দেখে আমরা নাশকতাকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। বিমানবন্দরের একাধিক ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে কয়েকজনকে সন্দেহভাজন মনে হয়েছে।’
ফায়ার সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (মিডিয়া) শাহজাহান শিকদার জানান, আগুনের খবর আসে ৫টা ৮ মিনিটে। ৫টা ১৫ মিনিটে তারা আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন। ১ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
এদিকে আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘যারা অবরোধ-হরতাল দিয়েছে, তারাই রেলে আগুন দিয়েছে। আমি মনে করি, যারা অবরোধ-হরতাল দিচ্ছে তারাই এই নাশকতার সঙ্গে জড়িত। এর আগেও তারা এভাবে ট্রেনে নাশকতা করেছিল।’
তিনি বলেন, ‘গাজীপুরের লাইন যারা কেটে ফেলেছিল, সেখানেও একজনকে হত্যা করা হয়েছে। আজকেও যে ঘটনাটি, এটিকেও আমি সরাসরি হত্যা বলতে চাই। হরতাল ও অবরোধকারীদের একটি অংশ এ কাজ করেছে বলে আমি মনে করি। কেবল একটি অংশ নয়, এটি কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের অংশ। তার অংশ হিসেবেই তাদের যারা অনুসারী রয়েছে, তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে মনে করে।’
বিএনপির অধিকাংশ নেতাই জেলে রয়েছেন। তারপরও কাদের নির্দেশে এ ধরনের নাশকতা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, যারা হরতাল করছে, যারা জ্বালাও-পোড়াও করছে, নাশকতা করছে, বিদেশি নেতাদের নির্দেশে এই দেশে তাদের যে এজেন্ট রয়েছে, অনুসারীরা রয়েছে, তারাই যে এটা করছে তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
তিনি বলেন, ‘যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন, তারা কোনো অবস্থাতেই পার পাবে না। তারা অতীতেও পার পায়নি। ট্রেনে, বাসে যেসব জ্বালাও-পোড়াও হচ্ছে, এর প্রত্যেকটি ঘটনায় আমরা প্রত্যেককে শনাক্ত করতে পেরেছি। তারা স্বীকারও করেছে, তাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে, তাদের রাজনীতি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। আমাদের সতর্কতা ছিল। তার পরেও যেহেতু এই ঘটনা ঘটেছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সিআইডি, ডিবি এবং রেলওয়ে পুলিশ তৎপর রয়েছে যেন পরবর্তী সময়ে আর এ ধরনের ঘটনা না ঘটতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আহত একজনের কাছে যেটুকু জানতে পেরেছি, ভেতরে থাকা লোকজনই আগুন দিয়েছে। সে নিজেও সেখানে ছিল। সে দেখেছে সিটের ভেতরে প্রথমে আগুন দিয়েছে। পরে সেই আগুন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেছে। যেহেতু ভোর ছিল তাই অনেকেই ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। আমরা দেখেছি একজন মা তার সন্তানকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন, হয়তো বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন।’
ডিএমপি কমিশনার বলেন, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ভোর ৫টার সময় ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে পৌঁছায়। সেখান থেকে কমলাপুরের উদ্দেশে যখন রওয়ানা করে বনানী-কাকলীর কাছাকাছি এলে ‘জ’ বগির ভেতরে যাত্রীরা প্রথমে আগুন দেখতে পান। অনেকেই লাফ দিয়ে বগি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তবে চারজনকে পুড়িয়ে সেখানে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে এক মা ও তার ছেলে ইয়াসিনকে শনাক্ত করা গেছে। বাকি দুজনকে এখনো শনাক্ত করা যায়নি। তাদের শনাক্তের চেষ্টা করছে সিআইডি। বীভৎসভাবে পুড়ে যাওয়ায় তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাদের ডিএনএ সংগ্রহ করা হচ্ছে যেন পরবর্তী সময়ে শনাক্ত করা যায়। এই ঘটনায় কমলাপুরের ঢাকা রেলওয়ে থানায় মামলা করা হবে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
রাজধানীতে বাসে আগুন
এদিকে গতকাল বিএনপির ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল চলাকালে রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় একটি যাত্রাবাহী বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলেও কাউকে আটক করতে পারেনি। ফায়ার সার্ভিস জানায়, দুপুর ১টার দিকে গুলিস্তানের জিপিওর সামনে মালঞ্চ পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের ২টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (মিডিয়া) শাহজাহান শিকদার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
চট্টগ্রামে বাসে আগুন
চট্টগ্রামের চন্দনাইশে বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। গত সোমবার রাত আড়াইটার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বাদামতলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। চন্দনাইশ ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার সাবের আহমদ জানান, আগুন লাগার ৫০ মিনিটের মধ্যে নেভানো হয়। বাসের সব আসন পুড়ে যায়। তবে কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে তা জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।
গাইবান্ধায় ৫ যানবাহন ভাঙচুর
এদিকে দুপুরে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে একটি যাত্রীবাহী বাস, দুটি পণ্যবাহী ট্রাক ও দুটি ড্রাম ট্রাক ভাঙচুর করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বগুড়া থেকে গাইবান্ধাগামী ফরহাদ স্পেশাল নামের যাত্রীবাহী একটি বাস থামায় পিকেটাররা। পরে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে তারা বাসে ভাঙচুর চালায়। তবে এতে কেউ আহত হননি। এরপর একই স্থানে রংপুরগামী দুটি পণ্যবাহী ট্রাক ও দুটি ড্রাম ট্রাকে ভাঙচুর চালানো হয়। এ সময় ট্রাকের চালকরা নেমে গিয়ে রক্ষা পান। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে পিকেটাররা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল ছোড়ে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন পলাশবাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) লাইছুর রহমান। তিনি জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ কয়েকটি টিয়ারশেল ছোড়া হয়।