বিএনপির ক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত নেতাদের বড় একটি অংশের এবার নির্বাচনে যাওয়ার গুঞ্জন ছিল প্রথম থেকেই। এমনকি বিএনপি ভেঙে যাবে কি না, এমন প্রশ্নও জনমনে ঘুরপাক খেয়েছে। খোদ সরকারি দলের মন্ত্রী ও নেতাদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিষয়টি ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু বিএনপির পাল্টা তৎপরতাসহ নানা হিসাব-নিকাশের কারণে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের ওই উদ্যোগ পুরোপুরি সফল হয়নি।
অনেকের মতে, একমাত্র ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচনে নেওয়া ছাড়া সরকার বড় ধরনের কোনো চমক দেখাতে পারেনি।
যদিও দলটির বেশ কয়েকজন সাবেক এমপি ও নেতা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, কিন্তু যাদের টার্গেট করা হয়েছিল, তাদের বেশির ভাগই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত যাননি। কারও কারও মতে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এমনকি বিএনপির সঙ্গে থাকা ইসলামপন্থি দলগুলোর কাছ থেকেও প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া পায়নি সরকারি দল।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম নামে দুটি দল গঠন করে বিএনপির নেতাদের নানা প্রলোভন ও চাপ দিয়ে নির্বাচনে আনার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু গতকাল বিএনএমের ৮২ জন প্রার্থীর তালিকায় শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরসহ বিএনপির ৩ জন সাবেক এমপির নাম দেখা গেছে। বাকি দুজন হলেন বরগুনা-২ আসনের আবদুর রহমান ও সুনামগঞ্জ-৪ আসনের দেওয়ান শামসুল আবেদীন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী বিভিন্ন সময় বলেছেন, বিএনপি না এলেও দলটির অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবেন। সর্বশেষ গত ২৮ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে যারা নেতা হিসেবে মানতে পারছেন না, তারা নির্বাচনে আসবেন বলে আমার কাছে তথ্য আছে। কিন্তু গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত খুব আলোচিত বা হেভিওয়েট কোনো নেতাকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেখা যায়নি। তবে শেষ পর্যন্ত কারা কারা মনোনয়নপত্র জমা দেন, এ নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর ব্যাপক কৌতূহল ছিল জনমনে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির সাবেক ও বর্তমান যেসব নেতাকে নির্বাচনে নেওয়ার টার্গেট করা হয়েছে, এমন নেতাদের তালিকা হাতে পেয়ে তারেক রহমান লন্ডন থেকে নিজেই প্রত্যেকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে তাদের থামানোর চেষ্টা করেন। এ ছাড়া তৎপর নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করার পাশাপাশি কথা বলার জন্য তিনি একটি টিম গঠন করে দেন। স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য ছাড়াও তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ কয়েক নেতা ওই টিমের সদস্য বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ওই টিমের সদস্যরা প্রত্যেকের বাসায় গিয়ে তাদের নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে তারেক রহমানের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেন ও উদ্বুদ্ধ করেন। বিশেষ করে বঞ্চিত হয়েছেন এমন নেতাদের সঠিক জায়গায় পদায়নের আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দেন তারেক রহমান। এ ছাড়া বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা এবং দেশে বাম ও ডানপন্থি দলগুলোর নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে, সে বিষয়ে নেতাদের সতর্ক করে দেন তারা।
তবে সংশ্লিষ্ট মহলের চাপ বেশি থাকায় দলের হাইকমান্ডের পরামর্শে কেউ কেউ ঢাকার বাইরে চলে যান বলেও খবর পাওয়া গেছে। কারাগারে থাকা বিএনপি নেতাদের ওপরও নানামুখী চাপ রয়েছে বলে দলটির মধ্যে আলোচনা আছে। বাসে আগুন দেওয়া মামলায় গত বুধবার জামিন লাভ করে পরের দিন বৃহস্পতিবারই নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা তারই অংশ কি না, এ নিয়েও নানা আলোচনা ও কৌতূহল তৈরি হয়েছে জনমনে।
বিএনপির সংরক্ষিত আসনের সাবেক এক মহিলা এমপি নিলোফার চৌধুরী মনি গতকাল খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে এমন চাপ ছিল যে তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। ফলে ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত পালিয়ে বাইরে থাকতে হয়েছে।’ তার মতো আরও অনেককে আত্মগোপনে থেকে নির্বাচনে যাওয়ার চাপ সামলাতে হয়েছে বলে জানান তিনি। মনি গতকাল বিকেলে ঢাকায় ফিরেছেন বলে জানা গেছে।
নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে জোর গুঞ্জন ছিল সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ (ভোলা-৩) ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলনকে (চাঁদপুর-১) কেন্দ্র করে। এরা দুজনই বিএনপির পদবঞ্চিত নেতা। খবরের কাগজের সঙ্গে আলাপে এরা দুজনেই স্বীকার করেছেন যে, নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নে তারা বেশ চাপে ছিলেন। কিন্তু তারেক রহমানের পরামর্শে তারা কেউ শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাননি।
হাফিজ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে দলের প্রতি আনুগত্য রয়েছে, এটা এবার আবার প্রমাণ হলো।’
এহসানুল হক মিলনের মতে, উত্তপ্ত কড়াই থেকে কেউ আগুনে ঝাঁপ দিতে চায় না। বিএনপির প্রতি রাগ-অভিমান অনেকের থাকতে পারে। কিন্তু বেইমানি করে আরেক দলের সঙ্গে আঁতাত করে কী লাভ, এটা সবাই চিন্তা করে দেখেছে। তিনি বলেন, ‘আমিসহ অনেকের ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল। কিন্তু তারেক রহমান শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি ভালোভাবে হ্যান্ডল করতে পেরেছেন।’
সরকারের টার্গেটে আরও যারা ছিলেন
মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন ও এহসানুল হক মিলন ছাড়াও বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কুমিল্লা-৯ আসনের সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) এম আনোয়ারুল আজিম নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে বেশ চাপে ছিলেন। অভিযোগ আছে, ওই আসনে চৈতি গ্রুপের মালিক ব্যবসায়ী আবুল কালামের পরামর্শ অনুযায়ী দলের সকল পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কারণে দলের ওপরে তার ক্ষোভ রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত তারেক রহমানের পরামর্শে নেতারা তাকে নির্বাচনে যাওয়া থেকে নিরস্ত করেন।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির আরেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং রাজবাড়ী-১ (সদর-গোয়ালন্দ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়াম, রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, খুলনার নজরুল ইসলাম মঞ্জু, কুমিল্লার সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু, পাবনার সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম সরদার, কুমিল্লার আনোয়ারুল আজিম, মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী, রাঙামাটির দীপেন দেওয়ান, টাঙ্গাইলের লুৎফর রহমান খান আজাদ, লুৎফুর মতিন, নারায়ণগঞ্জের কাজী মনির, নেত্রকোনার আশরাফউদ্দিন খান, নওগাঁর আনোয়ার হোসেন বুলু, বরিশালের মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ, আব্দুস সাত্তার খান, বরগুনার নুরুল ইসলাম মনিসহ আরও অনেকে সরকারের টার্গেটে ছিলেন বলে জানা যায়। তবে এদের মধ্যে অনেকই ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
এ ছাড়া বিএনপি নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম এ লতিফ খান (নওগাঁ-৫), সাবেক সংসদ সদস্য মাসুদ অরুণ (মেহেরপুর-১), গাজী শাহজাহান জুয়েল (চট্টগ্রাম-১২), বিএনপির সাবেক মন্ত্রী মনসুর আলী সরকার (দিনাজপুর-৫), ইঞ্জিনিয়ার শহীদুল ইসলাম (কক্সবাজার-৩) এবং টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফ পাহেলী স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন বলে গতকাল পর্যন্ত গুঞ্জন ছিল। কিন্তু গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা অতিক্রম করার পর এসব গুঞ্জনেরও অবসান ঘটেছে।
টার্গেট পূরণ হলো যাদের নিয়ে
আগে থেকে গুঞ্জন ছিল গুরুত্বপূর্ণ এমন মাত্র একজন জোটসঙ্গীকে নির্বাচনে টেনে নেওয়া গেছে। তিনি হলেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১২-দলীয় জোটের সমন্বয়ক মেজর জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। তবে কারাগারে থাকার কারণে ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের নাম আলোচনায় ছিল না। তিনি অবশ্য বিএনএম, তৃণমূল বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নন, সরাসরি নৌকা প্রতীকেই নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়া শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমূর আলম খন্দকার বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ছিলেন। শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরকে গত ২৮ নভেম্বর বহিষ্কার করা হলেও তিনি নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন।
এ ছাড়া কমিটিতে জায়গা না পাওয়াসহ নানাভাবে বঞ্চিত নেতাদের মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এ কে একরামুজ্জামান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১)। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি একরামুজ্জামান নানামুখী চাপে ছিলেন বলে মনে করা হয়। সংস্কারপন্থি বলে পরিচিত (বগুড়া-৪) আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মোল্লা বিএনপির কোনো পদেই ছিলেন না। তাকে থানা, ইউনিয়ন, এমনকি গ্রামের কমিটিতেও রাখা হয়নি বলে গতকাল খবরের কাগজের কাছে অভিযোগ করেন।
এ ছাড়া সাবেক চারবারের সংসদ সদস্য শাহ মো. আবু জাফর (ফরিদপুর-১), গাজীপুরের বাসন থানা বিএনপির সহসভাপতি জব্বার সরকার (গাজীপুর-১), ঠাকুরগাঁও হরিপুর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি মোজাফফর আহমেদ (ঠাকুরগাঁও-২) এবং জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সহসভাপতি আব্দুল কাদির তালুকদার (চাঁদপুর-৪) আসন থেকে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ বিএনএম, কেউ তৃণমূল বিএনপি এবং অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।