১৯৭১ সালের সরকার বা মুজিবনগর সরকার তাদের নথিপত্র ট্রাঙ্কে করে নিয়ে এসেছিল; কিন্তু সে ট্রাঙ্কের হদিস পরবর্তী সময়ে পাওয়া যায়নি। হাসান হাফিজুর রহমান যখন প্রকল্প শুরু করেন, তখন তার ভাষ্য অনুযায়ী কয়েক লাখ নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল। প্রকল্প শেষ হলে সেগুলোর খোঁজ পাওয়া যায়নি। একসময় জানা গেল, এগুলো একটি গুদামে চটের থলিতে ভরে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে কিছু দলিলপত্র জাতীয় জাদুঘরে দেওয়া হয় এবং পরে তা খুব সম্ভব স্থানান্তর করা হয় জাতীয় অভিলেখ্যাগারে।
এই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা ৫৩ বছর পেরিয়েছে। ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম বই প্রকাশিত হয় এবং আজ ২০২৪ সাল অব্দি তা অব্যাহত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যার হিসাব সঠিক জানা যায় না, কারণ এর হিসাব তেমনভাবে করা হয় না। এসব বই নিয়ে কয়েকটি তালিকা প্রকাশিত হয়েছে; কিন্তু সব তালিকাই অপূর্ণ। মফস্বল থেকে অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে, যা আমাদের অগোচরে রয়ে গেছে। স্মরণিকা, পুস্তিকা- এসব তালিকার মধ্যে আনলাম না। বাংলাদেশে যদি মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত একটি অভিলেখ্যাগার থাকত, তাহলে হয়তো সেখানে এসব বই সংগৃহীত হতো এবং একটি পূর্ণ তালিকা করা সম্ভব হতো।
মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক নিয়ে কাজ হয়েছে, এই ইতিহাস চর্চার মধ্যে রাজনীতিও প্রবেশ করেছে। প্রথম দিকে, অনেক সামরিক অফিসার, যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, তারা লিখেছিলেন যেখানে কেন্দ্রীয় ভূমিকা ছিল সামরিক কর্মকর্তাদের। বীরত্বপূর্ণ পদকসমূহ অধিকাংশই দেওয়া হয়েছিল সামরিক কর্মকর্তাদের। ফলে, মুক্তিযুদ্ধের চর্চার এক ধরনের সামরিকায়ন হয়। কিন্তু তারপর সাধারণ বা মধ্যবিত্ত অসামরিক যোদ্ধাদের বিবরণ প্রকাশিত হতে থাকে এবং সেসব বইয়ে এটিকে নিছক যুদ্ধ শুধু নয়, এটি যে জনযুদ্ধ, সে প্রত্যয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়। এরপর বিভিন্ন জন ১৯৭১-এর স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করেন। সব মিলিয়ে প্রতি বছর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সামরিক বাহিনী সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধের ইতিহাস প্রকাশ করেছে। পুলিশ বাহিনী শহিদ পুলিশদের নিয়ে তিন খণ্ড প্রকাশ করেছে। সাবেক ইপিআর ও আনসার নিয়েও বই বেরিয়েছে।
জিয়াউর রহমানের আমল থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার ধারা বদলে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। ওই সময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দলিলপত্র প্রকাশের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, যার প্রধান ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। এ প্রকল্প থেকে ১৫ খণ্ডে যে দলিলপত্রের সংকলন প্রকাশিত হয়, তার নাম দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ নয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। কেন এ নামকরণ, তার কারণ অবশ্য উল্লেখ করা হয়নি। এটাই তো অজানা নয় যে, মুক্তিযুদ্ধ এক অর্থে স্বাধীনতা যুদ্ধ হলেও তা সবসময় পরিচিত ছিল মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে। আর স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যয়টির পরিধি ব্যাপক।
এ সময় থেকে অধিকাংশ গ্রন্থ যা প্রকাশিত হয়েছে, তা বীরত্বগাথা বা স্মৃতিকথা। জিয়াউর রহমানের সময় অনুপস্থিত ছিল গণহত্যা-নির্যাতন ও অবরুদ্ধ দেশ। এ দুটি দিক নিয়ে যে লেখা হয়নি, তা নয়; কিন্তু তেমন চর্চা হয়নি। বিকৃতায়ন হয়েছে বেশি। কারণ, যারা লিখেছেন তারা সতর্ক ছিলেন। জিয়ার রাজনৈতিক দল তাকে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ও স্বাধীনতার রূপকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। সেখানে অবরুদ্ধ দেশ ও গণহত্যার কথা এলে জামায়াত ও বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিষিদ্ধকৃত দলগুলোর কথা আসবে। কিন্তু তারা তো জিয়ার মিত্র।
এরশাদ হয়ে খালেদা জিয়া এবং তারপর খালেদা-নিজামী পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। শুধু তাই নয়, খালেদা-নিজামী আমলে মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।
শেখ হাসিনার সময় থেকে খোলা মনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা শুরু হয়। এখনো তা বর্তমান। গণহত্যা নিয়ে এখন প্রচুর বই প্রকাশিত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কোষগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য, অবরুদ্ধ দেশ, শত্রুপক্ষ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে লেখা কম হয়েছে। শত্রুপক্ষ নিয়ে কম লেখার কারণ ভয়। মানুষের মনে এখনো এ ভয় কাজ করে যে, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে, যারা এ ধরনের চর্চা করেছেন তারা নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।
গণহত্যা-নির্যাতন সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে খুলনায় স্থাপিত গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর। তারা প্রতিটি গণহত্যার ঘটনা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছে। এ পর্যন্ত এ সিরিজে ১২৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ৫০ বছর পর তারা জেলা জরিপ শুরু করেছে। জরিপে প্রতিটি জেলায় গণহত্যার ঘটনা, বধ্যভূমি, গণকবর ও টর্চার সেল বা গণকবর চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোর জিপিএস সার্ভে করেছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের অনুদ্ঘাটিত দিকগুলো উন্মোচিত হচ্ছে। আমার মনে হয়েছে, আজ ৫৩ বছর পরও আমরা মুক্তিযুদ্ধে কোথায় কী হয়েছিল, এর যাত্রা কতটুকু ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তেমন কিছু জানি না। এর একটু কারণ, এ ধরনের গবেষণা চর্চায় বিনিয়োগ কম।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা আরও ব্যাপক হতো, যদি দুই দফা মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা ক্ষমতায় না থাকত। এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় তথ্যের ঘাটতি বেশি, কারণ তা সংরক্ষণ করা হয়নি।
১৯৭১ সালের সরকার বা মুজিবনগর সরকার তাদের নথিপত্র ট্রাঙ্কে করে নিয়ে এসেছিল; কিন্তু সে ট্রাঙ্কের হদিস পরবর্তী সময়ে পাওয়া যায়নি। হাসান হাফিজুর রহমান যখন প্রকল্প শুরু করেন, তখন তার ভাষ্য অনুযায়ী কয়েক লাখ নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল। প্রকল্প শেষ হলে সেগুলোর খোঁজ পাওয়া যায়নি। একসময় জানা গেল, এগুলো একটি গুদামে চটের থলিতে ভরে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে কিছু দলিলপত্র জাতীয় জাদুঘরে দেওয়া হয় এবং পরে তা খুব সম্ভব স্থানান্তর করা হয় জাতীয় অভিলেখ্যাগারে। এই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি।
আসলে শুরুতেই আলাদাভাবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অভিলেখ্যাগার স্থাপন করা উচিত ছিল; কিন্তু তা হয়নি। শেখ হাসিনার আমলে যারা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী হয়েছেন, তাদের কাছে গেছি, মুক্তিযুদ্ধের অভিলেখ্যাগার গঠনের কথা বলেছি, কেউ না বলেননি; কিন্তু কাজটি হয়নি। আর হবে বলেও মনে হয় না। কেন্দ্রীয় অভিলেখ্যাগার না থাকলে দলিলপত্র সংরক্ষণ হবে কী করে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হলে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র সংরক্ষণ শুরু হয়। তারা স্বাভাবিকভাবেই প্রদর্শনীর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রথম এক দশক অর্থাভাবেই তাদের কেটেছে। সুতরাং, সেভাবে নথিপত্র সংগৃহীত হয়নি। জাতীয় অভিলেখ্যাগার এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি। খুলনার গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের আর্কাইভ শাখায় সুশৃঙ্খলভাবে নথিপত্র সংরক্ষণ করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশে এখন বোধহয় তাদের আর্কাইভেই সবচেয়ে বেশি তথ্য সংরক্ষিত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট সংগ্রহশালা হয়েছে। সেখানে বা কারও কারও ব্যক্তিগত সংগ্রহে কিছু নথিপত্র থাকতে পারে। কিন্তু কোথায় কী আছে, তা জানার উপায় নেই। কোনো তালিকা প্রণয়নের চেষ্টাও হয়নি।
আসলে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের (যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন) প্রতিই নজর দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে; মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার প্রতি নয়। কোনো সরকারই এতে আগ্রহ দেখায়নি। একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এগিয়ে আসেনি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধারা আগামী এক দশকে কেউ থাকবেন না, তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার ভবিষ্যৎ নেই? আছে, যদি তথ্যের প্রাচুর্য থাকে। না হলে এত বড় একটি ঘটনার চর্চা স্তিমিত হয়ে আসবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার যদি এগিয়ে না আসে এ ক্ষেত্রে তাহলে আর কে আসবে?
পৃথিবীতে এমন ঘটনা খুব কম ঘটেছে যে, তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের নথিপত্র সংরক্ষিত হয়নি। প্রথম দিন থেকেই তারা এ বিষয়ে সচেষ্ট থেকেছে বাঙালিরা ছাড়া। এখনো সময় আছে, তবে তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয়ভাবে আলাদা একটি মুক্তিযুদ্ধ অভিলেখ্যাগার বা আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা বাঞ্ছনীয়, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত নথিপত্র, উপাদান, গ্রন্থ সংগৃহীত হবে।
নয়তো, আরও ৫০ বছর হয়তো শিশুরা পড়বে, ১০০ বছর আগে ১৯৭১ সালে একটি গন্ডগোল হয়েছিল এবং সে কারণে বাংলাদেশ হয়েছিল। বীর ও ভিকটিম কারও ইতিহাসই থাকবে না।
লেখক: ইতিহাস গবেষক, সাহিত্যিক ও অধ্যাপক