![ভর্তি পরীক্ষা এলেই সংঘাতে জড়ায় চবি ছাত্রলীগ](uploads/2024/02/18/1708238469.cu.jpg)
ভর্তি পরীক্ষা এলেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ছাত্রলীগ সংঘাতে জড়ায়, এটি নতুন কিছু নয়। আধিপত্য বিস্তার কিংবা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের বিষয়টি সামনে এলেও আড়ালেই থেকে যায় টাকা ভাগাভাগির বিষয়টি।
বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে গুঞ্জন রয়েছে, ভর্তি পরীক্ষা এলেই ক্যাম্পাস স্থিতিশীল রাখতে ছাত্রলীগকে দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একাধিক গ্রুপ রয়েছে। কমবেশি সব গ্রুপকেই টাকা দিতে হয়। আর টাকা কম পেলেই অনাসৃষ্টি।পরিকল্পিতভাবে সংঘাতে জড়িয়ে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করে রেখে প্রশাসনের কাছ থেকে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা।
সম্প্রতি আবারও সংঘর্ষে জড়িয়েছে চবি ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপ। আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব ঘটনার জের ধরে ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে চারবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক তিনটি উপগ্রুপ। লাগামহীন এ সংঘর্ষে তিন পুলিশ সদস্যসহ আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধশত শিক্ষার্থী। বারবার রক্তক্ষয়ী এসব সংঘর্ষে জড়ানো উপগ্রুপ তিনটি হলো সিক্সটি নাইন, চুজ ফেন্ডস উইথ কেয়ার (সিএফসি) এবং বিজয়।
তবে এসব সংঘর্ষের ঘটনার নেপথ্যে আসন্ন ভর্তি পরীক্ষার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এ নিয়ে সরাসরি মুখ খুলছেন না কেউ। ছাত্রলীগ নেতারাও বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে আধিপত্য দেখিয়ে বিভিন্ন খাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে নেয় বিভিন্ন গ্রুপ। এসব অর্থের ভাগাভাগির জটিলতা এ সংঘর্ষের কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত কয়েক বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও দেখা যায় প্রতিবছরই ভর্তি পরীক্ষার সময় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে আসছে ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপগ্রুপ। এমনকি পরীক্ষার সময়ও সংঘর্ষ করেছে তারা। এ সময় তাদের একটি ‘পার্সেন্টেজ’ দিয়ে শান্ত করেছে প্রশাসন। পরীক্ষার সময় ছাত্রলীগের সংঘর্ষ ও কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে এ ভাগবাঁটোয়ারা হয়ে থাকে। এ ছাড়া প্রশাসনের সুবিধার্থে ছাত্রলীগকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করার অভিযোগও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। যদিও এসব বিষয়ে সরাসরি মুখ খুলতে চান না কেউই।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে সংঘর্ষে জড়ায় শাখা ছাত্রলীগের দুই উপগ্রুপ সিক্সটি নাইন ও বিজয়। ঘটনার সূত্রপাত ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র কামরুল ইসলামের হল পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের জের ধরে গত ১২ ফেব্রুয়ারি সিক্সটি নাইনের কয়েকজন কর্মী কামরুলকে মারধর করেন। পরে তা গড়ায় সংঘর্ষে। রাতের এ সংঘর্ষের পরদিন বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) আগের এ ঘটনার জের ধরে ফের সংঘর্ষে জড়ায় গ্রুপ দুটি। ইটপাটকেল ও কাচের বোতল নিক্ষেপ করে উভয় গ্রুপ। এতে দুই গ্রুপের অন্তত ১৫ জন আহত হন। এ সময় পেশাগত দায়িত্ব পালন করার সময় ভিডিও ধারণকালে এক সাংবাদিকের ওপর চড়াও হন সিক্সটি নাইনের নেতা-কর্মীরা।
দুপুরের সংঘর্ষের রেশ না কাটতেই চায়ের দোকানের চেয়ারে বসাকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় সংঘর্ষে জড়ায় শাখা ছাত্রলীগের দুই উপগ্রুপ সিক্সটি নাইন ও সিএফসি। সংঘর্ষে সিক্সটি নাইন গ্রুপ শাহজালাল হলের সামনে ও সিএফসি গ্রুপ আমানত হলের সামনে অবস্থান নেয়।
হলগুলোর সামনে রাস্তায় ঢাল বসিয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। পাশাপাশি উভয় গ্রুপকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতে দেখা যায়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার এ সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হন। এ সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ধারালো অস্ত্র নিয়ে সাংবাদিকদের মারতে আসেন ও অশ্রাব্য গালগালি করেন সিএফসির কর্মীরা। পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় প্রক্টরিয়াল বডি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও দুই উপগ্রুপের উত্তেজনা কমেনি।
শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে ফের সংঘর্ষে জড়ায় এ গ্রুপ দুটি। জানা যায়, সিএফসির কয়েকজন কর্মী স্টেশনের দিকে যাওয়ার পথে সিক্সটি নাইনের কর্মীদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়, যা রূপ নেয় সংঘর্ষে। এ সংঘর্ষ চলে প্রায় রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। সিক্সটি নাইন গ্রুপ শাহজালাল হলের সামনে ও সিএফসি গ্রুপ আমানত হলের সামনে অবস্থান নেয়। একে অন্যকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ও কাচের বোতল নিক্ষেপ করেন উভয় গ্রুপের নেতা-কর্মীরা। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা চলমান এ সংঘর্ষে তিন পুলিশ সদস্যসহ ৩০ জনেরও বেশি আহত হন।
সংঘর্ষের ঘটনায় উভয় গ্রুপই একে অন্যকে দায় দিচ্ছে। দুটি গ্রুপের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, বিপরীত গ্রুপ আগে হামলা করেছে। দফায় দফায় ছাত্রলীগের সংঘর্ষের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি আবাসিক হলে তল্লাশি অভিযান চালায় পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল বডি। তল্লাশিতে পুলিশের চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম শাখার) আসাদুজ্জামান, হাটহাজারীর ওসি মনিরুজ্জামান, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জুয়নুল মিয়া ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. নুরুল আজিম সিকদার উপস্থিত ছিলেন। তল্লাশিতে কিছু দেশীয় অস্ত্র দা, কিরিচ, লোহার অস্ত্র, লাঠিসোঁটা পাওয়া গেছে বলে জানান প্রক্টর অধ্যাপক ড. নুরুল আজিম সিকদার। পাশাপাশি এসব সংঘর্ষের কারণ ও জড়িতদের বের করতে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সংঘর্ষ ও তদন্ত কমিটির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. নুরুল আজিম সিকদার বলেন, ‘ছাত্রদের অসহনশীলতা এসব সংঘর্ষের জন্য দায়ী। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এরা বারবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আমরা গত বৃহস্পতিবার তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তারা শুক্রবারের ঘটনারও তদন্ত করবেন। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা আগামীকাল (রবিবার) পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে বসব।’
এদিকে লাগাতার এ সংঘর্ষে লক্ষাধিক টাকার ক্ষয়ক্ষতিতে পড়েছেন শাহজালাল ও আমানত হলের সামনের দোকানিরা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ছাত্রলীগের গ্রুপগুলোর সংঘর্ষে খাবার হোটেলসহ বিভিন্ন দোকানপাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিভিন্ন দোকানের টিন, ফ্রিজ, বৈদ্যুতিক মিটার, বাল্ব ভাঙচুর হয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, এসব সংঘর্ষে তারা লক্ষাধিক টাকার ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছেন। কারও টিনশেড দোকান, কারও ফ্রিজ, কারও বেঞ্চ ভাঙচুর করা হয়েছে। ছাত্রলীগের এ ভয়াবহ তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আশপাশের আবাসিক এলাকাও।
লাগামহীন এসব সংঘর্ষে আতঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, প্রতিনিয়ত এসব সংঘর্ষের কারণে আশপাশের কটেজ, ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘কিছুদিন পরপর এসব ঘটনা ঘটছে, যা আমাদের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে। পাশাপাশি নতুন যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসছে, তারাও ভয় পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব ঘটনা ঘটলে পড়াশোনার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে।’ এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রশাসনের সাহায্য চান শিক্ষার্থীরা।
ছাত্রলীগের গ্রুপগুলোর মধ্যে এসব সংঘর্ষের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। সংঘর্ষের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একাডেমিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ফৌজদারি আইনেও ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ করেন তিনি। গতকাল শনিবার দুপুরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা এম এ খায়ের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে এ বিষয়টি জানা যায়।