![উপজেলা নির্বাচন : কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মানছেন না এমপি-মন্ত্রীরা](uploads/2024/04/05/1712299783.Upazilla_Election_AL.jpg)
আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে নৌকা প্রতীক কিংবা দলীয় সমর্থন দেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হলেও ক্ষমতাসীন দলের এমপি-মন্ত্রী এবং নেতারাই দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। তারা শুধু নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে প্রার্থী ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে এসব প্রার্থীকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ভোটও চাইছেন। এর ফলে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে এখন ‘এমপির আস্থাভাজন বনাম স্বতন্ত্র প্রার্থীর লড়াই’ চলছে। যদিও তৃণমূলে দলের এমন বিভেদ নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠোর হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতারা।
সম্প্রতি বিভাগীয় নেতাদের ঢাকায় এনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তৃণমূলের এসব দ্বন্দ্ব ও বিভক্তির বিষয়ে বিস্তর অভিযোগ করেছেন জেলা নেতারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোট আগামী ৮ মে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। প্রচার শুরু হবে ২৩ এপ্রিল থেকে। দ্বিতীয় ধাপে ১৬১টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ২১ মে ভোট গ্রহণ করা হবে।
আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে এখনো অনড় অবস্থানে রয়েছে। তাই নির্বাচন যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় এবং ভোটার উপস্থিতি যথেষ্ট থাকে, এমন কৌশল নিয়ে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রেখেছে আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে নেতা-কর্মীদের জয়ী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে দলটি। আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, প্রতীক না থাকলে প্রার্থীরা নিজের প্রয়োজনে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসবে। ফলে যার জনপ্রিয়তা বেশি সে-ই ভোটে লড়াই করে জয়ী হতে পারবেন। এ জন্য কেন্দ্রীয় নেতারাও নানা দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন।
তবে নিজ আসনের উপজেলায় কোনোভাবেই নিজের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে চাইছেন না স্থানীয় এমপিরা। তারা নিজের পছন্দের নেতাকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার পাশাপাশি প্রার্থীকে জেতানোর জন্য নানা তৎপরতাও শুরু করেছেন। আর এতে করে উপেক্ষিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের অসংখ্য উপজেলায় এমপি ও স্থানীয় নেতাদের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব-সংঘাতের খবর কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগেরও নজরে এসেছে। এজন্য একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার কাজে নিয়োজিত প্রশাসনও শতভাগ নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে এমন আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, কেউ কোনো ধরনের অবৈধ হস্তক্ষেপ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এর আগে গত সোমবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিদের সতর্ক করে দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে এমপি-মন্ত্রী কারোরই হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না। এমপি-মন্ত্রী আমার কেউ আছে তাকে জেতানোর জন্য নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করব- এটা কেউ করতে পারবেন না। ফ্রি স্টাইলে দল চলবে না। যার যেমন খুশি যখন-তখন দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য রাখবেন- সেটার দায় দল বহন করবে না। একজনের একটা বক্তব্য গোটা দলের শৃঙ্খলার ওপর আঘাত হানে- এমন কিছু হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার দলীয় নেতাদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দলে কিছু শাস্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানাভাবে দিয়েছেন। কতজন অনেক বড় জায়গা থেকে নেমে গেছে। শুধু জেলে পুরলেই শাস্তি, গায়ে আঘাত করলেই শাস্তি? শাস্তি অনেক রকম। এবার নেত্রী যে কৌশল নিয়েছেন, দলের মধ্যেও কেউ ফ্রি স্টাইল করলে শাস্তি কিন্তু পেতে হবে। তিনি সব নোট করে রাখেন, সময়মতো ব্যবস্থা নেবেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক খবরের কাগজকে বলেন, উপজেলা নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগই যেখানে কাউকে সমর্থন দিচ্ছে না, সেখানে দলের কোনো শাখার এখতিয়ারই নেই কাউকে সমর্থন দেওয়ার। কেউ এর ব্যত্যয় করতে চাইলে দল সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, যারা এমপি হয়ে দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবেন তাদেরকে নেতিবাচকভাবেই দেখা হবে।
তবে সাধারণ সম্পাদকসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের এসব হুঁশিয়ারি এখনো খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি মাঠ পর্যায়ে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক এমপি ও মন্ত্রী দলের এমন সিদ্ধান্তের খুব বেশি তোয়াক্কা করছেন না। দলীয়ভাবে মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা পরিষদের জন্য আওয়ামী লীগের ‘দলীয় প্রার্থী’ হিসেবে দুজনের নাম ঘোষণা করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান। গত ২৭ মার্চ এক আলোচনা সভায় তিনি এই ঘোষণা দেন। এ সময় উপস্থিত সবার সামনে ওই দুজনকে পরিচয়ও করিয়ে দেন মন্ত্রী। মন্ত্রীর এমন ঘোষণার পরপরই স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা শুরু হয়েছে। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে দলের মন্ত্রীর এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছেন না অন্য প্রার্থীরা। ইতোমধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে স্থানীয়ভাবে গণসংযোগ করা যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শামিম আল সাইফুল ও টিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ আখতারুজ্জামান মন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন।
গত রবিবার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও টাঙ্গাইল-১ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মীর ফারুক আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মঞ্জুরুল ইসলাম তপন। উপজেলা নির্বাচনে আব্দুর রাজ্জাক তার খালাতো ভাইকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন বলে অভিযোগ তোলা হয়।
দেশের অন্যান্য উপজেলায়ও এমন চিত্র। ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীন আহমেদ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন বলে আলোচনায় আছেন। তাকে সমর্থন দিচ্ছেন স্থানীয় এমপি এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এর পাশের আসন কেরানীগঞ্জ মডেল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেনকে উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম সমর্থন দিচ্ছেন বলে হিসেবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। সাভার উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলমকে প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দিচ্ছেন ঢাকা-১৯ (সাভার-আশুলিয়া) আসনের সংসদ সদস্য মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। তেঁতুলিয়া উপজেলার এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় পঞ্চগড়-১ আসনের সংসদ সদস্য নাঈমুজ্জামান ভূঁইয়া তেঁতুলিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সহসভাপতি আবদুল লতিফকে সমর্থন দেন।
গত ২১ মার্চ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনের বর্তমান এমপি এম এ মোতালেবের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতকে সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ তোলেন ওই আসনের সাবেক এমপি আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী। সংবাদ সম্মেলনে তিনি ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমপি এম এ মোতালেবের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সমঝোতার অভিযোগ তোলেন। আসন্ন উপজেলা নির্বাচন আশঙ্কা প্রকাশ করে সাবেক এমপি নদভী বলেন, হয়তো তাদের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে ভোটে আমাকে ঠেকালে, উপজেলার ভোটে তাদের (জামায়াত) দেওয়া হবে। কারণ এখন উপজেলা নির্বাচন ঘিরে তাদের সক্রিয় দেখা যাচ্ছে কেন? আমার সময়ে তো জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা এলাকায় ছিল না। এখন হাজার হাজার ক্যাডার সবাই মাঠে কেন? তিনি (এম এ মোতালেব) আওয়ামী লীগের না স্বতন্ত্র এমপি ? তার ছোট ভাই মাওলানা মাহমুদুল হক জামায়াতের সিনিয়র নেতা।
এ ছাড়াও কক্সবাজার সদরে মাহমুদুল করিমকে সমর্থন জানিয়েছেন হুইপ সাইমুম সরওয়ার কমল। রংপুরের বদরগঞ্জে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী বর্তমান চেয়ারম্যান ফজলে রাব্বীকে (সুইট) দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। ময়মনসিংহ ১ এর সংসদ সদস্য মাহমুদুল হক ধোবাউড়া উপজেলায় যুবলীগ নেতা আসাদুজ্জামানকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেন।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক দলের তৃণমূলের একাধিক নেতা বলেন, দল প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী ও দলের হেভিওয়েট নেতারাই নিজের পছন্দের নেতাকে সামনে আনছেন। প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছেন। প্রভাশালীরা দলের নেতা হয়েও দলের বিরুদ্ধে যাচ্ছেন। যেসব প্রার্থীর মাথায় প্রভাবশালীদের হাত নেই তাদের অনুসারীদের ওপর চলছে নির্যাতন, হামলা-মামলার হুমকি। এতে নেতা-কর্মীরা পড়েছেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে। কার পক্ষে কাজ করবেন সেটি নিয়ে উভয় সংকটে রয়েছেন তারা। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে এসব আশঙ্কা আরও বাড়বে। তবে কেউ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ কঠোর থাকবে বলে জানান কেন্দ্রীয় নেতারা।