![গরম পড়লেই পানি গায়েব, বাসা বদলান ভাড়াটিয়া](uploads/2024/04/26/1714114456.dhaka.jpg)
‘পানি নেই। বলার কোনো লোকও নেই। কাকে বলব কষ্টের কথা। এই যে গরম পড়ছে, এর মধ্যে যদি পানি না পাই, কীভাবে কী করব? ভাড়াটিয়ারা আমাদের সাথে চিল্লাপাল্লা করে, বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এভাবে কি চলা যায়?’ কথাগুলো বলছিলেন মিরপুরের বাউনিয়াবাদের ডি-ব্লকের একটি বাড়ির মালিক। তিনি তার বাসার পানির ট্যাংক দেখিয়ে বলেন, ‘দ্যাখেন, সামান্য একটু পানি আছে আর নিচের দিকে কী পরিমাণ ময়লা জমে আছে।’
এই এলাকার বাসিন্দা অজিফা বেগমও জানালেন তাদের দুর্ভোগের কথা। বলেন, ‘পানির অভাবে এই অসহ্য গরমের মধ্যে অনেক কষ্ট করে চলি। গরম পড়লেই যেন পানি গায়েব! পানি হলে জানটা বাঁচে। পলাশনগর থেকে কলসি ভরে ভরে পানি আনতে হয়। দুই মাস ধরে কষ্ট করছি। রোজার মাসেও অনেক কষ্ট হয়েছে ছেলেপেলে নিয়ে। লাইনের পানিতে গোসল করা যাচ্ছে না, ঘরের কাজকর্মও করা যাচ্ছে না। আর পানিতে দুর্গন্ধ, আমাদের এখানে বাচ্চাদের পেট খারাপ হচ্ছে, রোগবালাই বাড়ছে।’
সেখানে থাকা আরেক নারী শারমিন বলেন, ‘পানি টেনে এনে ড্রাম ভর্তি করে কেউ কেউ রাখে। তাতেও কাজ হয় না। গরমে পানি লাগে বেশি। আমি ও আমার বাচ্চা এখনো গোসল করতে পারি নাই। পানি নাই কিন্তু বিল ঠিকই দিতে হয়।’
এমন চিত্র শুধু বাউনিয়াবাদে নয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শুকনো মৌসুমে প্রতিবছরই এমন কষ্টের মুখে পড়েন মানুষ। মিরপুর, পূর্ব কাফরুল, মোহাম্মদপুর, বাসাবো, খিলগাঁও, খিলক্ষেত, গোড়ান, বাড্ডা, রামপুরা, লালবাগ, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ীসহ আরও বেশ কিছু এলাকায় পানিসংকটের তথ্য পাওয়া যায়। অন্যান্য এলাকায় বেশির ভাগ সময় পানি থাকলেও মাঝেমধ্যে হঠাৎ করেই পানি পাওয়া যায় না। আবার অনেক এলাকায় হঠাৎ করেই আসে ময়লা পানি।
বাউনিয়াবাদের এক চায়ের দোকানে কয়েকজন বললেন, শুধু কী পানির সমস্যা? গ্যাস সমস্যা এখানে চরম আকার ধারণ করেছে। হাহাকার চলছে। রাত গভীর হলে গ্যাসের চাপ একটু বাড়ে। কিন্তু এত রাতে মানুষ কী করবে গ্যাস দিয়ে? একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে খবরের কাগজের প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওনাদের বলেন, চুলা উঠায়ে নিয়ে যাক।’
শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পানির সমস্যা বেড়েছে পূর্ব কাফরুলে। বাসিন্দারা বলছেন, তীব্র তাপপ্রবাহ শুরুর পর থেকে ওয়াসার লাইনে পানি ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। আগে যখনই মোটর চালু করা হতো, লাইনে পানি পাওয়া যেত। এখন দিনের নির্দিষ্ট সময়ে লাইনে পানি দিচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এর বাইরে অন্য সময়ে লাইনে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি ওয়াসাকে জানানো হলেও কোনো প্রতিকার মেলেনি।
ওই এলাকার বাসিন্দা এস এম ময়েজ বলেন, ‘একদিকে গরমে অবস্থা কাহিল, অন্যদিকে পানিসংকট। সব মিলিয়ে আমাদের ভোগান্তি বেড়েছে। পানির জন্য অনেকেই আশপাশের মসজিদ, মাদ্রাসা বা গভীর নলকূপ থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সবার পক্ষে দূরে গিয়ে পানি বহন করে নিয়ে আসাও সম্ভব হয় না।’
তবে মিরপুরের অনেক এলাকায় পানির সংকট আগের বছরগুলোর চেয়ে কমেছে। বিশেষ করে একাধিক পাম্প বসানোয় অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে জানান এলাকার মানুষ। মিরপুরের ভাসানটেক, টোনারটেক, ১৩ নম্বর, কাজীপাড়া ও শ্যাওড়াপাড়ায় বসবাসকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব এলাকার অনেক অংশেই দীর্ঘদিনের পানির সমস্যা অনেকটাই কমেছে। পশ্চিম ভাসানটেক দেওয়ানপাড়ায় নতুন করে দুটি পাম্প বসানো হয়েছে বলে জানান সেখানকার আবদুল্লাহ হোটেলের মালিক। গতকাল দুপুরে কথা হয় টোনারবাগের একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে। তারা জানান, পাঁচ বছরের বেশি অনেক কষ্ট করেছেন। মাসখানেক আগেও পানির জন্য তাদের ভুগতে হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি পাম্প চালু করায় পানির সমস্যা সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে।
খিলক্ষেতে লাইনের পানিতেও সংকট
অতি গরমের কারণে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় সুপেয় পানির চাহিদা বেড়েছে। অন্যদিকে ওয়াসার পক্ষ থেকে সরবরাহ করা লাইনের পানিতেও মাঝে মাঝে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খিলক্ষেতে যেসব বাড়িতে পানির নিজস্ব সোর্স রয়েছে, সেগুলোতে পানির সংকট কম। আর যেসব বাড়িতে ওয়াসার পানি সরবরাহ করা হয়, সেসব বাড়িতে এবং কলোনিগুলোতে পানির সংকট রয়েছে। খিলক্ষেত বাজারসংলগ্ন (ট্রিমের গলি) কলোনিতে কথা হয় শেরপুরের বাসিন্দা সোহাগ হোসেনের সঙ্গে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘লাইনে পানি থাকে না। কিন্তু আমাদের এখানে চাপকল আছে। তখন সেখান থেকে পানি নিয়ে কাজ সারতে হয়।’
খিলক্ষেতের উত্তর পাড়ায় থাকেন রিভা কিডসের বিক্রেতা সোহান। পানি সমস্যা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আজকেও (বৃহস্পতিবার) লাইনে পানি ছিল না। এ ছাড়া মাঝে মাঝে পানির সমস্যা হয়। তখন গোসল করা যায় না। রান্নার কাজও বন্ধ হয়ে যায়। তবে ভালো হচ্ছে বেশিক্ষণ পানি না থাকলে মাইকিং করে বলে দেয়।’
অতি গরমের কারণে খিলক্ষেতের ওয়াসার ১ নম্বর পানির পাম্প স্টেশনে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক গ্রাহক বেড়েছে। ওয়াসার এটিএম কার্ডের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করতে হয়। প্রতি লিটার পানির মূল্য রাখা হয় ৮০ পয়সা। তবে এখানে পানি নেওয়ার জন্য দুটি মেশিন রয়েছে। প্রায়ই কারিগরি ত্রুটির কারণে একটি বন্ধ থাকে বলে অভিযোগ করেন সেবা নিতে আসা লোকজন। তবে সরেজমিনে দুটি মেশিনই সচল দেখা গেছে। কুর্মিটোলা স্কুলের পাশের বাসিন্দা শাহাদাৎ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘পানির বুথ আগের জায়গায় খোলামেলা ছিল। এখন জায়গাটা একটু ছোট হয়েছে। এ কারণে পানির জন্য লাইন রাস্তার ওপর চলে আসছে। অনেক সময় ইন্টারনেট না থাকলে পানি না পেয়ে ফেরত যেতে হয়। তখন ভোগান্তি হয়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দায়িত্বরত কর্মকর্তা ইয়াসিন খবরের কাগজকে বলেন, গরমের কারণে পানির চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। এখন প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার লিটার পানির চাহিদা রয়েছে। গরমের কারণে প্রায় ৫ হাজার লিটার বেশি পানি বিক্রি হচ্ছে।
অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যখন ইন্টারনেট থাকে না, তখন আমরা বিকল্পভাবে পানি দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু যখন নেট আর বিকল্প পদ্ধতির কোনোটাই কাজ করে না, তখন পানি দেওয়া বন্ধ রাখা হয়।’