![অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এনবিআরের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক আজ](uploads/2024/05/12/economic-1715490658.jpg)
আগামী অর্থবছরের বাজেটে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ বা প্রত্যাহার করা নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) জোরালো চাপ আছে। বাজেটে অনেক পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্তিতে সমাজের প্রভাবশালীদের কাছ থেকে এনবিআরে তদবির চলছে। এসব বিতর্কিত ও অমীমাংসিত ইস্যুতে আজকের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এনবিআরের বাজেট প্রস্তুতির কর্মকর্তারা অর্থমন্ত্রী আবু হাসান মাহমুদ আলীর কাছ থেকে পরামর্শ নেবেন।
এনবিআর থেকে অর্থমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপনের জন্য তৈরি প্রতিবেদন থেকে এসব জানা যায়। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনের জন্য শনিবার (১১ মে) সকাল থেকেই প্রায় সারা দিন এনবিআর কর্মকর্তারা কাজ করেছেন। বৈঠকটি এনবিআরে হওয়ার কথা আছে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েও হচ্ছে না। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, এনবিআর ও আইএমএফ থেকে ভিন্ন ভিন্ন হিসাব কষছে। এ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আজকে এনবিআরের বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তারা নিজের যুক্তি তুলে ধরবেন।
আজকের এ বৈঠকে করমুক্ত আয়সীমা, বিশেষ সুবিধায় অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করা, অর্থ পাচাররোধে করণীয়, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে পদক্ষেপ গ্রহণ, বিদেশে যাওয়ার আগে কর্মকর্তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ সংশ্লিষ্ট তথ্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে জানানো, সর্বস্তরে ভ্যাটের সর্বোচ্চ হার ১৫ শতাংশ নির্ধারণ, এনবিআর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা নির্ধারণ, রিটার্ন প্রদানে কঠোরতা এবং আমদানি-রপ্তানিতে স্বচ্ছতা আনার বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হবে। আরও আলোচনা হবে শিল্পে বেশি ব্যবহৃত কোন কোন কাঁচামাল আমদানিতে কতটা ছাড় বা রাজস্ব মওকুফ সুবিধা দেওয়া যায়।
আইএমএফ কঠোরভাবে জানিয়ে দিয়েছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে কোনোভাবেই কর অবকাশ সুবিধা, রাজস্ব (কর-শুল্ক-ভ্যাট) ছাড় ও অব্যাহতি বাড়ানো বা নতুনভাবে দেওয়া যাবে না। কিন্তু আইএমএফের সূত্রে বাজেটের ছক কষা বা এ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা এনবিআরের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ তৈরি পোশাক খাত, জ্বালানি খাত, চমড়া, মোবাইল, তথ্যপ্রযুক্তিসহ শিল্পের অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে এসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এসব খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া এসব খাতের ব্যবসায়ী নেতারাও প্রভাবশালী। এসব খাতের শিল্পকারখানার অনেক মালিকও ব্যক্তিগতভাবে কর সুবিধা নিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের বাজেট প্রস্তুত কমিটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, বাজেটে কী গ্রহণ করা হবে বা কী বাদ দেওয়া হবে, তা নিয়ে এনবিআরের ওপর আইএমএফের জোরালো চাপ রয়েছে। সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজেদের সুবিধামতো অনেক সিদ্ধান্ত বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে বা বাদ দিতে চান। এ জন্য এনবিআরের কাছে তাদের অনেকেই তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। জাতীয় স্বার্থকে প্রধান্য না দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই এসব বিষয়ে এনবিআর নিজে থেকে কোনো দায়িত্ব নিতে চায় না। আজকের বৈঠকে সেসব বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে পরামর্শ চাওয়া হবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এনবিআরকে অনেক চাপ নিয়ে বাজেট প্রস্তুত করতে হয়। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সুপারিশ পাঠিয়ে তা বাস্তবায়নের চাপ থাকে। দেশের মধ্যে প্রভাবশালীরা নিজেদের স্বার্থে পদক্ষেপ গ্রহণে সমাজের ক্ষমতাবানদের দিয়ে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে এনবিআরের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। সবার প্রথমে ভাবতে হয় দেশের অর্থনীতির জন্য কোনটা প্রয়োজন। এবারের বাজেট প্রণয়ন অন্য যেকোনো বারের তুলনায় কঠিন। কারণ আইএমএফ থেকে ঋণ কিস্তি প্রদানের অন্যতম শর্ত হলো প্রতিষ্ঠানটির শর্ত মেনে বাজেট করা। অথচ এসব শর্ত মানা হলে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অর্থনীতির জন্য তা ভালো হবে না।’
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘এইচএস জটিলতার কারণে কোনো পণ্যের শুল্ক কমবেশি হয়। এ জটিলতার কারণে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা গচ্চা যায়। আশা করি আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিষয়টি সমাধান করা হবে। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের দাবি মানতে হবে।’
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এ বৈঠকে এইচএস কোডজনিত জটিলতা নিয়েও আলোচনা হবে। কোন পণ্য কোন এইচএস কোডের আওতায় আমদানি-রপ্তানিকালে শুল্ক নির্ধারিত হবে, তা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এনবিআরের ভিন্ন মত রয়েছে। আর এতে ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ শুল্ক দেন বেশির ভাগ সময় এনবিআর তারচেয়ে বেশি পরিমাণের শুল্ক দাবি করে থাকে। আজকের বৈঠকে যে যে পণ্য নিয়ে এ ধরনের জটিলতা বেশি হয়, তা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়া হবে। ভ্যাটযোগ্য কিন্তু ভ্যাটের আওতায় নেই, এমন সব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে হিসাবমতো ভ্যাট আদায়ের কৌশল নিয়েও আজকের বৈঠকে অর্থমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হবে। সব খাতেই ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ নির্ধারণ নিয়ে আইএমএফ চাপ দিয়ে রেখেছে। এ উদ্যোগের ঘোর বিরোধী দেশের ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর মতামত চাওয়া হবে। স্বচ্ছতার সঙ্গে ভ্যাট আদায়ে ব্যবহৃত ইএফডি যন্ত্র (ইলেকট্রো ফিসক্যাল ডিভাইস) সরবরাহের বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে ঝুলে আছে, যা নিয়ে সমালোচনার মুখে আছে এনবিআর। এ যন্ত্র দ্রুত আমদানি করে সারা দেশের বিক্রয় প্রতিষ্ঠানে সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ-প্রস্ততি কী, তা সাধারণ মানুষকে জানাতে বাজেট প্রস্তাবে কী লেখা থাকবে- এ নিয়েও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবে এনবিআর।
চলতি অর্থবছরের শুরুতে এনবিআরকে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। আইএমএফ থেকে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআরের ওপর চাপ থাকলেও এরই মধ্যে রাজস্ব ঘাটতি ২২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সংশোধন করে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়াচ্ছে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এমন প্রেক্ষাপটেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আগামী অর্থবছরের জন্য এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি নির্ধারণে চাপ দেওয়া হয়েছে। এনবিআর তার বিরোধিতা করে লক্ষ্যমাত্রা চলতি বারের মতো রাখার কথা বলেছে।
সূত্র জানিয়েছে, এনবিআর আগামী অর্থবছরের জন্য আপাতত ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা ধরে হিসাব কষে বাজেটের রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণে কাজ করছে। এনবিআর থেকে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে তা নির্ধারণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সহযোগিতা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।