![সিলেটের চিনি চোরাকারবারে বাঘা বাঘা নেতা জড়িত](uploads/2024/06/16/bianibazar-1718520677.jpg)
সিলেটে চোরাই চিনির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতা জড়িত! খবরের কাগজকে এ রকম এক সত্য বয়ান দিয়েছেন বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের টানা দুবারের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আবুল কাশেম পল্লব।
বিয়ানীবাজারে সরকারি নিলাম ডাকের ২৪ লাখ টাকার চিনি লুটের ঘটনায় ছাত্রলীগের নাম আসায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে পল্লব মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। খবরের কাগজের অনুসন্ধানে তার এ ভূমিকা দলীয় অঙ্গনে ‘সত্যবাদী যুধিষ্ঠির’ হিসেবে সমালোচিত হয়।
পল্লব স্থানীয় ছাত্রলীগের জড়িত থাকার বিষয়টি ধামাচাপা দিতে নিলাম ডাকে চিনি কেনা ব্যবসায়ীকেও হুমকি-ধমকি দিয়েছিলেন। সেসব হুমকির ফোনালাপ খবরের কাগজের হাতে এলে যোগাযোগ করলে পল্লব হুমকির বিষয়টি অস্বীকার করেননি। তার দাবি, ঘটনা ধামাচাপা নয়, লুটের চিনি উদ্ধার করে ছাত্রলীগের নতুন কমিটির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সমাধান করতে চেয়েছিলেন তিনি। এসব অভিযোগ মাথা পেতে নিয়ে চোরাই চিনি প্রসঙ্গে নিজ দলের তৎপরতার কথা খোলামেলাভাবে বলেছেন। খবরের কাগজকে দেওয়া তার বয়ানমতে, সিলেটে ‘চোরাই চিনির সঙ্গে বাঘা বাঘা লিডার জড়িত!’
ভারতের আসামঘেঁষা জনপদ সিলেটের সীমান্ত উপজেলা বিয়ানীবাজার। সেখানকার চিনি-কাহিনি এখন মানুষের মুখে মুখে। নিলাম ডাকের চিনি লুটে ছাত্রলীগ জড়িত থাকার বিষয়টি খবরের কাগজ প্রথম উন্মোচন করে। এরপর ছাত্রলীগের দুই নেতার ফোনালাপ প্রকাশ ও পরবর্তী পর্যায়ে স্থানীয় ছাত্রলীগের দুটি কমিটি কেন্দ্র থেকে বিলুপ্তির ঘটনায় বিয়ানীবাজারের বিষয়টি এখন সিলেট অঞ্চলে বহুল আলোচিত একটি বিষয়। এ নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনও সরগরম।
জানা গেছে, অন্তর্দলীয় কোন্দলের কারণে প্রায় ৩৩ বছর ধরে বিয়ানীবাজার উপজেলা ও পৌরসভায় ছাত্রলীগের কোনো কমিটি ছিল না। গত ১১ মার্চ কেন্দ্র থেকে অনুমোদন নিয়ে উপজেলা ও পৌর কমিটি ঘোষণা করেছিল জেলা ছাত্রলীগ। মাত্র তিন মাসের মাথায় কমিটি বিলুপ্তির কারণ হিসেবে চিনি লুটের ঘটনাটি আরও আলোচিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে ছাত্রলীগের কমিটি হওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের যেসব নেতা ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন আবুল কাশেম পল্লব। চিনি লুটের ফোনালাপকারী উপজেলা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হক তাহমিদের গ্রুপটি ছিল পল্লবের অনুসারী।
রাজনৈতিকভাবে সিলেটজুড়ে আলোচনায় এখন সরকারদলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব। নিজের গড়া ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত হওয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ। কোনো রাখঢাক না করেই চোরাই চিনির আদ্যোপান্ত নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। গত ১৪ জুন পল্লবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে চিনি লুটের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি খবরের কাগজের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে সম্মত হন। তার অনুমতি নিয়ে ফোনে রেকর্ড করা হয় তার বলা সব কথা। মোট ১৩ মিনিট তিনি এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন।
বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব বলেন, ‘এই চিনির সঙ্গে অনেক মানুষ জড়িত। ছাত্রলীগ কেউ আমার না। ছাত্রলীগ সবার। এই জিনিসগুলো আমরা জানিও না কী হইছে। আমি ঘটনা শুনেছি তিন দিন পর। ওসি সাহেব আমাকে বলছেন চিনি কেলেঙ্কারি একটি হয়েছে বিয়ানীবাজারে। শ্রীধরা গ্রামে চিনি প্রথম আসছে। খাঁচারপাড়া আসার পর সাগরসহ যে পেরেছে, সেই চিনি নিয়েছে। এতভাবে চিনিটা বণ্টন হয়েছে, এখন এগুলো্ বের করা মুশকিল হয়ে গেছে। পরে চিনির মালিক বদরুল আসে আমার কাছে। সে বলল তার ৪০০ বস্তা চিনি। যেকোনো উপায়ে চিনিগুলা উদ্ধার করা লাগব। তখন আমি ওসিকে জিজ্ঞেস করি, আপনি বলেন এর সঙ্গে জড়িত কারা। তখন ওসি আমাদের দলীয় কিছু ছেলের নাম বলেন। এই নামগুলো শোনার পর আমি তাদের প্রেশার দিই যেকোনোভাবেই হোক তার চিনি ফেরত দিতে।’
বিয়ানীবাজার উপজেলা সীমান্তঘেঁষা হলেও বেশির ভাগ মানুষ প্রবাসী। যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে আছেন এ উপজেলার মানুষজন। বিয়ানীবাজারের এক পাশে ভারতের আসাম রাজ্যের সীমান্ত। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাশেম পল্লব জানান, বিয়ানীবাজারে আসা চোরাই চিনির উৎস সীমান্তপথ ছাড়াও মাথিউরা এবং প্রতিবেশী উপজেলা বড়লেখা ও জুড়ী। তিনি বলেন, ‘চিনি লুটের পর তখন তাদের বক্তব্য শুনে বুঝলাম কেউ ১০ বস্তা, কেউ ৫ বস্তা, কেউ দুই বস্তা নিয়েছে। এর মধ্যে চৌকস কিছু ছেলে ছিল, যারা এই চিনির সুবিধা দীর্ঘদিন থেকে পেয়ে আসছে। এই যে কিছু চক্র আছে, এরা বিভিন্ন জায়গা থেকে চিনি হরিলুট করেছে। তারা সঙ্গে পিকআপ দিয়ে কিছু চিনি সিলেট পাঠিয়েছে। কিছু বড়লেখা, জুড়ী, মাথিউরা পাঠিয়েছে। যখন আমরা দু-চারজন মানুষের নাম পেয়েছি, তখন তাদের প্রেশার দিয়েছি চিনিগুলো ফেরত দেওয়ার জন্য। এরপর আমি ওসি সাহেবকে নিয়ে ৮০ বস্তা চিনি উদ্ধার করে দিয়েছি।’
লুট করা চিনির মালিক ব্যবসায়ীকেও দায়ী করেন পল্লব। তিনি বলেন, ‘এই চিনির মেইন হোতা বদরুলের কাছ থেকে আমি জানতে চাই- এই চিনি রহস্যের কথা। তখন চিনির মালিক কিছু নাম বলেন। সেই নামগুলো শুনে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। দেখি চোরাই চিনির সঙ্গে জড়িত বাঘা বাঘা লিডার। তখন আমি বদরুলকে জিজ্ঞেস করি তোমার চিনির সঙ্গে এমন কেন হলো। তার বক্তব্য হলো যে এক গাড়ি চিনি কিনি নিলাম থেকে। এই বৈধ চিনির সঙ্গে সে আরও ১০ গাড়ি অবৈধ চিনি বিক্রি করে। এই বদরুলের সঙ্গে জড়িত আছে আরও অন্তত ৩০ জন। এরা সবাই চাঁদা নেয়। এই অবৈধ চিনির সঙ্গে বর্ডার গার্ড (বিজিবি) জড়িত, পুলিশ প্রশাসন জড়িত, অনেক এমপি জড়িত, জেলার নেতারা জড়িত, অনেক ব্যবসায়ী জড়িত, ছাত্রলীগ জড়িত। চিনির একটি চক্র তৈরি করেছে। কিন্তু এর মূল হোতা বিয়ানীবাজারের ছেলেরা না। আমাদের দলের কিছু মানুষ নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য এই ঘটনাটিকে অতিরঞ্জিত করেছে।’
লুট করা চিনির মালিকের সঙ্গে তার একটি ফোনালাপও ফাঁস হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আবুল কাশের পল্লব বলেন, ‘আমি ফোনে বদরুলের (নিলাম ডাকে কেনা চিনির মালিক, ব্যবসায়ী) গালি দিয়েছি। ... বাচ্চারে (অশ্লীল) আমি গালি দিয়েছি সে কি এটা ভাইরাল করছে নি? ওটার ভাইরালে শুনতে পারবেন ওরে কী গালি দিয়েছি। আমি গালি দিয়েছি, কারণ তার অবৈধ চিনি বৈধ করার জন্য নিলামে চিনি কেনে। তার কারণে এই চোরাই চিনি বিয়ানীবাজারে প্রবেশ করে। তাই তারে গালি দিয়েছি।’
উল্লেখ্য, বিয়ানীবাজারে সরকারি নিলাম ডাকের ‘২৪ লাখ টাকার চিনি’ লুট করে ছাত্রলীগ। এ ঘটনায় চিনির মালিক ব্যবসায়ীদের একজন মো. নজরুল হোসেন ১১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও সাত-আটজনকে আসামি করে বিয়ানীবাজার থানায় মামলা করেন। মামলার দুই আসামি গ্রেপ্তার করে চিনি উদ্ধার অভিযানে নামে পুলিশ। লুট হওয়া ৪০০ বস্তা চিনির মধ্যে পরিত্যক্ত অবস্থায় ৮০ বস্তা চিনি উদ্ধার করে পুলিশ। পৃথক স্থান থেকে চিনি ছিনিয়ে নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত পিকআপ ভ্যানটিও জব্দ করা হয়।
লুটের চিনি ভাগাভাগি নিয়ে বিয়ানীবাজার উপজেলা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সহসভাপতি সফিউল্লাহ সাগরের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হক তাহমিদের মোবাইল ফোনে কথোপকথনের একটি অডিও ক্লিপ খবরের কাগজের হাতে আসে। শুক্রবার দুই নেতার ফোনালাপ, ‘ছাত্রলীগের লুটের চিনি, পিঁপড়ার মতো ভাগাভাগি!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন খবরের কাগজে ছাপা সংস্করণ ও অনলাইনে প্রকাশ হয়। এর আগে খবরের কাগজের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ফোনালাপের অডিও প্রকাশ করা হয়।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানায়, ফোনালাপের বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে তদন্ত করা হয়। এর মধ্যে জেলা পুলিশের অপরাধ শাখার প্রতিবেদনে খবরের কাগজে প্রকাশিত সব কটি প্রতিবেদনই সত্য বলে জানানো হলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কমিটি বাতিল ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে।
সিলেট অঞ্চলের সীমান্তপথে চিনি চোরাচালান বেড়ে যাওয়ায় এবং দেশি চিনির ব্যবসা প্রায় ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হওয়ায় খবরের কাগজে ধারাবাহিকভাবে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর সূত্র ধরে গত ৬ জুন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ১৪ ট্রাক চোরাই চিনি জব্দ করে। ৭ জুন খবরের কাগজে ‘অচেনা এমপির লোক কারা?’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর এ-সংক্রান্ত সরেজমিন ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও ডিজিটাল মাধ্যমে ভিডিও স্টোরি প্রকাশ হয়। এ নিয়ে সব মহলে চাঞ্চল্য তৈরি হলে বিয়ানীবাজারে গত ৮ জুন ঘটে সরকারি নিলাম ডাকে বিক্রি হওয়া ৪০০ বস্তা চিনি লুটের ঘটনা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের মাধ্যমে স্থানীয় ছাত্রলীগ জড়িত থাকার তথ্য খবরের কাগজ প্রথম প্রকাশ করে। বিয়ানীবাজারে চিনি লুট ইস্যুতে একটানা চার দিন ফলোআপ প্রতিবেদন প্রকাশের পর সর্বশেষ গত শুক্রবার প্রকাশ হয় চাঞ্চল্যকর ফোনালাপ নিয়ে প্রতিবেদনটি। খবরের কাগজে ‘ছাত্রলীগের লুট করা চিনি, পিঁপড়ার মতো ভাগাভাগি!’ শিরোনামে প্রতিবেদন ও ফোনালাপের অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। গত শুক্রবার দিনভর সিলেটজুড়ে এ আলোচনার মধ্যে বিকেলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটি বাতিলের ঘোষণা আসে।