ঈদুল আজহায় সড়কপথে প্রাণহানির কারণ হিসেবে এবার অতিরিক্ত গতির সঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ সড়ক কাঠামোর কথা উঠে এসেছে সবিস্তারে। এ ছাড়া বরাবরের মতো এবারও দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে বেপরোয়া গতির বাস, মোটরসাইকেল, ইজিবাইকের কথা বলা হয়েছে।
গত ১১ জুন থেকে ঈদুল আজহার ঘরযাত্রা শুরু হয়। সেদিন থেকে ঈদ-পরবর্তী দুদিনে যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে সারা দেশে তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনার কারণ সড়ক-মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন। এ ছাড়া বেপরোয়া গতির মোটরসাইকেল তো রয়েছেই।
গত মঙ্গলবার (১৮ জুন) গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে বরিশাল-ঢাকা রুটের বাস মাদারীপুর পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে প্রাইভেট কারের সংঘর্ষ হয়। হাইওয়ে পুলিশ জানায়, একটি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইককে সাইড দিতে গিয়ে প্রাইভেট কারটি বাসের সামনে চলে আসে। এ ঘটনায় নিহত হন দুজন। মারাত্মকভাবে আহত হন আরও ১০ জন। এর আগে পবিত্র ঈদুল আজহার দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থেকে মোটরসাইকেলে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন দুই ভাই হুমায়ূন খান ও রবিউল। পথে আশুগঞ্জের কাছাকাছি সোহাগপুর এলাকায় এসে নিয়ন্ত্রণ হারায় তাদের মোটরসাইকেল, ধাক্কা দেয় রোড ডিভাইডারে। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে পাঠালে চিকিৎসক দুজনকেই মৃত ঘোষণা করেন। ঈদের দিন সকালে কুয়াকাটা-ঢাকা রুটের ব্যাপারী পরিবহন দুর্ঘটনায় পড়ে বরিশাল সদর উপজেলার কাশিপুর ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারের সামনে। বাসটি একটি ট্রাককে পেছন থেকে জোরে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। সেই সঙ্গে ট্রাকটি মহাসড়কের পাশের পুকুরে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই বাসের সুপারভাইজার নিহত হন। কুষ্টিয়ায় গত তিন দিনে ৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ১২ জন। হতাহতরা অধিকাংশই মোটরসাইকেলের আরোহী। বেপরোয়া গতির কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি হাইওয়ে পুলিশের।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএর হিসাবে গত ১১ জুন থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত ১২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১২৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৭১ জন। তবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, প্রকৃতপক্ষে ঈদুল আজহায় সড়কে প্রাণহানির ঘটনা আরও বেশি।
দ্রুতগতির পাশাপাশি সড়ক-মহাসড়কে সার্ভিস লেন না থাকা, জাতীয় আঞ্চলিক মহাসড়কের নানা স্থানে অপরিকল্পিতভাবে গ্রামীণ সড়কের সংযুক্তিকে দুর্ঘটনার বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
বুধবার (১৯ জুন) সকালে সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে ঈদ-পরবর্তী ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করার কথা বলছি। কিন্তু সেখানে আগে সার্ভিস লেন দিতে হবে যেন ধীরগতির যানবাহনগুলো সেখানে চলতে পারে।
মোটরসাইকেল, ইজিবাইক নীতিমালা করার নির্দেশনা
সড়ক-মহাসড়কে চলাচলের সময় গতিসীমা নীতিমালার তোয়াক্কা না করে একের পর এক দুর্ঘটনার কারণ হয়ে উঠা মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকগুলোকে এবার নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ঈদ-পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরীকে নির্দেশনা দেন মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক নীতিমালা প্রণয়নের জন্য।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ইদানিং অ্যাক্সিডেন্টের যে প্রবণতা তাতে দেখা যাচ্ছে, মোটরসাইকেলে অ্যাক্সিডেন্ট বেশি। ইজিবাইকগুলোও অ্যাক্সিডেন্টের মূল কারণ। দেখা যাচ্ছে এ পর্যন্ত যত অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে তার মধ্যে মোটরসাইকেলে সবচেয়ে বেশি; এরপরে ইজিবাইক। সচিব সাহেবকে বলব, নীতিমালা করা প্রয়োজন। সারা দেশে লাখ লাখ তিনচাকার গাড়ি (ইজিবাইক), মোটরসাইকেল। এগুলো রাস্তার শৃঙ্খলাকে নিদারুণভাবে বিঘ্নিত করছে। কাজেই এখানে একটা সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।’
রোড সেফটি প্রজেক্ট দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশনা
২০২২ সালের মার্চে জানানো হয়, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মহাসড়ক এবং জেলা পর্যায়ের সড়কগুলো নিরাপদ করতে বাংলাদেশকে ৩৫৮ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক জানায়, বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) থেকে ৩০ বছর মেয়াদি এই অর্থায়ন করা হবে। বিশ্বব্যাংক তখন জানিয়েছিল, পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে গাজীপুর-এলেঙ্গা মহাসড়ক এবং নাটোর-নবাবগঞ্জ মহাসড়ককে বেছে নেওয়া হবে। এই দুই সড়কের নকশা, সড়কে নির্দেশনামূলক চিহ্ন, জরুরি সেবা, পথচারীদের সুবিধা, গতি নিয়ন্ত্রণ ও জরুরি সেবা সুবিধা নিয়ে কাজ করা হবে। সমস্যা চিহ্নিত করে সড়কের উন্নয়ন ঘটানো হলে এই দুই মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার ৩০ ভাগ কমে যাবে। এই দুটি জাতীয় সড়কের পাশে টোল ফ্রি জরুরি নাম্বারে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করা হবে। নির্বাচিত জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি সেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হবে। এ ছাড়া কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলে সমন্বিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তা চিহ্নিত করা হবে এবং পথচারীদের সচেতনতা বাড়াতে ও আচরণগত পরিবর্তনের জন্য প্রচারণাও চালানো হবে।
বিশ্বব্যাংক জানায়, এই প্রকল্পের অধীনে জেলা পর্যায়ের সড়ক উন্নয়ন, ট্রাফিক পুলিশের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বাড়ানো হবে। পাশাপাশি সড়ক নিরাপত্তা সক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশ পুলিশের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে, যেখানে পেশাদার চালকদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।
বুধবারের সভায় ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের এই প্রকল্প দ্রুত যুক্তিযুক্ত করে কার্যকর করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের নানা প্রকল্প প্রলম্বিত হয়। কথা শুনতে হয়, এত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে, কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না। এ কাজটা যেন তাড়াতাড়ি হয়, সেজন্য আমাদের আরও নজরদারি বাড়াতে হবে।’
পরে এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী খবরের কাগজকে জানান, রোড সেফটি প্রজেক্টের আওতায় গত মঙ্গলবার ৩০০ কোটি ডলার বরাদ্দ পেয়েছে মন্ত্রণালয়। এই অর্থায়নে রোড সেফটি প্রকল্পের জন্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগের পাশাপাশি নিরাপদ সড়কের বিষয়ে সচেতনতা, অ্যাম্বুলেন্স ক্রয়ের কাজটি সম্পন্ন করা হবে।
গণপরিবহন সংকট ও নীতি বাস্তবায়নে গলদ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা
প্রতিবছর ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র একই রকম থাকছে বলে মন্তব্য করেছেন পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সড়কযাত্রা নিরাপদ রাখতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করলেও সেসব বাস্তবায়নে গলদ থেকে যাচ্ছে।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম হাদিউজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঈদযাত্রায় গণপরিবহন সংকট প্রতিবছরই থাকছে। এই সংকট থাকছে বলে মানুষ মোটরসাইকেলে দূর গন্তব্যে যেতে চাইছে। ঈদযাত্রায় সংকটের আরেকটি কারণ হলো বাসের অতিরিক্ত ভাড়া। নিম্নআয়ের মানুষ উপায়ান্তর না দেখে খোলা ট্রাকে, ভ্যানে করে বাড়ি যান, যেগুলো প্রায় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে উঠছে। ইজিবাইক কেন মহাসড়কে উঠে আসছে- এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন! কিন্তু এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাতায়াতের জন্য কী নিরাপদ গণপরিবহন আছে?’
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ‘সড়ক থেকে দ্রুত ইজিবাইক তুলে নেওয়া যাবে না। ইজিবাইকের কাঠামোগত পরিবর্তন এনে সেগুলো স্বল্প দূরত্বের সড়কের জন্য যেন নিরাপদ পরিবহন হিসেবে ব্যবহার করা যায় তা চিন্তা করতে হবে। ইজিবাইক কোন সড়কে চলবে, কোন সড়কে চলবে না, সেটিও নির্ধারিত করে দিতে হবে। কোনোভাবেই যেন তা হাইওয়ে কানেক্টিং রোডে উঠে না যায় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। তেমনিভাবে কম সিসির মোটরসাইকেল যেন হাইওয়ে বা এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে না পারে সেজন্য নীতিমালা করতে হবে। মোটরসাইকেল চালকদের অভিজ্ঞতা ও বয়সসীমাও নির্ধারণ করা উচিত।’
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আরমানা সাবিহা হক বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য সরকার যেসব পলিসি নেয়, তা কতটা জোরালভাবে বাস্তবায়ন করা হয় এ নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয় তা আরও বিশ্লেষণ করতে হবে। সড়ক অবকাঠামো, যানবাহন সক্ষমতা সব মিলিয়ে কারা কোন পলিসি বাস্তবায়ন করবে এগুলো আরও সুস্পষ্ট করতে হবে।’
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘আঞ্চলিক সড়কের সঙ্গে মহাসড়কের যে কাঠামো তাতে গলদ আছে। আঞ্চলিক সড়ক হুট করে উঠিয়ে দেওয়া হয় মহাসড়কে। সেক্ষেত্রে গতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়ে উঠে না। অন্তত ৫০ মিটার আগে থেকে ঢাল বানিয়ে দিলে আঞ্চলিক সড়কের যানবাহনগুলো গতি কমিয়ে মহাসড়কে উঠতে পারবে।’