![চামড়া পাচারের আশঙ্কা](uploads/2024/06/21/camra-1718953316.jpg)
দেশের মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রিতে বৃহস্পতিবারও (২০ জুন) ভালো দাম পাননি চামড়া সংগ্রহকারীরা। অনেকে বিক্রেতা না পেয়ে চামড়া ফেলে দিয়েছেন। দেশের মধ্যে এমন যখন পরিস্থিতি তখন প্রতিবেশী দেশ ভারতের ট্যানারির মালিকরা ভালো দর দিয়ে চামড়া কিনতে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে অনেক আড়তদার ও চামড়া সংগ্রহকারীদের অগ্রিম দিয়েও দিয়েছেন। বিভিন্ন সূত্রে এসব জানা যায়।
দেশের ট্যানারির মালিকরা প্রতিবেশী দেশে চামড়া বিক্রি বন্ধ করতে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে বলেন, ডলারসংকটের কারণে চামড়ার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। তাই এর চেয়ে বেশি দামে কাঁচা চামড়া কেনা সম্ভব না।
সূত্র জানায়, ভারতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই গরু জবাই বন্ধ করে। এতে ভারতের ট্যানারিতে চামড়ার সংকট দেখা দেয়। ভারতের ট্যানারির মালিকরা পশুর চামড়া সংগ্রহ করতে ঈদুল আজহাকেই বেছে নেন। কারণ এ সময় একসঙ্গে অনেক পশুর চামড়া সংগ্রহ করার সুযোগ থাকে। অনেক ট্যানারির মালিক নিজে বা তার প্রতিনিধি পাঠিয়ে এ দেশ থেকে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করতে উদ্যোগ নিয়েছেন।
খুলনার বড় বাজার এলাকার এক আড়তদার খবরের কাগজকে বলেন, যেখানে ভালো দর পাব সেখানেই চামড়া বিক্রি করব। দেশের ট্যানারির মালিকরা সিন্ডিকেট করে দর কমিয়ে দিয়েছেন। সেই সময়ে প্রতিবেশী দেশের অনেক ট্যানারির মালিক আমাদের ভালো দর দিয়ে কাঁচা চামড়া কিনতে যোগাযোগ করছেন। আমার সঙ্গেও অনেকে যোগাযোগ করছেন। নগদ টাকা দিয়ে তারা নিজ দায়িত্বে কাঁচা চামড়া পরিবহন করে নিয়ে যাবেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মো. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, আমাদের দেশের ট্যানারির মালিকরা সিন্ডিকেট করে কাঁচা চামড়ার ভালো দর দিচ্ছেন না। এটা তো স্বাভাবিক যেখানে ভালো দর পাবেন সেখানেই চামড়া সংগ্রহকারীরা বিক্রি করবেন।
তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি দেশের ট্যানারির মালিকদের সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে পদক্ষেপ নেওয়া। একই সঙ্গে কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। এতে চামড়া রেখে দরদাম করে বিক্রির সুযোগ পাওয়া যাবে। ঈদুল আজহার আগে সরকার নজরদারির কথা বললেও আসলে কী নজরদারি হয়!
তবে সীমান্ত এলাকা দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় যেন চামড়া পাচার না হয় সে জন্য বিভিন্ন বন্দরে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খবরের কাগজকে বলেন, ঈদুল আজহার কয়েক দিন পরে এলাকার বাইরে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে গিয়ে বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়। এ সময় থেকেই পাচারের আশঙ্কা বাড়ে। চামড়া দেশের সম্পদ। কোনোভাবেই যেন মিথ্যা ঘোষণায় পাচার না করতে পারে সে বিষয়ে আমরা কঠোর নজরদারি করছি।
চলতি বছর গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণের সময় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, দাম নির্ধারণে ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২০ বর্গফুট হয় বলে হিসাব করে মূল্য ঠিক করা হয়েছে। ঢাকায় এক লাখ টাকা দামের একটি গরুর চামড়া যদি ২০ বর্গফুট হয়, তখন ওই গরুর চামড়ার দাম হবে ১১০০-১২০০ টাকা।
কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। পোস্তায় এক লাখ টাকা গরুর কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। যদিও ব্যাপারীরা কাঁচা চামড়া বলে অজুহাত দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু একটি চামড়ায় ১০০ টাকার লবণ লাগে। শুধু এক লাখ টাকা নয়, দেড় লাখ টাকা গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫৫০ টাকায়। যা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে চার থেকে পাঁচগুণ কম।
চামড়া নিয়ে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পুলিশ, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থা। সারা দিন সরকারের বেঁধে দেওয়ার দামের চেয়ে পাঁচগুণ কমে দামে চামড়া বেচাকেনা হলেও এসব সংস্থার কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
জানা গেছে, কোরবানির চামড়া সংরক্ষণ ও তদারকিতে পাঁচটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে সার্বিক ব্যবস্থাপনা তদারকি করতে থাকে কেন্দ্রীয় কমিটি। এ ছাড়া বিভাগীয় কমিটি, নিয়ন্ত্রণ কক্ষ পরিচালনা কমিটি, সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য কমিটি ও জেলা কমিটি করা রয়েছে।
এসব কমিটি মূলত কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহনসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা তদারকির করে। সচিবের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি কাজ করে। এ ছাড়াও একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে আট সদস্যের বিভাগীয় কমিটি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন উপ-সচিবের নেতৃত্বে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল সেল, ২৯ জন সদস্য নিয়ে জেলা কমিটি থাকলেও বাজার মনিটরিংয়ে তাদের কোনো কার্যক্রম দেখেননি ব্যবসায়ীরা।
লালবাগের পোস্তায় আড়তদার মোখলেস উদ্দিন এসব কমিটির বিষয়ে জানেন না দাবি করে খবরের কাগজকে বলেন, সারা দিন কোনো সরকারি লোক এসে একবার জিজ্ঞেস করল না আমরা কেন কম দামে চামড়া কিনছি। তবে পুলিশ সদস্যরা এই এলাকায় যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সারা দিন কাজ করেছেন।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি আফতাব উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, লবণ ও মৌসুমি শ্রমিকদের মজুরি বাড়ার কারণে এবার সরকারের নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা সম্ভব হয়নি।
বিএইচএসএমএর মহাসচিব টিপু সুলতান খবরের কাগজকে বলেন, চামড়ার দাম সরকার নির্ধারণ করলেও বাজারের বাস্তবতা আসলে অন্য। সরকার লবণসহ চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে। মৌসুমি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা কাঁচা চামড়া কিনেছেন। ওই দামের সঙ্গে মেলালে হবে না। কারণ একটা কাঁচা চামড়ায় আরও ২০০ থেকে ২৫০ টাকার লবণ মেশাতে হয়।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেকেই কোরবানি দিয়েছিলেন। তবে কাঁচা চামড়া বিক্রির লোক খুঁজে পাচ্ছিলেন না। যারা বিক্রি করতে পেরেছেন তারাও নামমাত্র দাম পেয়েছেন। আবার অনেকে কাঙ্ক্ষিত দাম ও ক্রেতা না পেয়ে মাদ্রাসা ও এতিমখানার লোকজনকে বিনা পয়সায় দিয়ে দিয়েছেন।
রাজধানীর লালবাগের শহীদনগর এলাকার বাসিন্দা হাজি শাহজাহান খবরের কাগজকে বলেন, ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকার গরুর চামড়া বিক্রি করেছি মাত্র ৫৫০ টাকায়। গত কয়েক বছর ধরে কম দামেই চামড়া বিক্রি করছি। আগামীতে কোরবানির চামড়া মাদ্রাসায় দান করে দেবেন বলে জানান।
কামরাঙ্গীরচরে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার গরু কোরবানি দিয়েছেন মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, সরকার যে মূল্য নির্ধারণ করেছে যদি এই দামে চামড়া বিক্রি করা যেত, তা হলে আমার কোরবানির গরুর চামড়ার দাম কম হলেও ১১০০ থেকে ১৩০০ টাকা হতো। কিন্তু দাম বলেছে মাত্র ৪০০-৪৫০ টাকা। তাই বিক্রি না করে এলাকার এতিমখানায় দিয়ে দিয়েছি।
এদিকে দেশের আড়তদাররা বলছেন, গত এক দশকের বেশি সময় ধরে সরকার চামড়ার দাম বেঁধে দিলেও এ দামে চামড়া কেনেন না তারা। এবারও এক লাখ টাকার গরুর কাঁচা চামড়া এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ৬০০-৭০০ টাকা বিক্রি হয়েছে বলে তারা জানান। তারা বলছেন এক যুগ আগে যে চামড়ার দাম ২০০০ বা ২২০০ টাকা ছিল সেটি এখন ৭০০ টাকা। এর মূল কারণ একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে চামড়ার বাজারের নিয়ন্ত্রণ। ফলে তারা যে দামে ঠিক করে দিচ্ছে এর বাইরে চামড়া কেনার সুযোগ নেই কারও।
মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী ফজলুল হক খবরের কাগজকে বলেন, তিনি মোট ২৫০টি কাঁচা চামড়া কিনে বিক্রি করেছেন। বলতে গেলে তিনি চামড়ার দাম পাননি। আড়ত থেকে তাদের সংকেত দেওয়া হয়েছে গরুর দাম যতই হোক ৮০০ টাকার বেশি দামে যেন চামড়া না কিনি। পোস্তা আড়তদার মৌসুমি ব্যবসায়ীদের জানিয়েছেন ৭০০-৮০০ টাকার বেশি দামে চামড়া কিনবেন না। তাই আমরা গড়ে একটা চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় কিনেছি। প্রতি চামড়ায় এক দেড় শ টাকা খরচ আছে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিশনের সভপাতি শাহিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, সীমান্ত এলাকা দিয়ে চামড়া পাচারের আশঙ্কা করছি। খবর পাচ্ছি প্রতিবেশী দেশের ট্যানারির মালিকরা এ দেশ থেকে চামড়া কিনতে উঠে পড়ে লেগেছেন। সরকারের কাছে নজরদারি বাড়ানোর দাবি করছি।