মানুষের উপদ্রবে নিরাপদ প্রজনন ঘটাতে না পারায় ও প্রাণে বেঁচে থাকার তাগিদে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে বিষাক্ত সাপ চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার। একেক বারে ২০ থেকে ৮০টি পর্যন্ত বাচ্চা প্রসবে সক্ষম এই সাপের এখন চলছে প্রজনন মৌসুম। সাধারণত প্রতিবছর মে-জুলাই পর্যন্ত চন্দ্রবোড়ার মূল প্রজনন সময়। মাত্র ৫ বছর আগেও দেশের লাল তালিকাভুক্ত বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি হিসেবে এই সাপের অস্তিত্ব ছিল শুধু রাজশাহী অঞ্চলে। গত ৯ বছরে দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই দেখা মিলছে এই সাপের। এমনকি কয়েক দিন পর পরই এই সাপের দংশনে ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা।
সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা বিষয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী কমিটির কো-চেয়ার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ খবরের কাগজকে বলেন, কোনো সাপই মানুষকে খামোখা দংশন করে না। সাপ যখন নিজেদের অনিরাপদ মনে করে কিংবা বিরক্ত হয় তখনই দংশন করে। আর রাসেলস ভাইপার আরও বেশি ধৈর্যশীল। এ ছাড়া অনেকে এই সাপ নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই সাপের কামড়ে মৃত্যুর হার ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ বেশির ভাগ মানুষই দ্রুত সময়ের মধ্যে চিকিৎসা নিলে বেঁচে যায়।
তিনি বলেন, মানুষের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে তারা সাপকে বিরক্ত না করে। আর সচেতন থাকতে হবে কেউ দংশিত হলে যাতে দ্রুত নিকটতম স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চলে যান। অবৈধ কোনো পন্থায় যাতে কেউ ঝাড়ফুঁকে না যান। দেরি করলে বিপদ বাড়বে। কারণ এই সাপের কামড়ে খুব দ্রুত একই সঙ্গে মানুষের শরীরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিকল হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বিষাক্ত হলেও শান্ত স্বভাবের এই সাপ খুবই ধৈর্যশীল। আঘাত বা অত্যধিক উত্ত্যক্ত না করলে সাধারণত কাউকে দংশন করে না। এমনকি পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেও এই সাপ ঘাপটি মেরে চুপচাপ নিজেকে যতটা সম্ভব আড়াল করে রাখতে চায়। তবে নিজে আঘাতপ্রাপ্ত হলে তখন অন্য যেকোনো সাপের চেয়ে দ্রুতগতিতে নিজের শরীরকে লম্বা করে দংশন করে।
সাপ নিয়ে কাজ করা সূত্রগুলো জানায়, নির্বিঘ্নে প্রজনন করতে না পারলে এরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিতে যায়। আবার যেহেতু অনেক বাচ্চা দেয়। তাই সেখান থেকে অন্য কোথাও গেলে সব বাচ্চা সঙ্গে যেতে পারে না। প্রসবস্থানের এলাকায় থেকে নিজেরাও বংশ বিস্তার করে। এভাবেই অঞ্চল থেকে অঞ্চলে বিস্তার ঘটছে এই চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার নামের সাপটির। কয়েক বছর আগে নতুন প্রজন্মের কয়েকজন গবেষক রাজশাহী অঞ্চলে এই সাপ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বাংলা নামের পরিবর্তে ইংরেজি নাম বেশি আলোচনা ও প্রচার করায় ইংরেজি নামেই বেশি পরিচিতি পেয়ে যায়। এমনকি অনেকের উপস্থাপনায় প্রায় সাপটিকে নতুন বলা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ আহসান খবরের কাগজকে জানান, রাসেলস ভাইপার নতুন কোনো সাপ নয়। এটি আমাদের অঞ্চলে খুবই পুরোনো একটি সাপ, যা আগে পরিচিত ছিল চন্দ্রবোড়া নামে। এটি একসময় ব্যাপকভাবেই ছিল। মাঝখানে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। ২০০২ সালেও এটি জাদুঘরে রাখা হয়েছিল। ২০১৩ সালে অনেকটা হঠাৎ করেই রাজশাহী অঞ্চলে এই সাপের কামড়ে একজন মারা যান। পরের ৩ বছরে মারা যান আরও ২০ জন। তখন থেকেই এটি রাসেলস ভাইপার নামে বেশি পরিচিত পায় এবং ভীতি ছড়ায়। এখন দেশের প্রায় অর্ধেক জেলায় সন্ধান মিলছে এই রাসেলস ভাইপারের।
ইতিহাসঘেঁটে দেখা যায়, ‘১৭৯৬ সালে প্রাণিবিশারদ প্যাট্রিক রাসেল তার অ্যান অ্যাকাউন্ট অব ইন্ডিয়ান সারপেন্টস, কালেক্টেড অন দ্য কোস্ট অব করোমান্ডেল বইয়ে মূল ভাইপার প্রজাতির চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামের সাপকে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম বিষধর সাপ এবং ভারতের ভয়ংকর চারটি সাপের একটি হিসেবে উল্লেখ করেন। এরপর অন্য বিশারদ জর্জ শ এবং ফ্রেডেরিক পলিডোর নোডার এই সাপের নামকরণ করেন রাসেলস ভাইপার নামে।’
বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, চন্দ্রবোড়া কোনো নতুন সাপ নয়। এটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির একটি সাপ। সর্বশেষ ২০১৫ সালেও এটিকে লাল তালিকাভুক্ত বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির সাপের মধ্যে রাখা হয় এবং এখনো সেই লাল তালিকায়ই আছে।
তিনি বলেন, ‘এই সাপ নিজেদের আত্মরক্ষার জন্যই দংশন করে। আমরা এই সাপের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার জন্য এবং তাদের নিরাপদ উপায়ে সংরক্ষণে প্রচারসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি, যা শিগগিরই শুরু হবে।’
অধ্যাপক ড. ফরিদ আহসান বলেন, ‘চন্দ্রবোড়া সাপ প্রধানত শুকনো জায়গার সাপ হলেও পানিতেও এটি দ্রুত চলতে সক্ষম। বিপদ টের পেলে অনেক জোরে জোরে সোঁ সোঁ শব্দ করে।’
তিনি বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে আগে প্রধানত একফসলি চাষাবাদ ছিল। এখন সেখানে সেচব্যবস্থার সুবাদে তিন ফসলের চাষাবাদও হয়। চাষাবাদের এলাকা বেড়ে গেছে। মানুষের বিচরণ বেড়েছে। ফসলি জমি কমে যাচ্ছে। ফলে ফসলি জমি বা অল্প বন-জঙ্গলে বসবাসপ্রিয় এই সাপটি নিজেদের অস্তিত্ব টেকাতে নতুন নতুন জায়গা খুঁজছে। তারা লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। আবার কচুরিপনার সঙ্গে ভেসে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাচ্ছে। প্রতি প্রজননে বেশি বাচ্চা জন্ম নেওয়ায় সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে এবং বংশবিস্তার ঘটছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ডা. নুসায়ের চৌধুরী (অসংক্রামক ব্যাধি) খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গা থেকে সাপের কামড়ের খবর পাই। কিন্তু কোন রোগীকে কোন সাপে কাটছে সেটা আমরা আলাদা করে হিসাব পাই না। আমরা সারা দেশেই অ্যান্টিভেনম সরবরাহ করে রেখেছি। যদি কোথাও না থাকে স্থানীয় কর্মকর্তারা আমাদের জানালে আবার তা পাঠাব।’
তিনি জানান, ‘আমাদের সর্বশেষ জরিপ মতে দেশে বছরে ৭ লাখ মানুষ সাপের দংশনের শিকার হন। এর মধ্যে মারা যান ৭ হাজার ২০০ জন। সাপে কাটা রোগীর জরুরি চিকিৎসায় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আমরা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।’