![বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠন হচ্ছে](uploads/2024/06/21/Bangladesh_Bank1-1718960288.jpg)
ক্রমাগত পতন হওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও পুনর্গঠন হতে চলেছে। ঈদুল আজহার আগে চলতি জুন মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে রেমিট্যান্স প্রবাহে গতি সঞ্চার হওয়া এবং আগামী সপ্তাহে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির তৃতীয় কিস্তি ছাড়করণে সবুজ সংকেত থাকায় এ আশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে মার্কিন ডলারের সরবরাহ ও বিনিময় হারের স্থিতাবস্থা ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আইএমএফ ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও এশিয়ান অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক থেকেও অর্থ ছাড় হবে। কিছু ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে। আমরা আশাবাদী। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠন হবে।’
গতকাল বৃহস্পতিবার (২০ জুন) প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে রেমিট্যান্স এসেছে ১ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন বা ১৬৪ কোটি ৬৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এর আগে কোনো একক মাসের প্রথম ভাগে এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি। ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রবাসীরা পরিবারের কাছে বেশি করে অর্থ পাঠানোয় রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি বেড়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। বৈদেশিক মুদ্রার আন্তপ্রবাহ বাড়ানোর মাধ্যমে বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে গত মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতির সূচনা করে। অর্থনীতিবিদরা ক্রলিং পেগ সূচনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। বলেছেন, দেরিতে হলেও এটি ভালো উদ্যোগ। এ পদ্ধতিতে বিনিময় হার চাহিদা-জোগানের ভিত্তিতে বাজারমুখী করা হয়। ক্রলিং পেগ পদ্ধতি সূচনার সময় হঠাৎ করেই ডলারের দর ৭ টাকা বৃদ্ধি করে প্রতি ডলার ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, গতকাল ২০ জুন ব্যাংকগুলোতে ডলার কেনাবেচা হয়েছে ১১৮ টাকা দরে। রেমিট্যান্সের বিপরীতে প্রবাসীদের এ দরের সঙ্গে আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনাও দেওয়া হয়। ফলে প্রবাসীরা দেশে পাঠানো অর্থের বিপরীতে বেশি টাকা পাচ্ছেন। অপরদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকগুলোতে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে এবং বিনিময় হারে বিগত মাসগুলোতে চলা অস্থিরতা হ্রাস পেয়েছে।
এদিকে আগামী সোমবার আইএমএফ পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভায় বাংলাদেশ ইস্যুতে চলমান ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের তৃতীয় কিস্তি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। নিয়মানুযায়ী সভায় গত মে মাসে বাংলাদেশে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সফর ও পর্যালোচনা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৃতীয় কিস্তির অনুমোদন হবে।
গত ২৬ মে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে এ বিষয়ে ঢাকায় আলোচনা করে গেছেন আইএমএফের নির্বাহী পরিচালক কৃষ্ণমূর্তি ভি সুব্রামানিয়ান। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী বলেন, কৃষ্ণমূর্তি ভি সুব্রামানিয়ান বলে গেছেন, বাংলাদেশ ঠিক পথেই আছে। জুনের মধ্যেই তৃতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়া যাবে।
আইএমএফের এই তৃতীয় কিস্তি পেলে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ ২০ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৬৭ কোটি ৭৯ লাখ ৯০ হাজার ডলার হবে। আর গ্রস বা মোট রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৫৯৩ কোটি ৩২ লাখ ৩০ হাজার ডলার হবে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও এআইআইবি থেকেও ঋণের অর্থ ছাড় হবে জুলাইয়ে। সব মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠনের সুযোগ ফিরে এসেছে।
ড. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘একটু সময় লাগবে। আমরা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে পাব।’
এদিকে আইএমএফ চলমান ঋণ কমসূচির আওতায় যেসব শর্ত দেয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ সংরক্ষণ করা। সে হিসাবে ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের দেওয়া নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ১১ কোটি মার্কিন ডলার। সঙ্গে আর্থিক খাতে সংস্কারের কথাও ছিল। আইএমএফ প্রতিনিধিদল মে মাসের পরিদর্শন শেষে রিজার্ভ সঞ্চিতির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১ হাজার ৪৭৫ কোটি ডলার করে দেয়। গতকাল পর্যন্ত আইএমএফের দেওয়া ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ম্যানুয়াল (বিপিএম) ৬ অনুযায়ী নিট রিজার্ভ রয়েছে ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।
গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিরতা চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথভাবে বেঁধে দেওয়া দর মানা হয়নি। প্রতি ডলারের বিনিময় দর ওঠে আমদানি পর্যায়ে ১২২-১২৪ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ১২৭ টাকা পর্যন্ত। ডলার সরবরাহ সংকুচিত হয়ে দুর্লভ হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি ব্যয়ে লাগাম টেনে ধরেও ঠেকাতে পারেনি ডলারসংকট। দেশে ডলারের বিনিময় হার কম হওয়ায় হুন্ডিতে অর্থ পাচার বাড়ে। এতে বিদেশে প্রবাসীদের উপার্জিত অর্থ বিদেশেই থেকে যায়। এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে ডলারের দর বাজারমুখী করতে অর্থনীতিবিদরা পরামর্শ দিলেও সে উদ্যোগ আসে বেশ দেরিতে।
আইএমএফ তাদের সুপারিশে বলেছে, রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে জ্বালানিতে দেওয়া সরকারের ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে এফডিআই বা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ানো, ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের উন্নয়ন ও আর্থিক সুশাসনে নজর দিতে হবে। কর সংগ্রহ অগ্রাধিকার দেওয়া এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল প্রণয়নের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। এক কথায়, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশকে বাণিজ্য বহুমুখীকরণে যেতে হবে। এতে রপ্তানি আয় বাড়বে। একটি স্থিতিশীল রিজার্ভ গঠনে এসব উদ্যোগ জরুরি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ অঙ্কে, অর্থাৎ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায় ২০২১ সালের আগস্টে। ওই হিসাবে গত তিন বছরে রিজার্ভ ক্ষয় হয়েছে প্রায় অর্ধেক। ওই বছর দেশের আমদানি ব্যয়ে রেকর্ড উল্লম্ফন হয়। তথ্য অনুযায়ী ওই সময় এক বছরে ৫২ বিলিয়ন রপ্তানি আয়ের বিপরীতে আমদানি ব্যয় ছিল প্রায় ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর পর থেকেই ডলারসংকট সৃষ্টি হয়। ধারণা করা হয়, ওই বছর বাণিজ্যের আড়ালে বিপুল পরিমাণ মুদ্রা দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে।