জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য ড. মতিউর রহমানের গ্রামের বাড়ি বরিশালের মুলাদী উপজেলার কাজীর চর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের আলহাজ আব্দুল হাকিম হাওলাদারের ছেলে।
এলাকার বেশির ভাগ মানুষের কাছে তিনি পিন্টু নামে পরিচিত। স্কুলজীবন থেকেই মতিউর রহমান মুলাদীর পার্শ্ববর্তী উপজেলা বাবুগঞ্জের খালার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন। বাবুগঞ্জ থেকেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স করার পর এমবিএ করেন। গ্রামের বাড়িতে খুব একটা যাতায়াত না থাকলেও ওই এলাকায় দানবীর হিসেবে পরিচিত মতিউর রহমান।
তার মেজো ভাই আরেক ধনকুবের কাইয়ুম হাওলাদারের সঙ্গে এলাকার মানুষের সখ্য বেশি। মূলত তিনিই মতিউর রহমানের পক্ষে এলাকায় দান সদকাহ করেন। ৩ ভাই আর ২ বোনের মধ্যে মতিউর রহমান সবার বড়। ছোট নুরুল হুদাও থাকেন বাড়িতে। দেখাশোনা করেন অন্য দুই ভাইয়ের সহায় সম্পদ।
গ্রামের বাড়িতে খুব একটা যাতায়াত না থাকলেও পৈতৃক ভিটায় নির্মাণ করেছেন দৃষ্টিনন্দন আলিশান বাড়ি। দ্বিতল ভবনের ওই বাড়িটি বছরের অধিকাংশ সময় থাকে তালাবদ্ধ। পৈতৃক বাড়ির পাশে রয়েছে বিশালাকৃতির একটি মাছের ঘের। বাড়ির সামনে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি মসজিদ, কওমি মাদ্রাসা এবং বাহাদুরপুর রহমানিয়া টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ৫/৬ বছর ধরে তিনি তার গ্রামের বাড়ি মুলাদীর কাজীর চার ইউনিয়নের কৃষ্ণবধু, বাহদুপুর, চরকমল এবং ডিগ্রির চর গ্রামের বিভিন্ন ফসলি জমি কিনেছেন।
স্থায়ী বাসিন্দা আবদুল সালেক ব্যাপারী বলেন, গত ৫/৬ বছরে মতিউর রহমান ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু জমি কিনেছেন। কি পরিমাণ জমি কিনেছেন তা সঠিক করে বলতে পারব না। তা শত বিঘার বেশি হবে বলে অনুমান করা যায়। তার কেনা জমিগুলো সব পিলার দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করা আছে।
সালেক ব্যাপারী জানান, কারও কাছ থেকে জোর করে কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে কারও জমি কিনেছেন বলে জানা নেই। জমি কেনা নিয়ে কারও সঙ্গে তার কোন ঝামেলা হয়েছে বলে শুনিনি। বর্তমানে মতিউর পরিবারের দখলে আছে বাড়ির দুই একরের বেশি সম্পত্তি।
তারা জানান, মতিউর রহমান বাড়ির পেছনে জোয়ার-ভাটায় প্রবহমান খালটির দুইদিকে বাঁধ দিয়ে আটকে লেক বানিয়ে পৈতৃক ভিটার সৌন্দর্য বাড়িয়েছেন। প্রভাব ও ক্ষমতার দাপটের কারণে কেউই তখন বাধা দেওয়ার সাহস পাননি। শুকনো মৌসুমে ফসলি জমিতে সেচ দিতে দুর্ভোগে পড়েন কৃষকরা। অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে সেচের ব্যবস্থা করতে হয় কয়েকশ একর জমিতে।
বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দারা জানান, মতিউরের ক্ষমতার দাপটে বিত্তশালী হয়েছেন তার ভাই কাইয়ুম হাওলাদার। তারও ঢাকা ও গাজীপুরে পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে। বড় ভাই মতিউরের সহযোগিতায় তিনি এসব প্রতিষ্ঠান গড়েছেন।
গ্রামের বাড়িতে বড় ভাই মতিউর রহমানে চেয়ে মেজ ভাই কাইয়ুমের সম্পদের পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি। গ্রামের বাড়িতে তিনি একরের পর একর জমি কিনেছেন। মুলাদী পৌর শহরে থানার উত্তর পাশে তার একটি আলিশান বাড়ি রয়েছে। বছর দুয়েক আগে প্রায় ২ কোটি টাকায় তা কিনেন কাইয়ুম।
মতিউরের প্রথম স্ত্রী গড়েছেন সম্পদের পাহাড়
মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী নরসিংদীতে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তার নামে-বেনামে রয়েছে অঢেল সম্পদ। স্বামীর বদৌলতে সরকারি কলেজের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হয়ে এত সম্পদ গড়েছেন। তিনি রায়পুরা উপজেলা পরিষদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তার তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও ফারজানা রহমান ইপসিতা নামে দুই সন্তান রয়েছে।
লায়লা কানিজ লাকী ছিলেন রাজধানীর তিতুমীর সরকারি কলেজের বাংলা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক। শিক্ষকতার পাশাপাশি রায়পুরা উপজেলার মরজালে নিজ এলাকায় প্রায় দেড় একর জমিতে ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট নামের একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন।
২০১৮ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী রাজীউদ্দিন আহমেদ রাজুর সঙ্গে পরিচয় হয়। ২০২৩ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান সাদেকুর রহমান মারা গেলে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে উপনির্বাচনে প্রার্থী হন এবং সংসদ সদস্যের প্রভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন লায়লা কানিজ লাকী। তবে ঈদের পর তিনি তার কর্মস্থলে যাননি। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির দুর্যোগ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক।
তার নির্বাচনি হলফনামা উল্লেখ আছে, বাৎসরিক আয় বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার, কৃষি খাত থেকে ১৮ লাখ টাকা, শেয়ার-সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা, উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মানী বাবদ ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫ টাকা, ব্যাংক সুদ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা রয়েছে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। তার কৃষিজমির পরিমাণ ১৫৪ শতাংশ, তার অকৃষি জমির মধ্যে রয়েছে রাজউকে পাঁচ কাঠা, সাভারে সাড়ে ৮ কাঠা, গাজীপুরে ৫ কাঠা, গাজীপুরের পুবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, গাজীপুরের খিলগাঁওয়ে ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, শিবপুরের যোশরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ ও নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ জমি।
রায়পুরা উপজেলায় মরজাল বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ও লায়লা কানিজ লাকী দম্পতির বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি।
এ ছাড়া তাদের রয়েছে, ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট। দেড় একরের বেশি আয়তনজুড়ে পার্কটির ভেতরে রয়েছে বিলাসবহুল একাধিক কটেজ। নির্ধারিত টাকায় এ কটেজে রাত্রিযাপন করা যায় বলেও জানান পার্কের গেটে থাকা আবু সাঈদ নামে একজন। পার্কে রয়েছে বিভিন্ন বয়সীদের জন্য বেশকিছু রাইড। পুরো পার্কজুড়ে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও স্থাপনা এবং বিশাল আয়তনের একটি লেক।
স্থানীয়রা বলছেন, লায়লা কানিজের বাবা কফিল উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে লায়লা কানিজ সবার বড়। সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করলেও মতিউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের পর তার ভাগ্য খুলে যায়। গত ১৫ বছরে তার সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।
লাকীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অনেকের জমি জোর করে দখল করার। এদের মধ্যে একজন বিমানবাহিনীর সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার মো. নজরুল ইসলাম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তার কাছ থেকে জমি কেনার কথা বলে কিছু টাকা দিয়ে জমি দখলে নেন। বাকি টাকা দেওয়ার পর রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হবে বলে কথা থাকলেও তিনি আর কোনো টাকা দেননি।
এ ব্যাপারে মরজাল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সানজিদা সুলতানা নাসিমা সাংবাদিকদের বলেন, উনি সরকারি চাকরি করেছেন, উনি সম্মানিত একজন টিচার, এমন অবস্থায় এত সম্পদের মালিক নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠবে এটাই স্বাভাবিক।
রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসাইন বলেন, লায়লা কানিজ টাকার পাহাড় গড়েছেন। রায়পুরার এমপি রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু প্রভাব খাটিয়ে তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান বানিয়েছেন, এখন টাকার কাছে সব নীরব।
তবে রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়া একটি চক্রের সদস্যরা বিভিন্নভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করছেন বলে দাবি করেন লায়লা কানিজ লাকী।
ফেনীতে শাশুড়িকে ডুপ্লেক্স বাড়ি উপহার দেওয়ার তথ্য অস্বীকার
মতিউর রহমান ১০ বছর আগে ফেনীর সোনাগাজীতে ডুপ্লেক্স বাড়ি বানিয়ে তার দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতারের মা অর্থাৎ শাশুড়িকে উপহার দিয়েছেন বলে গত কয়েকদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে শাম্মী আখতারের দুই ভাই ও একাধিক আত্মীয় এ খবরের সত্যতা অস্বীকার করেছেন।
শাম্মীর চাচাতো ভাই দিদারুল হাসান জানান, আমরা বংশপরম্পরায় সম্ভ্রান্ত ও জমিদার পরিবার। আমাদের অন্তত পাঁচটি ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে। আমার মিল্লাত চাচা (শাম্মী আখতারের বাবা) ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের জায়গা জমিসহ অঢেল সম্পদ রয়েছে। মেয়ের জামাইয়ের কাছ থেকে ডুপ্লেক্স বাড়ি নিতে হবে এরকম কিছু না। এটা ডাহা মিথ্যা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট তথ্য। যে কেউ অসৎ উদ্দেশ্যে এসব বানোয়াট তথ্য প্রচার করছে।
পশ্চিম সোনাপুর সমাজ উন্নয়ন পরিষদের সহ-সভাপতি আমিনুল হক হারুন জানান, মতিউর রহমান আমাদের মেয়ের জামাই। তিনি একবার এলাকায় এসেছেন বলে শুনেছি। তবে তার সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি। মিয়া বাড়ির লোকদেরকে অন্য কেউ এসে ঘর করে দেওয়ার দরকার নাই। আর তাদের বিশাল জমি-জমা সম্পত্তিও রয়েছে। এখানে অন্য কেউ এসে জমি কিনে দেওয়ার তথ্য অবান্তর।
মতিউর রহমানের শ্বশুরবাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর এলাকায়। তবে স্থানীয়রা বাড়িটিকে মিয়া বাড়ি হিসেবে চিনেন।