পবিত্র ঈদুল আজহা সোমবার (১৭ জুন)। শনিবার (১৫ জুন) রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে দেখা গেছে, ক্রেতা-বিক্রেতা-দর্শনার্থীদের ঠাসা ভিড়। আগের দুই দিনের চেয়ে কোরবানির পশুর দাম কিছুটা কম দেখা গেছে। তবে অনেক বিক্রেতা এখন শেষ সময়ের জন্য অপেক্ষা করছেন।
কুষ্টিয়া থেকে তিনটি গরু নিয়ে ঢাকায় এসেছেন খলিল। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘হাটে ক্রেতাদের প্রচুর ভিড়। একটি গরু বিক্রি করেছি। বাকি দুটি গরুর দরদাম চলছে। আশা করছি, আজকালের মধ্যে বিক্রি হয়ে যাবে। হাটে ক্রেতাদের জটলা দেখে ভালো লাগছে। অনেক আশা নিয়ে ঢাকায় এসেছি। উপযুক্ত দামে গরু বিক্রি করে বাড়ি ফিরতে চাই।’
রাজধানীর মিরপুর-১৪ থেকে গাবতলীর হাটে কোরবানির গরু কিনতে এসেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা আরিফুর রহমান। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, হাটে প্রচণ্ড ভিড় ও ভ্যাপসা গরমে শ্বাস নেওয়া কঠিন। এর আগেও এই হাটে এসেছি। তখন দাম বেশি থাকলেও ভিড় ছিল কম। গত দুই দিনের চেয়ে এখন গরুর দাম কিছুটা কমেছে।
রাজধানীর গাবতলীসহ ৯টি পশুর হাট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ৩ দিনে এই হাটগুলোতে ১০০ কোটি টাকার পশু বিক্রি হয়েছে। সরেজমিনে গতকাল রাজধানীর গাবতলীসহ উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেটের পশুর বাজার, পোস্তগোলা শ্মশানঘাট, কমলাপুর স্টেডিয়াম, দনিয়া কলেজসংলগ্ন এলাকা, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর কদমতলী ও ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনালসংলগ্ন পশুর হাট ঘুরে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ঢাকার ভেতরে পশুর হাটে যারা (স্বেচ্ছাসেবীসহ হাট ইজারাদার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) কাজ করবেন, তাদের মধ্যে সমন্বয় রয়েছে। পশুর হাটে অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির ব্যাপারে ডিবির টিম সজাগ আছে। হাট ও হাটের আশপাশে এমন অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির কাউকে দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি জাল টাকার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘জাল টাকা শনাক্তকরণ মেশিন পশুর হাটগুলোতে রয়েছে। এসব বিষয়ে আমাদের গোয়েন্দারা সতর্ক। যারা গরু কেনাবেচা করছেন, তাদের নিরাপত্তার জন্য গোয়েন্দা পুলিশ রয়েছে। পাশাপাশি যারা ঢাকার বাইরে থেকে ট্রাকে গরু আনছেন, তাদেরও পুলিশ নিরাপত্তা দিচ্ছে। পশুর হাটগুলোতে ইজারাদাররা নির্ধারিত পরিমাণের বাইরে অতিরিক্ত হাসিল আদায় করলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। হাটগুলোতে ২৪ ঘণ্টাই পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।’
প্রতিবারের মতো এবারও রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে দালাল ও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। এক হাটের পশু অন্য হাটে নেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে হাটের ইজারা যারা নিয়েছেন তাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে।
গরু কিনে আদাবরের বাসায় ফিরছিলেন রাজু। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, গরু কিনে পিকআপে নিয়ে বাসায় ফিরছেন। ফিরতি পথে হাট থেকে গাড়ি সামান্য এগোতেই বেশ কয়েকজন ঘিরে ধরে ও ড্রাইভারের কাছ থেকে জোর করে ২০০ টাকা আদায় করে। তিনি জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায়, এটি হাটের ফি। কারা এই ফি নিচ্ছে জানতে চাইলে বলা হয়, ডিপজলের লোকেরা। এ বিষয়ে কথা হয় ডিপজলের কর্মী শাহবুদ্দিনের সঙ্গে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, কারা চাঁদা নিচ্ছেন তিনি জানেন না।
ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, হাটে সংখ্যা বাড়ছে কোরবানির পশুর। পশুদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাটে নিয়োজিত রয়েছে ৩৬ সদস্যের একটি মেডিকেল টিম। হাটে পশু ও মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ডা. শেখ মাসুদুর রহমান খবরের কাগজকে জানান, হাটে পশু এলেই তারা ফিটনেস পরীক্ষা করে ট্যাগ লাগিয়ে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। এ পর্যন্ত দুই হাজার পশুকে তারা স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছেন।
তিনি জানান, অতিরিক্ত গরমে অনেক সময় গরুর হিট স্ট্রোক হয়। সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিক পরীক্ষার পর কোনো পশুর শারীরিক সমস্যা থাকলে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসাও দেওয়া হচ্ছে।
আরও ৮ পশুর হাট সরেজমিন
ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে সারা দেশের মতো রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী পশুর হাটগুলো জমে উঠেছে। প্রতিবারের মতো এবারও ঈদ ঘিরে পশু বেচাকেনা চলবে চাঁদরাত পর্যন্ত। এসব বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার বিষয়ে সতর্ক রয়েছে পুলিশ-র্যাব। গরু ব্যবসায়ী ও হাট কর্তৃপক্ষ বলছেন, গতকাল থেকে জমজমাট বেচাকেনা শুরু হয়েছে।
এবারের হাটে বিদেশি গরু বেশ ভালোই দেখা গেছে। ভারত, নেপাল, মায়ানমারের গরুর পাশাপাশি রয়েছে মহিষ, ষাঁড়, ভুট্টি, উট ও দুম্বা। এ ছাড়া হাটের ভেতর গরু বাঁধার জন্য বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে শেড তৈরি করা হয়েছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কথা মাথায় রেখে বাড়তি বালু রাখা হয়েছে হাটের ভেতর, যেন বৃষ্টি হলেও নির্বিঘ্নে ক্রেতা-বিক্রেতারা নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারেন।
হাট ঘুরে দেখা যায়, ইতোমধ্যে হাটে খামারি ও ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন আকারের গরু তুলেছেন। তবে বরাবরের মতোই এবারও ছোটো ও মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি। এ বছর নগরীর দুই সিটিতে বসেছে পশুর ২০টি অস্থায়ী হাট। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ৯টি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) বসেছে ১১টি অস্থায়ী পশুর হাট।
পশুর হাটগুলো ঘুরে দেখা যায়, কোরবানির পশু যারা কিনতে আসছেন, তাদের বেশির ভাগই মাঝারি সাইজের গরু কেনার চেষ্টা করছেন। ৭০ বা ৮০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে বা তার একটু বেশি বাজেট। অনেক ক্রেতা হাট ঘুরে ঘুরে কোরবানির পশু দেখার পাশাপাশি দাম যাচাই করতে দেখা গেছে।
কমলাপুর স্টেডিয়াম পশুর হাটে কথা হয় বিক্রেতা দেলোয়ারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দাম চাচ্ছি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু ক্রেতারা বলছেন ১ লাখ ১০ এবং ২০ হাজারের মতো।’ দনিয়া হাটের এক বিক্রেতা নয়ন মিয়া বলেন, ‘৮টি গরু নিয়ে ৪ দিন আগে হাটে এসেছি। এখনো একটিও বিক্রি হয়নি। সবাই দাম শুনে চলে যান। মনে হয়, আজকালের মধ্যে দাম কমাতে হবে এবং বিক্রি করতে হবে।’
যশোর থেকে রাজধানীর পোস্তগোলা শ্মশান ঘাট হাটে গরু নিয়ে আসা বিক্রেতা তোরাব হোসেন বলেন, ‘১২টি গরু হাটে এনেছি। একেকটি গরুর পেছনে আমার অনেক টাকা খরচ। সবকিছু হিসাব করেই আমার গরু বিক্রি করতে হবে।’
একাধিক ক্রেতা বলেছেন, গরুর দাম একটু বেশি হলেও আগেই কিনতে তারা হাটমুখী হচ্ছেন। তবে আগে কিনলেও সমস্যা আছে। ঢাকায় সবার তো গরু রাখার মতো জায়গা নেই।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আরাফাত ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘কোরবানির ঈদ ঘিরে রাজধানীসহ সারা দেশের হাটে আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছেন। প্রতিটি হাটে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। র্যাব সদস্যদের বলা হয়েছে কোনো গরুর বেচাকেনার ক্ষেত্রে কেউ প্রতারিত হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাল টাকার চক্রের ব্যাপারে আমরা সতর্ক রয়েছি।’