ঢাকা ১০ আষাঢ় ১৪৩১, সোমবার, ২৪ জুন ২০২৪

ভূ-রাজনীতির টার্গেট সেন্ট মার্টিন!

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৪, ০১:৫৩ পিএম
আপডেট: ১৬ জুন ২০২৪, ০২:০৯ পিএম
ভূ-রাজনীতির টার্গেট সেন্ট মার্টিন!
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পরাশক্তিগুলো এখন বেশ সক্রিয়। চীনের বিপুল কর্মযজ্ঞ সেখানে চলমান। ভারতও চীনকে পাল্লা দিয়ে অঞ্চলটিতে এতদিন পর্যন্ত বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। শুধু তা-ই নয়, গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত এ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় পিছিয়ে নেই যুক্তরাষ্ট্রও। এ অবস্থায় কক্সবাজারের টেকনাফের পাশাপাশি এবং অনিন্দ্যসুন্দর প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন কি পরাশক্তিগুলোর বলি হতে যাচ্ছে! এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। 

সেন্ট মার্টিন থেকে নাফ নদীতে মায়ানমারের জলসীমায় সম্প্রতি তিনটি যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, দেশটির আকাশসীমায় উড়েছে যুদ্ধবিমান। ফলে ভয় ও আতঙ্ক ধরে গেছে সেন্ট মার্টিনের মানুষের মধ্যে। মূল ভূখণ্ড থেকে ঠিকমতো রসদ পৌঁছানো যায়নি বেশ কয়েক দিন। তাই সেখানে দেখা গেছে খাদ্যসংকটও। অবশেষে শুক্রবার রাতে বিশষ সামরিক পাহারায় সেখানে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানো হয়েছে।

গেল সপ্তাহে পরিস্থিতির এমন অবনতি হয় যে, মায়ানমারের দিক থেকে বাংলাদেশের জলসীমায় চলাচল করা কয়েকটি নৌযানকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। তবে গুলি মায়ানমারের সেনাবাহিনী করেছে না বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি করেছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পরিস্থিতি বোঝার জন্য ঢাকার পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার নেপিডোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মিয়া মো. মাইনুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মায়ানমারের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। তবে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস সব সময় সক্রিয় আছে।’

রাখাইন ঘিরে চীনের বিশাল স্বার্থ
মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। রয়েছে ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের বিশাল মজুত। ২০০৪ সালে এই মজুত আবিষ্কারের পরপরই অঞ্চলটি ঘিরে চীনের আগ্রহ বাড়তে থাকে। তারপর ২০০৮ সালে চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে মায়ানমারের জান্তা সরকার। রাখাইন থেকে গ্যাস চীনের ইউনান প্রদেশে নিতে পাইপলাইন স্থাপন করেছে বেইজিং। এ ব্যবস্থায় প্রতিবছর ১২ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। 

রাখাইনে রয়েছে তেলেরও বিশাল মজুত। সেখান থেকে অপরিশোধিত তেল সংগ্রহের জন্য ২০০৮ সালে পাইপলাইন স্থাপনের চুক্তি করে চীন। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানোর মাত্র চার মাস আগে থেকে এই পাইপলাইনে চীনের ইউনান প্রদেশে তেল সরবরাহ শুরু হয়। চীনের ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য। 

চীনের সঙ্গে রাখাইন রাজ্য সম্পর্কিত ৩৩টি  চুক্তি করেছে মায়ানমার। চীন রাখাইনে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পাশাপাশি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করারও চুক্তি করেছে। 

চুক্তি অনুযায়ী রাখাইনের কিউকফিউ শহরে নির্মিত সমুদ্রবন্দরের সিংহভাগ, অর্থাৎ ৭০ শতাংশ মালিকানা থাকবে চীনের। বাকি মাত্র ৩০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ থাকবে মায়ানমারের হাতে। রাখাইনের সঙ্গে ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটারের একটি অর্থনৈতিক করিডর গড়ে তুলছে চীন। এর উদ্দেশ্য হলো ভারত মহাসাগরের সঙ্গে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিংয়ের সংযোগ ঘটানো। চাওকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চাওকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দর এই বিশেষ করিডরের অংশ।

চাওকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে চীন বিনিয়োগ করছে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার। আর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে খরচ হবে ৭৩০ কোটি ডলার। রাখাইন রাজ্যের চাওকপিউ টাউনশিপের মাদে দ্বীপে ১৫০ হেক্টর ও রামরি দ্বীপে ৯৬ হেক্টর জমিতে এই দুই প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে।

চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে ভারতও
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব খর্ব করতে মায়ানমারকে কাছে টানতে চাইছে ভারত। তাই রাখাইনে বড় ধরনের বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। ভারত চাইছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাখাইনের সিটওয়ে বন্দর প্রকল্পের কাজ। সিটওয়েতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর ও অভ্যন্তরীণ নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ করছে ভারত। ভারতের এখানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৮৪ মিলিয়ন ডলার। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সমুদ্রপথে কলকাতার সঙ্গে রাখাইনের সিটওয়ে (আগের আকিয়াব) সংযুক্ত হবে। ভারত অনেক আগেই এ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। 

বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে সিটওয়ে বন্দর ভারতের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতা থেকে ভারতের সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহনে এই রুটটি ব্যবহৃত হবে। এটা সম্পন্ন হলে নদীপথে সিটওয়ের সঙ্গে মায়ানমারের চিন রাজ্যের পালেটওয়া বন্দরকে সংযুক্ত করবে। এরপর সড়কপথে পালেটওয়া সংযুক্ত হবে মিজোরামের জরিনপুইয়ের সঙ্গে। এ প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে একদিকে মায়ানমার-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়বে, অন্যদিকে ভারতের সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহন সহজ হবে। 

ভারতের সঙ্গে মায়ানমারের প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। বঙ্গোপসাগরেও উভয় দেশের সীমান্ত রয়েছে। রাখাইনের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদ ভারতের নরেন্দ্র মোদি প্রশাসনের লুক ইস্ট নীতি বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

সক্রিয় যুক্তরাষ্ট্রও 
রাখাইন রাজ্যের বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে অঞ্চলটির প্রতি আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররাও। এ জন্য রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মায়ানমারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ ছাড়া তেমন উচ্চবাচ্য করে না দেশটি। 

যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় কোম্পানি রাখাইন রাজ্যে তেল-গ্যাসে বিনিয়োগ করছে। ব্যবসা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে রাখাইন রাজ্য ঘিরে। দেশটি ভারত মহাসাগরে তার উপস্থিতি বাড়াতে চায়।  তাছাড়া তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন যেহেতু রাজ্যটিতে সক্রিয়, কাজেই যুক্তরাষ্ট্রও সক্রিয়। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র চায় এই অঞ্চলে তার ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) বাস্তবায়ন করতে এবং এশিয়ার ন্যাটো বলে পরিচিত কোয়াডের বিস্তার ঘটাতে। 

এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা আগে ভারতের চোখ দিয়ে এই অঞ্চলকে দেখত। এখন যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির পরিবর্তন হচ্ছে। তারা সরাসরি এই অঞ্চলে সম্পৃক্ত হতে চায়।’
 
সেন্ট মার্টিনের বর্তমান অবস্থা
বিকট বিস্ফোরণের শব্দ আসছে। স্থানীয়রা বলছেন, আগে মাঝে মাঝে বিস্ফোরণের শব্দ আসত। সম্প্রতি একটানা বিকট বিস্ফোরণের শব্দ আসছে। এ ছাড়া নাফ নদীতে মায়ানমারের জলসীমায় তিনটি যুদ্ধজাহাজ সেন্ট মার্টিন থেকে দেখা গেছে। দেশটির আকাশসীমার মধ্যে উড়তে দেখা যায় যুদ্ধবিমানও। পরে যুদ্ধজাহাজ চলে গেলেও আতঙ্ক কাটেনি। 

দ্বীপটির ১০ হাজার মানুষ খাদ্যসংকটের মুখে পড়েছে। এ অবস্থা গত ৭-৮ দিন ধরেই। সর্বশষ গত শুক্রবার চাল, ডাল, পেঁয়াজ, তেলসহ নানা ধরনের খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে যাত্রা করে ‘বার আউলিয়া’ নামের একটি জাহাজ। শুক্রবার বেলা ২টা ১৫ মিনিটে কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএর ঘাট থেকে জাহাজটি সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। জাহাজটিতে দেড় শতাধিক মানুষ ও সরকারি সহায়তায় খাদ্যপণ্য এবং পাঁচটি কোরবানির গরু ছিল।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. ইয়ামিন হোসেন জানান, দ্বীপের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমন্বয় করে জাহাজটি পাঠানো হয়। এটি বঙ্গোপসাগর দিয়ে টেকনাফ পৌঁছে ঘোলারচর হয়ে সেন্ট মার্টিন যায়। পণ্যসামগ্রীর পাশাপাশি কক্সবাজারে আটকা পড়া সেন্ট মার্টিনের অনেক বাসিন্দাও এই জাহাজে করে ফিরে আসেন।

কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ 
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিকভাবেই অগ্রসর হতে হবে এবং বাংলাদেশ সে পথেই অগ্রসর হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। মায়ানমার বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে রাখাইনের পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে তার প্রভাব বাংলাদেশের জন্য সুখকর হবে না বলেই মনে করছেন তারা। 

এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার কূটনৈতিকভাবেই অগ্রসর হচ্ছে। আমিও মনে করি, কোনো ধরনের যুদ্ধে না জড়িয়ে কূটনৈতিক উপায়ে সমাধানের চেষ্টা করা উচিত বাংলাদেশের। প্রয়োজনে জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, মায়ানমারের ওপর চীনের প্রভাব বেশি। দেশটির জান্তা সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি উভয়ের সঙ্গেই চীনের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শ তাদের।

এ প্রসঙ্গে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘চীনের সঙ্গে মায়ানমারের জান্তা সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো যেতে পারে। ভারেতর সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে হবে।’

বিশিষ্টজনের অভিমত

আক্রান্ত হলে ছেড়ে দেব না: ওবায়দুল কাদের

সেন্ট মার্টিন-টেকনাফ নৌরুটে মায়ানমারের গোলাগুলি নিয়ে দেশটির সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত-সংকটে আমরা ভুক্তভোগী হলে সেটা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। যুদ্ধকে পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চলছে এবং চলবে। তবে আমাদের কেউ আক্রান্ত হলে, ছেড়ে দেব না। সেই আক্রমণের জবাব দেওয়া হবে।’

শনিবার (১৫ জুন) দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, আমাদের দরকার রোহিঙ্গা চাপ সরিয়ে নেওয়া। সার্বিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। শেখ হাসিনার সরকার সব জায়গায় (বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে) প্রথমে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। কিন্তু এটা দুঃখজনক, জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠান এখন নখদন্তহীনে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েল, বড় বড় দেশ তাদের কথা শোনে না। জাতিসংঘের অনুরোধের কোনো কার্যকারিতা বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি না।

সেন্ট মার্টিনে মায়ানমারের গুলি প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নিজেদের এত খাটো করে দেখব কেন? আমরাও প্রস্তুত। আক্রমণ করব না, কিন্তু আক্রান্ত হলে কী ছেড়ে দেব? আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করতে হবে। 

তিনি বলেন, ‘মায়ানমারের সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো বৈরিতা নেই। আলাপ-আলোচনার দরজা খোলা আছে। আমরা কথা বলতে পারি। যতক্ষণ কথা বলা যাবে, আলাপ আলোচনা করা যাবে; আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা (সেন্ট মার্টিনে গুলি) সমাধানের চেষ্টা করছি এবং করে যাব। আমাদের যেন কোনো উসকানি না থাকে।’

ওবায়দুল কাদের বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারে অভ্যন্তরীণ কিছু সংকট আছে। দেশটির নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী রয়েছে ৫৪টি। তাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। তবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা জেঁকে বসেছে। বিশ্ব আমাদের প্রশংসা করছে তাদের (রোহিঙ্গাদের) আশ্রয় দেওয়ার জন্য। কিন্তু এই রোহিঙ্গাদের জন্য যে সাহায্যের পরিমাণ ছিল, সেটি অনেক কমে গেছে।

চলমান বিশ্ব সংকটে (করোনা মহামারির পর আর্থিক সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসন) আমরা নিজেরাই সংকটে আছি জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, নিজেদেরই দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়ার কারণ নেই। সেখানে ১১-১২ লাখ রোহিঙ্গা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে আছে। সেতুমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দুনিয়ার বড় বড় দেশ যারা রোহিঙ্গা নিয়ে কথা বলে, তাদের লিপ সার্ভিসের দরকার নেই।

সড়কে যানজট নিয়ে সেতুমন্ত্রী বলেন, যানজটের জন্য রাস্তা কোনো সমস্যা নয়। ধীর গতির কোরবানির পশুবাহী গাড়ি, সড়কের পাশে পশুর হাট একটা সমস্যা। তারপরও ঈদ যাত্রায় কিছু কিছু জায়গায় যানজট হলেও কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়নি। আশা করি সামনের দিনগুলো ভালো যাবে। অবশ্য আজ (শনিবার) এবং আগামীকাল (রবিবার) গার্মেন্ট ছুটি হলে কোনো কোনো জায়গায় চাপটা বাড়তে পারে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক ও সুজিত রায় নন্দী, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম প্রমুখ।

মায়ানমারকেও কিছু বলা যাচ্ছে না: মির্জা ফখরুল 

মায়ানমার সীমান্ত থেকে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে নৌযান লক্ষ্য করে গুলির ঘটনার উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘মায়ানমারের মতো একটা দেশকেও আজ কিছু বলা যাচ্ছে না? এটা যে কতটা নতজানু, দাসসুলভ মনোভাব হতে পারে। সেন্ট মার্টিন ইস্যুতে সরকারের নীরবতা দাস সুলভ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।’

শনিবার (১৫ জুন) রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘সংবাদপত্রের কালো দিবস উপলক্ষে’ এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। আয়োজন করে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশ। অনুষ্ঠানে ধারণাপত্র পাঠ করেন, বিএফইউজের একাংশের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী। এতে আরও বক্তব্য রাখেন, নয়া দিগন্তের সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, বিএফইউজের সভাপতি রহুল আমিন গাজী, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, সৈয়দ আবদাল আহমেদ, সাংবাদিক আবদুল হাই শিকদার প্রমুখ।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সীমান্তে মানুষ মারছে। পানি দিচ্ছে না। অথচ সরকার একটা কথা বলে না। বাংলাদশকে পরনির্ভরশীল রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলেছে সরকার। চীন বিশ্বে একনায়কতন্ত্র চলছে- এমন দেশের দিকে ঝুঁকছে। সারা বিশ্বেই একনায়কতন্ত্র বাড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘এখন প্রতিদিনই পুরো জাতির জন্যই কালো দিবস। বর্তমান সরকার ১৯৯৬ সালে এসেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ শুরু করেছে। কিছু সাংবাদিক সাহস করে কাজ করছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, বেনজীর, আজিজ, আনারের ঘটনা সাংবাদিকরাই তুলে এনেছেন।’ 

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘সেনাপ্রধান জালিয়াতি করবেন, পুলিশপ্রধান ডাকাতি করে দেশে সাম্রাজ্য গড়ে তুলবেন, কল্পনা করা যায়? বর্তমান সরকারের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। বেনজীর-আজিজ ও আনারের ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য গণমাধ্যমে উঠে আসতে শুরু করেছে। ভাইদের পাসপোর্ট জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠা সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের বিচারের তিনি দাবি করেন।’

সংবাদের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কিছু বাণী প্রচার করা হয়, তিনি তা শুনছিলেন উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘উনি বলছিলেন, যারা আজকে সম্পদ লুণ্ঠন করে পাচার করে নিয়ে যায়, তাদের এ দেশের মাটিতে জায়গা নেই।’ তিনি বলেন, ‘যারা এখন ক্ষমতায় আছে, তারা কি একবারও এ কথা শুনছে?’

বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে বিপ্লব করেছেন। আমাদেরও এটা সম্ভব। বলছি না যে এখান থেকেই করতে হবে। বাইরে যারা থাকেন, তারা করুক। দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অমুক–তমুক আইন, গুম করে দেওয়ার বিষয় আছে।’

ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনৈতিক অঙ্গনে বাম-ডান সবাইকে একটা জায়গায় নিয়ে এসেছি। সাংবাদিকরাও যদি এক প্ল্যাটফর্মে আসেন, তা হলে দেশে গণতন্ত্র ফিরবে।’

সার্বভৌমত্বে আঘাত হেনেছে: জি এম কাদের 

মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নাইক্ষ্যংদিয়া থেকে নাফ নদের বাংলাদেশ সীমান্তে শাহপরীর দ্বীপে বাংলাদেশি নৌযান লক্ষ্য করে দফায় দফায় গুলির ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদের। শনিবার (১৫ জুন) দুপুরে রংপুর সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার আমাদের সেন্ট মার্টিনে মানুষকে ঢুকতে দেবে না। দীর্ঘদিন থেকে তারা এখানে হামলা করছে। তারা বিভিন্নভাবে আমাদের ভূখণ্ডে চলে আসতে চাচ্ছে। তারা আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা করছে।’

বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, ‘সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী অনেক শক্তিশালী, অনেক কিছু আমরা শুনি। তাদের ভূমিকা আমরা দেখছি না। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এটা দুঃখজনক।’ 

রোহিঙ্গা সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এর আগে এক মিলিয়ন রোহিঙ্গাকে আমাদের দিকে ঠেলে দেওয়া হলো। তখন বিভিন্ন অজুহাতে আমরা মানবতাবাদী হয়ে গেলাম তাদের রক্ষা করতে গিয়ে। আমাদের ঘাড়ে তাদের বোঝাটা নিলাম। এখন তারা যদি আমাদের ভূখণ্ড দখল করে ফেলে, সেন্ট মার্টিন কন্ট্রোলে নিয়ে ফেলে সরকার কি করবে আমরা জানি না। এটা আবার কোনো মহত্ত্বের পরিচয় দিয়ে দেওয়া হবে কি না! সার্বভৌমত্ব বিষয়ে সরকারকে বক্তব্য দেওয়া উচিত কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, ওনারা কী করছেন। আমরা উৎকণ্ঠিত। জনগণ এর উত্তর চায়।’   

এদিকে ঈদুল আজহায় দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে জি এম কাদের বলেন, ‘আজ আমরা ঈদুল আজহার শিক্ষার মধ্যে নেই। আজকে সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। আল্লাহর নির্দেশিত পথের বাইরে আমরা প্রতিযোগিতা করছি, সর্বশক্তি নিয়োগ করছি। ত্যাগের মহিমায় আমরা নিজেদের উদ্ভাসিত করতে পারছি না। সেই কারণে আমি মনে করি, ঈদুল আজহার দিনে এই শপথ নিতে হবে, পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি ও দুর্নীতির জন্য প্রতিযোগিতাও কোরবানি করব। ঈদুল আজহার শিক্ষা নিয়ে সকলকে এগিয়ে যেতে হবে। এটাই হোক আজকের দিনের প্রত্যয় ও শপথ।’ 

হামলা হলে ছাড় নয়: জেনারেল শফিউদ্দিন

বিদায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহম্মেদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো বহির্শত্রু আক্রমণ করতে চাইলে আমরা প্রতিহত করব। বর্তমানে যে বর্ডার ভায়োলেট হচ্ছে, সেখানে বর্ডার গার্ড রয়েছে, কোস্টগার্ড রয়েছে, নৌবাহিনী রয়েছে। তারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে কাজ করছে। এর চেয়ে বেশি খারাপ হলে বা আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা হলে আমরা কাউকে ছাড় দেব না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, আমরা শান্তি চাই। যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে।’ 

শনিবার (১৫ জুন) দুপুর সাড়ে ১২টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯ পদাতিক ডিভিশনের তত্ত্বাবধানে শেখ রাসেল সেনানিবাসে একটি ব্রিগেড সিগন্যাল কোম্পানির পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি এ কথা বলেন। 

এস এম শফিউদ্দিন আহম্মেদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘ মিশনে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। বর্তমানে কুয়েত ও কাতারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। ভবিষ্যতে এসব দেশে সেনাসদস্য সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক কাজ করছে শেখ রাসেল সেনানিবাস।’

অনুষ্ঠানে জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, এসবিপি (বার), ওএসপি, এনডিইউ, পিএসসি, পিএইচডি প্রধান অতিথি হিসেবে নবগঠিত ইউনিটের পতাকা উত্তোলন করেন।

বিদায়ী সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমার দায়িত্বকালীন সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেবার মানসিকতা নিয়ে প্রদত্ত দায়িত্বসমূহ যথাযথভাবে পালন করতে পারায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত ও স্বাধীন ভূখণ্ড নিরাপদ রাখতে অর্পিত সব দায়িত্ব পালন করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অঙ্গীকারবদ্ধ। দেশের সংকটময় মুহূর্তসহ যেকোনো পরিস্থিতিতে অকুতোভয় দায়িত্ব পালনে সেনাবাহিনী সদা প্রস্তুত।’

এ সময় একজন সাংবাদিক বিদায়ী সেনাপ্রধানের অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি জানান, নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরে তিনি আত্মতৃপ্ত। তবে দীর্ঘদিনের পোশাক খুলতে কিছুটা কষ্ট হবে বলে জানান তিনি। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।

পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে বিদায়ী সেনাপ্রধান তার মূল্যবান বক্তব্যে সেনাবাহিনীর নতুন ইউনিটের সদস্যদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। এ সময় তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং সেই সব বীর শহিদদের যাদের আত্মত্যাগে অর্জিত হয়েছে দেশের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।’

তিনি বলেন, ‘‘১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় প্রণীত হয় ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’। আজকের এই পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ এর আরেক ধাপ বাস্তবায়িত হলো।’’

পতাকা উত্তোলন ও কেক কাটা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নতুন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, সেনা সদরের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারাসহ ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন শরীয়তপুর-২ (নড়িয়া-সখিপুর) আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম এনামুল হক শামীম, জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ ও পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুল আলম।

সম্পদ বৈধ: বেনজীরের সাফাই

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪, ০১:৩০ পিএম
আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪, ০২:৪০ পিএম
সম্পদ বৈধ: বেনজীরের সাফাই

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) শেষ দিনেও হাজির হননি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। তবে তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে দুদকে বক্তব্য পাঠিয়েছেন। এতে তার নিজের এবং স্ত্রী-সন্তানদের অর্জিত অর্থ-সম্পদ বৈধ বলে দাবি করেছেন। তার স্ত্রী-সন্তানদের আয় দেখানো হয়েছে ব্যবসা থেকে। নিজের আয় দেখানো হয়েছে বেতন-ভাতা, ঋণ, বিয়েবার্ষিকী, জন্মদিনে পাওয়া উপহার। লিখিত বক্তব্যে প্রতিটি সম্পদের উৎস তাদের আয়কর নথির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তুলে ধরা হয়েছে। 

এদিকে সর্বশেষ তলবেও বেনজীর আহমেদ হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন। 

তিনি রবিবার (২৩ জুন) সাংবাদিকদের বলেন, ‘বেনজীর আহমেদ গত বৃহস্পতিবার দুদকের চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছেন। এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য কি না, তা অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা বিবেচনা করবেন।’

দুদক সূত্র জানিয়েছে, ইমতিয়াজ ফারুক অ্যাসোসিয়েটের ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ ফারুক ও অ্যাডভোকেট সাইদুল ইসলাম অন্তরের স্বাক্ষর করা বেশ কিছু কাগজ বৃহস্পতিবার দুদকে জমা দেওয়া হয়েছে। এতে বেনজীরের বক্তব্যও ছিল। বক্তব্যে মূলত তার নিজের এবং স্ত্রী-সন্তানদের অর্জিত অর্থ-সম্পদ বৈধ বলে দাবি করা হয়েছে। তার স্ত্রী-সন্তানদের আয় দেখানো হয়েছে ব্যবসা থেকে। নিজের আয় দেখানো হয়েছে বেতন-ভাতা, ঋণ, বিয়েবার্ষিকী, জন্মদিনে পাওয়া উপহার। লিখিত বক্তব্যে প্রতিটি সম্পদের উৎস তাদের আয়কর নথির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তুলে ধরা হয়েছে। বক্তব্যের পাশাপাশি বেনজীরের অর্থ-সম্পদ সম্পর্কিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ল ফার্ম ‘ইমতিয়াজ ফারুক অ্যাসোসিয়েট’-এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পত্রপত্রিকায় পাঠানো প্রতিবাদলিপি ও লিগ্যাল নোটিশগুলো দুদকে জমা দেওয়া হয়েছে। ওই সব লিগ্যাল নোটিশ ও প্রতিবাদলিপিই মূলত দুদকের অনুসন্ধানে বেনজীর আহমেদের বক্তব্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ ফারুক খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রায় দুই মাস আগে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর তার পক্ষে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। এরপর আর কিছু জানি না। তার সঙ্গে (বেনজীর) যোগাযোগও নেই। সেই লিগ্যাল নোটিশগুলোই অন্য কেউ দুদকে জমা দিয়ে থাকতে পারে।’  

সোমবার (২৪ জুন) বেনজীরের স্ত্রী ও দুই মেয়ের হাজিরা নির্ধারিত আছে। এ বিষয়ে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা হাজির না হলে অনুসন্ধান কর্মকর্তারা পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করবেন। 

সহসা ফিরছেন না বেনজীর
গত ৩১ মার্চ গণমাধ্যমে বেনজীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি ফেসবুক লাইভে এসে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে তা অতিরঞ্জিত বলে আখ্যায়িত করেন। তবে তিনি কোনো নির্দিষ্ট গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেননি। এরপরই তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। 

গুজব ওঠে তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। পরে জানা গেছে, গত ৪ মে রাত পৌনে ১০টার দিকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে একটি ফ্লাইটে করে সিঙ্গাপুরে চলে যান। সিঙ্গাপুরে তিনি এবং তার পরিবারের চিকিৎসা শেষে দুবাই চলে গেছেন। বর্তমানে দুবাইয়ে তিনি অবস্থান করছেন। দুদক তার সম্পদের হিসাবের জন্য ডাকলেও তিনি গতকাল হাজির হননি। বেনজীরের ঘনিষ্ঠ ঢাকা মহানগর পুলিশের এক ডিসি জানান, তিনি সহসাই দেশে ফিরবেন না।

বিশ্লেষক অভিমত: সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামাতে হবে, তিস্তার ফয়সালা দরকার

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪, ১১:৫৩ এএম
আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪, ১২:১০ পিএম
বিশ্লেষক অভিমত: সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামাতে হবে, তিস্তার ফয়সালা দরকার
ছবি : সংগৃহীত

সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে বাংলাদেশিদের নিয়মিত হতাহতের ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামানোর সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দরকার। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের মতো ইস্যুরও সুরাহা হওয়া দরকার। এসব বিষয়ে যদি প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি পাওয়া হয়ে থাকে, তাহলে সফরটিকে সফল বলা যাবে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদ্যসমাপ্ত ভারত সফরকে এভাবেই মূল্যায়ন করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। এই সফরকালে মোট ১০ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, যার মধ্যে তিনটি নবায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া সফরে ১৩টি ঘোষণাও এসেছে। 

এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে যা কিছুই ঘটুক না কেন, আমাদের লক্ষ রাখতে হবে বাংলাদেশের স্বার্থ যাতে রক্ষিত হয়।’

সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় নামানোর ভারতীয় প্রতিশ্রুতি দরকার
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, গত সাত বছরে সীমান্তে বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন ২০১ জন বাংলাদেশি। এ ছাড়া সীমান্ত থেকে বাংলাদেশিদের ধরে নিয়ে যাওয়াসহ নানা ধরনের নির্যাতনের মতো ঘটনা তো ঘটেছেই। 

প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানান, সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে আলোচনা হয়েছে। যদিও এ ব্যাপারে ভারতের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে কি না তা জানাননি তিনি।

এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে চীন-পাকিস্তানের যে সম্পর্ক, আমাদের সম্পর্ক কিন্তু তেমন নয়। আমরা তো বন্ধুরাষ্ট্র। অথচ সীমান্ত হত্যা দেখলে মনে হয় আমরা যেন বৈরী রাষ্ট্র। সীমান্তের দুই কিলোমিটারের মধ্যে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না, ভারতের এমন চুক্তি আছে চীনের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গেও এমন চুক্তি দরকার।’

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি এম হুমায়ুন কবির বলছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে তৈরির কিছু নেই। চলমান সম্পর্কই শক্তিশালী করার চেষ্টা থাকে। দুই দেশের মধ্যে যেসব সম্ভাবনার জায়গা আছে, যেমন সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামানো ও ঝুলে থাকা তিস্তার পানিবণ্টনের সুরাহা হওয়ার মতো প্রতিশ্রুতি থাকে তাহলে প্রধানমন্ত্রীর সফরকে সফল বলা যায়। 

তিস্তা নদীর পানিবণ্টন ইস্যুর সমাধান দরকার
২০১১ সালে চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত ভারতের অনীহার কারণে সম্ভব হয়নি। ভারত বরাবর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দোহাই দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চান না তাই চুক্তি হচ্ছে না বলে যুক্তি দিচ্ছে। 

ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে। উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকা মরুভূমির রূপ নিয়েছে। ফসল হয় না এবং বন্যার সময় ভারত পানি ছেড়ে দেওয়ায় বাংলাদেশের ওই এলাকাগুলো প্লাবিত হয়। 

১৯৮২ সালে বাংলাদেশের ১০০ কিলোমিটার উজানে জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবায় তিস্তা নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে। ফলে বাংলাদেশে তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভারতের পক্ষ থেকে যে উদ্বেগগুলো ছিল, সেসব বাংলাদেশ দূর করেছে। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে উদ্বেগগুলো ছিল, যেমন তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি বা সীমান্ত হত্যার মতো বিষয়গুলো আগের মতোই রয়েছে।’

পানিবণ্টন চুক্তি নয়, ভারতের আগ্রহ এখন তিস্তা প্রকল্পে
সরকারের সংশ্লিষ্টরা জানান, তিস্তার পানি না পেয়ে বাংলাদেশ বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে সারা বছর ব্যবহার করা সংক্রান্ত একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছে। প্রথম দিকে ‘তিস্তা নদী সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা এবং পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ নামে প্রকল্পটি চীনকে দিয়ে বাস্তবায়নের কথা ছিল। এই ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’য় ভারত হঠাৎ বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ফলে ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের এই প্রকল্প আসলে বেইজিং না নয়াদিল্লি বাস্তবায়ন করবে, সেটি এখনো ঢাকার পক্ষ থেকে পরিষ্কার করা হয়নি। 

তিস্তা প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশের পর ঝুলে যাওয়া তিস্তা চুক্তি নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না নয়াদিল্লি। এখন তাদের সব আগ্রহ তিস্তা প্রকল্প নিয়ে। গত শনিবার দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক শেষে নরেন্দ্র মোদি জানান, পানিবণ্টন চুক্তি নয়, তিস্তার পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় একটি মহাপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে শিগগিরই বাংলাদেশ যাবে একটি কারিগরি দল।

‘টেকা যা দিছ, আর দেওনের কাম নাই’

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪, ১০:১১ এএম
আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪, ১০:১৫ এএম
‘টেকা যা দিছ, আর দেওনের কাম নাই’
ছবি : খবরের কাগজ

‘স্যার, আমার জামিন করায়ে দেন না।’
‘তোমার মা-বাবাকে বলো আমার সঙ্গে কথা বলতে। তোমার কী মামলা?’
‘গাঁজার মামলা।’
‘আরে না, গাঁজার মামলায় তো এমনিই জামিন হয়ে যাবে কদিন পর। মার্ডার কেসের কেউ লাগলে (মামলায় আইনি সহযোগিতা) যোগাযোগ কইরেন।’

রবিবার (২৩ জুন) ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনে এক কিশোরের সঙ্গে এক আইনজীবীর সহকারীর এই কথোপকথন হয়। বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত কিশোরদের নিয়ে আসা গাড়িতে বসেছিল রজব নামের এই কিশোর।
 
একই গাড়িতে অপেক্ষমাণ আরেক কিশোর ও তার অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলা শেষে আইনজীবীর সহকারী রফিকুল ইসলাম জাহাঙ্গীরের কাছে এই আকুতি জানায় রজব।

গাড়িটি ঘিরে জটলার মধ্য থেকে এক নারী আরেক অভিভাবক মাকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, ‘ভিক্ষার জামিন অইবো তুমার পোলার। উকিলরে টাকা যা দিছ, আর দেওনের কাম নাই। চুপ মাইরা থাক।’ 

পরামর্শ দেওয়া নারী জাহেদা খাতুন ওই মা তাফিরুন্নেসার কথার সূত্র ধরেই তাকে বলেন, ‘তুমার পোলা তো মূল আসামি না। মূল আসামিরই এখনো জামিন অয় নাই। তার জামিন অইলে পরে তুমার উকিল গিয়া আদালতে কইবো, মূল আসামির জামিন অইয়া গেছে, আমার মোয়াক্কেল তো মূল আসামি না, এতদিন উকিল নিয়োগ দিতে পারে নাই, তারা গরিব মানুষ, তার জামিন দেওয়া হোক।’

পরামর্শ দেওয়া নারী জাহেদা খাতুন খবরের কাগজকে বলেন, ৮-৯ বছর ধরে তিনি আদালতে আসা-যাওয়া করছেন। একটি হত্যা মামলায় তার ছেলে আসামি। ঘটনার সময় তার ছেলের বয়স ছিল ১২ বছর। তার বিচার হচ্ছে শিশু আইনে। 

এতদিনে আইন-আদালত নিয়ে তার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে জানিয়ে বলেন, তাফিরুন্নেসার ছেলের জামিনের জন্য উকিল ৩০ হাজার টাকা চেয়েছেন। এযাবৎ ১০ হাজার টাকা নিয়েছেনও। কিন্তু উকিল জামিনের জন্য কোনো চেষ্টাই করছেন না। আসলে তিনি মূল আসামির জামিনের জন্য অপেক্ষা করছেন। কারণ টাকাপয়সা খরচ করে মূল আসামি যখন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী নিয়োগ করে জামিন নিয়ে নেবেন, তখন অন্যান্য আসামির জামিন সহজ হয়ে যায়। তখন অন্যান্য আসামির পক্ষে আদালতে আবেদন করলেই আদালত সহানূভূতির দৃষ্টিতে দেখেন।

জাহেদা খাতুনের ভাষায় যা ‘ভিক্ষার জামিন’ বা বিনা খরচের জামিন। এর মধ্যে উকিল যা পারে, তাদের কাছ থেকে টাকাপয়সা নিতে থাকবে, তাই এখন উকিলকে আর টাকা না দেওয়াই ভালো।

কিশোরদের নিয়ে আসা গাড়িটিকে কেন্দ্র করে জমে ওঠা জটলার মধ্যেও ছিল ৮-১০ কিশোর। কথা বলে জানা গেল, তারা ভ্যানের ভেতরে থাকা কিশোরদের বন্ধু-স্বজন। জটলার মধ্যে থাকা উৎসুকদের কয়েকজন ভেতরে-বাইরে থাকা কিশোরদের দিকে ইঙ্গিত করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলেন যে, এরা ‘কিশোর গ্যাং’। 

এ সময় তারা ভেতরে থাকা কিশোরদের হাঁটিয়ে আদালত ভবনে নেওয়ার সময় বাইরে থাকা কিশোরদের হাত থেকে নিয়ে সিগারেট ফুঁকার উদাহরণও দেন। বাবার বয়সী পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে যেতে যেতেই অবলীলায় নিজেদের মধ্যে জ্বলন্ত সিগারেট দেওয়া-নেওয়া করাকে গর্হিত কাজ বলেই উল্লেখ করেন তারা।

গাড়ির ভেতর থেকে বাইরে অপেক্ষমাণ মায়ের হাত ধরে কান্নাকাটি করতে থাকা এক কিশোরকে দেখে উৎসুকদের কেউ কেউ অবশ্য বলে উঠলেন, আহারে, ছেলেটা মনে হয় অপরাধ করে নাই। বিনা দোষে ফেঁসে গেছে। কিশোরের মা-ও চোখ মুছতে মুছতে ছেলেকে শিগগিরই জামিনে বের করে আনার আশ্বাস দেন।

রবিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভ্যানের ভেতরে থাকা এক কিশোর ও তার অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলেন আইনজীবীর সহকারী পরিচয় দেওয়া রফিকুল ইসলাম জাহাঙ্গীর। তাদের জানালেন, এখানে জামিন হবে না, হাইকোর্টে যেতে হবে।

জটলার মধ্যে থাকা দম্পতি মজিবর রহমান ও শাহিনুর আক্তার আদালতে এসেছেন ভ্যানের ভেতরে থাকা তাদের সন্তান মো. জাহিদকে (১৪) দেখতে। বললেন, ঈদের আগেই ছেলের জামিন হয়েছিল। তবে পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় এখনো মুক্ত হতে পারেনি। আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করে পেশায় দর্জি মজিবর আরও টাকাপয়সা দিয়েছেন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। কয়েক দিনের মধ্যেই ছেলে মুক্ত হবে বলে তাদের আশা। আগে-পরে এলেও হতো। কিন্তু আজ (রবিবার) ছেলেকে আদালতে আনা হবে, তাই আজ এলে ছেলের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হবে, আবার আইনজীবীর সঙ্গেও কথা হবে, তাই এসেছেন।

গত ৮ মার্চ রাজধানীর শ্যামপুর দোলাইরপাড়ে ছুরিকাঘাতে শান্ত (১৮) নামে এক তরুণ নিহত হয়েছেন। ওই ঘটনায় করা মামলায় তাদের ছেলেকে আসামি করা হয় বলে জানান তারা।

সব হারালেন মতিউর

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪, ০৯:২৬ এএম
আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪, ০৯:৩০ এএম
সব হারালেন মতিউর
কানাডায় প্রথম স্ত্রী ও সেই ঘরের সন্তানদের সঙ্গে মতিউর রহমান (বায়ে), দ্বিতীয় স্ত্রী ও দুই সন্তান (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দুর্নীতির অভিযোগে পঞ্চম দফায় অনুসন্ধান শুরু করল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর আগে গত ২০ বছরে চারবার অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েও তাকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি তার ছেলের ছাগলকাণ্ডে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষাপটে অনুসন্ধানকাজ বেশ জোরেশোরেই শুরু করা হয়েছে। তার আর্থিক দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ খুঁজতে আজ সোমবার থেকেই মাঠে নামছে দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান টিম। 

অনুসন্ধান শুরুর বিষয়ে রবিবার (২৩ জুন) ঢাকার সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘মতিউরের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ জুন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। সেই সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে রবিবার তিন সদস্যের টিম গঠন করা হয়েছে। টিমের সদস্যরা ইতোমধ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছেন।’

দুদক সূত্র জানায়, রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের অবৈধ সম্পদের তথ্য-উপাত্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার আগেই তার বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে অবৈধ সম্পদ, হুন্ডি, আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগের ভিত্তিতে গত ৪ জুন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্তের প্রায় ২০ দিন পর উপপরিচালক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান টিম গঠন করা হলো। টিমের অন্য দুই সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক মাহমুদ হোসেন ও উপসহকারী পরিচালক সাবিকুন নাহার। কমিটি গঠনের চিঠি পেয়েই মতিউরের অর্থ-সম্পদের তথ্য চেয়ে সারা দেশে ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে চিঠি তৈরি করেছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হচ্ছে। আজ সোমবার এই চিঠি পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।

এনবিআর থেকে সরানো হয়েছে: 
মতিউর রহমানকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। গতকাল এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। তবে কেন এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা উল্লেখ করা হয়নি। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘জনস্বার্থে জারি করা এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।’ ধারণা করা হচ্ছে, মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সোনালী ব্যাংক থেকেও সরানোর প্রক্রিয়া শুরু:
এনবিআরের সদস্যের পাশাপাশি মতিউর রহমান ছিলেন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের পরিচালক। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় এনবিআর থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর এখন সোনালী ব্যাংক থেকেও সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গতকাল সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পূর্বনির্ধারিত ওই বৈঠকে মতিউর রহমানকে যোগ দিতে আগেই মৌখিকভাবে নিষেধ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে মতিঝিলে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে পর্ষদ সভা শেষে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম। 

তারা দুজনেই জানান, পরিচালনা পর্ষদের সভায় মতিউর রহমান যোগ দেননি। 

এ বিষয়ে জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মতিউর রহমান আর কখনো সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সভায় আসবেন না। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে মতিউর রহমানকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে দেওয়া সার্কুলার অনুযায়ী ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মতিউর রহমানকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদে তিন বছরের মেয়াদে নিয়োগ দেওয়া হয়। আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারি তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। 

মতিউরের যত সম্পদ: 
নিজের নামে অঢেল সম্পদের পাশাপাশি স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়স্বজনের নামে গড়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। এর মধ্যে দেশেই অন্তত ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট ও জমি রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে আছে এফডিআর ও শেয়ারবাজারে শতকোটি টাকার বিনিয়োগ। নিজ নামে নগদ ব্যাংকে জমা আছে কমপক্ষে অর্ধশত কোটি টাকা। 

ছাগলকাণ্ডের জন্য আলোচিত তার ছেলেকেও কিনে দিয়েছিলেন প্রাডো, প্রিমিও ও ক্রাউনের মতো চারটি বিলাসবহুল গাড়ি। এসব গাড়ি তার বিভিন্ন কোম্পানির নামে রেজিস্ট্রেশন করা। কিনে দিয়েছেন দামি দামি পাখিও। 

মতিউর রহমানের স্ত্রী-সন্তান ও ঘনিষ্ঠদের নামে ঢাকাতেই অন্তত ২৪টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে। বসুন্ধরার ডি-ব্লকের ৭/এ রোডের ৩৮৪ নম্বর ভবনের মালিক তিনি। সাততলা ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় প্রথম স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান লায়লা কানিজকে নিয়ে সপরিবারে বাস করেন।

গুলশানের সাহাবুদ্দিন পার্কের পাশে ৮৩ নম্বর রোডের ১১ নম্বর প্লটে আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের বেগ পার্ক ভিউতে রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার থাকেন লালমাটিয়ার ৮ নম্বর রোডের ৪১/২ ইম্পেরিয়াল ভবনে। কাকরাইলেও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে ছোট স্ত্রীর নামে। ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত ছাগলকাণ্ডে ভাইরাল হওয়ার পর তারা বর্তমানে কাকরাইলের ওই ফ্ল্যাটে অবস্থান করছেন। 

এ ছাড়া ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ডেভেলপার কোম্পানি শান্তা ডেভেলপারের করা বিভিন্ন ভবনে তার আটটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এসব ফ্ল্যাট প্রথম স্ত্রীর সন্তান ফারজানা রহমান ইপ্সিতা ও ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে কেনা হয়েছে।

টঙ্গীতে ৪০ হাজার বর্গফুটের এসকে ট্রিমস নামে ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ও অ্যাকসেসরিজ কারখানা আছে তার। যদিও কাগজে-কলমে কারখানার মালিক তার ভাই এম এ কাইয়ুম হাওলাদার। 

ময়মনসিংহের ভালুকায় ৩০০ বিঘা জমিতে ও বরিশালের গ্লোবাল সুজ নামে দুটি জুতা তৈরির কারখানা আছে। নরসিংদীর রায়পুরায় ওয়ান্ডার পার্ক অ্যান্ড ইকো রিসোর্ট রয়েছে। এসব রিসোর্টের মালিকানায় আছে তার ছেলে ও মেয়ে। পূর্বাচলে আপন ভুবন পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পটের মালিক তিনি। 

দেশের নামকরা ডেভেলপার কোম্পানিতে তার মালিকানা রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই-ব্লকে সোবহান অ্যাভিনিউর ৯-১০ নম্বর রোডের ৬৫৭ এ, ৬৫৭ বি এবং ৭১৬ নম্বর প্লটে বাণিজ্যিক ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। 

গাজীপুর সদর এলাকায় ১৭১ নম্বর এসএ দাগে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ, ১৭২ নম্বর এসএ দাগে ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ, ১৬৩ নম্বর এসএ দাগে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, ১৬৩ নম্বর এসএ দাগে ৬ শতাংশ, ১৭০ নম্বর এসএ দাগে ৬ শতাংশ, ১৬৩ নম্বর এসএ দাগে ৭ শতাংশ, ১৭০ নম্বর দাগে ৬ শতাংশ জমি রয়েছে। 

এ ছাড়া সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১৩০৩৫, ১৭৬৩ ও ১৭৬২ নম্বর দাগে ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ জমির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ আটটি খতিয়ানে ৬০ শতাংশ জমি রয়েছে। স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১৩৬৯৬ নম্বর এসএ দাগে ১৪ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, গাজীপুরে ৪৮ দশমিক ১৬ শতাংশ, ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও লায়লা কানিজের নামে দশমিক ৪৫১৬২৫ একর জমি রয়েছে।

দুদকের চার দফা অনুসন্ধানে দায়মুক্তি: 
গত ২০ বছরে দুদকের অনুসন্ধান থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন মতিউর। ২০০৪, ২০০৮, ২০১৩ ও ২০২১ সালে এই চারটি অনুসন্ধান হয়। তবে এই চার দফা অনুসন্ধানের পর দায়মুক্তি দেয় দুদক। পুরোনো এসব নথি খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন। নথি পাওয়া গেলে সেসব অভিযোগও খতিয়ে দেখা হবে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।

মতিউর-কাণ্ড: হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪, ১১:০৪ এএম
আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪, ১১:১৭ এএম
মতিউর-কাণ্ড: হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মো. মতিউর রহমান অর্থ পাচার করেছেন। পাচার করা অর্থ দিয়ে কানাডা ও দুবাইয়ে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও দোকান কিনেছেন। 

নাম প্রকাশ না করে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মতিউরের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করা হয়েছে। এসব অভিযোগ আমলে এনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), এনবিআর, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, সিআইডিসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে যার অবস্থান থেকে তদন্ত শুরু করেছে। সরকারের ওপরের মহল থেকে মতিউরের আয়-ব্যয় ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের প্রকৃত হিসাব খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে এরই মধ্যে মতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার বক্তব্য চাওয়া হয়েছে। মতিউর রহমান নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। 

সূত্র জানায়, গণমাধ্যমে মতিউর রহমানের সম্পদ, আয় ও অর্থ পাচার-সম্পর্কিত বিভিন্ন সংবাদ তদন্তে আমলে আনা হয়েছে। মতিউরের বিরুদ্ধে ব্যাংকিং চ্যানেলে ও হুন্ডির মাধ্যমে দুভাবেই অর্থ পাচার করার অভিযোগ আছে। 

মতিউরের দুর্নীতি তদন্তের দাবি জানিয়ে জমা হওয়া আবেদনপত্র থেকে জানা যায়, বন্ড কমিশনারেট থেকে শতভাগ রপ্তানিমুখী কোন কোন প্রতিষ্ঠান শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুবিধা পাবে তার অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০০০ সালে মতিউর রহমান রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার হিসেবে যোগ দেন। মতিউর রহমান জাল কাগজপত্র ব্যবহার করে কাগজে-কলমে পাঁচটি রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা হিসেবে গাজীপুর, সাভার, পুরান ঢাকার বিভিন্ন ঠিকানা উল্লেখ করেন। এসব প্রতিষ্ঠানের বাস্তবে কোনো অস্তিত্বই নেই। 

এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে মতিউরের কাছের লোক বলে পরিচিত অনেকের নাম দেওয়া হয়। নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকে এলসি খুলে নামমাত্র মূল্যের কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে চার বছরে ১২০ কোটির টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন। অন্যদিকে বাস্তবে কম পরিমাণের কাঁচামাল আমদানি করলেও কাগজে-কলমে বেশি পরিমাণের, বেশি দামের কাঁচামাল আমদানির কথা বলে গত চার বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার করেছেন বলে অভিযোগ করা আছে।

অভিযোগে বলা হয়েছে, পাচার করা অর্থে কানাডা ও দুবাইয়ে একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট কিনেছেন মতিউর। দুবাইয়ে একাধিক দোকানও কিনেছেন। পাচার করা অর্থ দুবাইয়ে গচ্ছিত রাখা হয়েছে। দুবাইয়ে একটি হোটেলের অংশীদারও তিনি। 

অভিযোগে মতিউরের ভাই কাইয়ুম ও তার স্ত্রীর নামে একাধিক তৈরি পোশাকশিল্পের কারখানা থাকার কথাও বলা হয়েছে। কাইয়ুম একসময় গার্মেন্টসকর্মী হিসেবে চাকরি করতেন। মতিউর তার অনেক সম্পদ কাইয়ুমের নামে করেছেন। অনেক ব্যাংক মতিউরের প্রায় ৫৪ কোটি টাকার এফডিআর তার ভাই ও তার দুই স্ত্রীর নামে। কাইয়ুম এখন শিল্পপতি। টঙ্গীর রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান এসকে ট্রিম অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড এবং কামরাঙ্গীরচরের এসকে থ্রেড নামের সুতা উৎপাদন কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউরের ভাই কাইয়ুম। যার প্রকৃত মালিক মতিউর। ভালুকা ও বরিশালের গ্লোবাল সুজ লিমিটেডের অংশীদারও তিনি। মতিউরের ভাইয়ের স্ত্রী কুলসুমের নামে বন্ড লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে। 

এসব কারখানার নামেও অর্থ পাচার করা হয়েছে। এসব কারখানায় ব্যবহারের কথা বলে কাঁচামাল আমদানি করে একইভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। এসব পণ্য দিয়ে কোনো পণ্য বানানো হয়নি। নিম্নমানের পণ্য খোলাবাজার থেকে নামমাত্র মূল্যে কিনে রপ্তানি করা হয়েছে্। 

মতিউরের আরেক ভাই নূরুল হুদাও একসময় বেকার ছিলেন। হঠাৎ তিনি কোটিপতি বনে যান। ফার্মগেটের অর্কিড প্লাজায় অবস্থিত সাইমুম অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড এবং অপর একটি গার্মেন্টসের মালিক তিনি। 

শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ায় অন্যতম শর্ত হলো- আমদানীকৃত কাঁচামালের সবটা দিয়ে রপ্তানীকৃত পণ্য বানাতে হবে। মতিউর রহমান জাল কাগজপত্র দিয়ে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করলেও রপ্তানির জন্য একটি পণ্য তৈরি করেননি। 

মতিউর বিভিন্ন দপ্তরে কাজ করার সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ সীমা ছাড়িয়ে গেলে তাকে বদলি করতে বাধ্য হয়। মোট অঙ্ক দিয়ে অনেক সময়ই বদলি ঠেকিয়ে দিয়েছেন। মতিউর শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগে পোস্টিং বাগিয়ে নেন। দীর্ঘদিন এখানে দায়িত্ব পালন করে ২০০৬ সালের শেষ দিকে তিনি বদলি হন চট্টগ্রাম বন্দর হাউসে। শুল্ক গোয়েন্দার দায়িত্বে থাকাকালে সৎ ব্যবসায়ীদের ফাইল আটকে রেখে বিভিন্নভাবে হয়রানি করতেন। মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে তিনি এসব ফাইল ছেড়ে দিতেন। 

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে এনবিআর সদস্য মো. মতিউর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্য চেয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি। 

মতিউর রহমান কাস্টমস কর্মকর্তা হলেও তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদেও রয়েছেন। ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিন বছরের জন্য তাকে নিয়োগ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। অভিযোগ আছে, রাজস্ব কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার সুবাদে শেয়ারবাজারসহ বিভিন্ন ব্যবসায় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সম্পদ গড়ে তোলা সহজ হয়েছে।