মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পরাশক্তিগুলো এখন বেশ সক্রিয়। চীনের বিপুল কর্মযজ্ঞ সেখানে চলমান। ভারতও চীনকে পাল্লা দিয়ে অঞ্চলটিতে এতদিন পর্যন্ত বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। শুধু তা-ই নয়, গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত এ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় পিছিয়ে নেই যুক্তরাষ্ট্রও। এ অবস্থায় কক্সবাজারের টেকনাফের পাশাপাশি এবং অনিন্দ্যসুন্দর প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন কি পরাশক্তিগুলোর বলি হতে যাচ্ছে! এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
সেন্ট মার্টিন থেকে নাফ নদীতে মায়ানমারের জলসীমায় সম্প্রতি তিনটি যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, দেশটির আকাশসীমায় উড়েছে যুদ্ধবিমান। ফলে ভয় ও আতঙ্ক ধরে গেছে সেন্ট মার্টিনের মানুষের মধ্যে। মূল ভূখণ্ড থেকে ঠিকমতো রসদ পৌঁছানো যায়নি বেশ কয়েক দিন। তাই সেখানে দেখা গেছে খাদ্যসংকটও। অবশেষে শুক্রবার রাতে বিশষ সামরিক পাহারায় সেখানে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানো হয়েছে।
গেল সপ্তাহে পরিস্থিতির এমন অবনতি হয় যে, মায়ানমারের দিক থেকে বাংলাদেশের জলসীমায় চলাচল করা কয়েকটি নৌযানকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। তবে গুলি মায়ানমারের সেনাবাহিনী করেছে না বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি করেছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পরিস্থিতি বোঝার জন্য ঢাকার পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার নেপিডোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মিয়া মো. মাইনুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মায়ানমারের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। তবে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস সব সময় সক্রিয় আছে।’
রাখাইন ঘিরে চীনের বিশাল স্বার্থ
মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। রয়েছে ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের বিশাল মজুত। ২০০৪ সালে এই মজুত আবিষ্কারের পরপরই অঞ্চলটি ঘিরে চীনের আগ্রহ বাড়তে থাকে। তারপর ২০০৮ সালে চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে মায়ানমারের জান্তা সরকার। রাখাইন থেকে গ্যাস চীনের ইউনান প্রদেশে নিতে পাইপলাইন স্থাপন করেছে বেইজিং। এ ব্যবস্থায় প্রতিবছর ১২ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়।
রাখাইনে রয়েছে তেলেরও বিশাল মজুত। সেখান থেকে অপরিশোধিত তেল সংগ্রহের জন্য ২০০৮ সালে পাইপলাইন স্থাপনের চুক্তি করে চীন। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানোর মাত্র চার মাস আগে থেকে এই পাইপলাইনে চীনের ইউনান প্রদেশে তেল সরবরাহ শুরু হয়। চীনের ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য।
চীনের সঙ্গে রাখাইন রাজ্য সম্পর্কিত ৩৩টি চুক্তি করেছে মায়ানমার। চীন রাখাইনে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পাশাপাশি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করারও চুক্তি করেছে।
চুক্তি অনুযায়ী রাখাইনের কিউকফিউ শহরে নির্মিত সমুদ্রবন্দরের সিংহভাগ, অর্থাৎ ৭০ শতাংশ মালিকানা থাকবে চীনের। বাকি মাত্র ৩০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ থাকবে মায়ানমারের হাতে। রাখাইনের সঙ্গে ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটারের একটি অর্থনৈতিক করিডর গড়ে তুলছে চীন। এর উদ্দেশ্য হলো ভারত মহাসাগরের সঙ্গে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিংয়ের সংযোগ ঘটানো। চাওকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চাওকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দর এই বিশেষ করিডরের অংশ।
চাওকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে চীন বিনিয়োগ করছে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার। আর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে খরচ হবে ৭৩০ কোটি ডলার। রাখাইন রাজ্যের চাওকপিউ টাউনশিপের মাদে দ্বীপে ১৫০ হেক্টর ও রামরি দ্বীপে ৯৬ হেক্টর জমিতে এই দুই প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে।
চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে ভারতও
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব খর্ব করতে মায়ানমারকে কাছে টানতে চাইছে ভারত। তাই রাখাইনে বড় ধরনের বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। ভারত চাইছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাখাইনের সিটওয়ে বন্দর প্রকল্পের কাজ। সিটওয়েতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর ও অভ্যন্তরীণ নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ করছে ভারত। ভারতের এখানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৮৪ মিলিয়ন ডলার। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সমুদ্রপথে কলকাতার সঙ্গে রাখাইনের সিটওয়ে (আগের আকিয়াব) সংযুক্ত হবে। ভারত অনেক আগেই এ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল।
বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে সিটওয়ে বন্দর ভারতের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতা থেকে ভারতের সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহনে এই রুটটি ব্যবহৃত হবে। এটা সম্পন্ন হলে নদীপথে সিটওয়ের সঙ্গে মায়ানমারের চিন রাজ্যের পালেটওয়া বন্দরকে সংযুক্ত করবে। এরপর সড়কপথে পালেটওয়া সংযুক্ত হবে মিজোরামের জরিনপুইয়ের সঙ্গে। এ প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে একদিকে মায়ানমার-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়বে, অন্যদিকে ভারতের সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহন সহজ হবে।
ভারতের সঙ্গে মায়ানমারের প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। বঙ্গোপসাগরেও উভয় দেশের সীমান্ত রয়েছে। রাখাইনের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদ ভারতের নরেন্দ্র মোদি প্রশাসনের লুক ইস্ট নীতি বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
সক্রিয় যুক্তরাষ্ট্রও
রাখাইন রাজ্যের বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে অঞ্চলটির প্রতি আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররাও। এ জন্য রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মায়ানমারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ ছাড়া তেমন উচ্চবাচ্য করে না দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় কোম্পানি রাখাইন রাজ্যে তেল-গ্যাসে বিনিয়োগ করছে। ব্যবসা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে রাখাইন রাজ্য ঘিরে। দেশটি ভারত মহাসাগরে তার উপস্থিতি বাড়াতে চায়। তাছাড়া তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন যেহেতু রাজ্যটিতে সক্রিয়, কাজেই যুক্তরাষ্ট্রও সক্রিয়। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র চায় এই অঞ্চলে তার ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) বাস্তবায়ন করতে এবং এশিয়ার ন্যাটো বলে পরিচিত কোয়াডের বিস্তার ঘটাতে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা আগে ভারতের চোখ দিয়ে এই অঞ্চলকে দেখত। এখন যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির পরিবর্তন হচ্ছে। তারা সরাসরি এই অঞ্চলে সম্পৃক্ত হতে চায়।’
সেন্ট মার্টিনের বর্তমান অবস্থা
বিকট বিস্ফোরণের শব্দ আসছে। স্থানীয়রা বলছেন, আগে মাঝে মাঝে বিস্ফোরণের শব্দ আসত। সম্প্রতি একটানা বিকট বিস্ফোরণের শব্দ আসছে। এ ছাড়া নাফ নদীতে মায়ানমারের জলসীমায় তিনটি যুদ্ধজাহাজ সেন্ট মার্টিন থেকে দেখা গেছে। দেশটির আকাশসীমার মধ্যে উড়তে দেখা যায় যুদ্ধবিমানও। পরে যুদ্ধজাহাজ চলে গেলেও আতঙ্ক কাটেনি।
দ্বীপটির ১০ হাজার মানুষ খাদ্যসংকটের মুখে পড়েছে। এ অবস্থা গত ৭-৮ দিন ধরেই। সর্বশষ গত শুক্রবার চাল, ডাল, পেঁয়াজ, তেলসহ নানা ধরনের খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে যাত্রা করে ‘বার আউলিয়া’ নামের একটি জাহাজ। শুক্রবার বেলা ২টা ১৫ মিনিটে কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএর ঘাট থেকে জাহাজটি সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। জাহাজটিতে দেড় শতাধিক মানুষ ও সরকারি সহায়তায় খাদ্যপণ্য এবং পাঁচটি কোরবানির গরু ছিল।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. ইয়ামিন হোসেন জানান, দ্বীপের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমন্বয় করে জাহাজটি পাঠানো হয়। এটি বঙ্গোপসাগর দিয়ে টেকনাফ পৌঁছে ঘোলারচর হয়ে সেন্ট মার্টিন যায়। পণ্যসামগ্রীর পাশাপাশি কক্সবাজারে আটকা পড়া সেন্ট মার্টিনের অনেক বাসিন্দাও এই জাহাজে করে ফিরে আসেন।
কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিকভাবেই অগ্রসর হতে হবে এবং বাংলাদেশ সে পথেই অগ্রসর হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। মায়ানমার বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে রাখাইনের পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে তার প্রভাব বাংলাদেশের জন্য সুখকর হবে না বলেই মনে করছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার কূটনৈতিকভাবেই অগ্রসর হচ্ছে। আমিও মনে করি, কোনো ধরনের যুদ্ধে না জড়িয়ে কূটনৈতিক উপায়ে সমাধানের চেষ্টা করা উচিত বাংলাদেশের। প্রয়োজনে জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, মায়ানমারের ওপর চীনের প্রভাব বেশি। দেশটির জান্তা সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি উভয়ের সঙ্গেই চীনের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শ তাদের।
এ প্রসঙ্গে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘চীনের সঙ্গে মায়ানমারের জান্তা সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো যেতে পারে। ভারেতর সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে হবে।’
বিশিষ্টজনের অভিমত
আক্রান্ত হলে ছেড়ে দেব না: ওবায়দুল কাদের
সেন্ট মার্টিন-টেকনাফ নৌরুটে মায়ানমারের গোলাগুলি নিয়ে দেশটির সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত-সংকটে আমরা ভুক্তভোগী হলে সেটা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। যুদ্ধকে পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চলছে এবং চলবে। তবে আমাদের কেউ আক্রান্ত হলে, ছেড়ে দেব না। সেই আক্রমণের জবাব দেওয়া হবে।’
শনিবার (১৫ জুন) দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, আমাদের দরকার রোহিঙ্গা চাপ সরিয়ে নেওয়া। সার্বিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। শেখ হাসিনার সরকার সব জায়গায় (বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে) প্রথমে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। কিন্তু এটা দুঃখজনক, জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠান এখন নখদন্তহীনে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েল, বড় বড় দেশ তাদের কথা শোনে না। জাতিসংঘের অনুরোধের কোনো কার্যকারিতা বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি না।
সেন্ট মার্টিনে মায়ানমারের গুলি প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নিজেদের এত খাটো করে দেখব কেন? আমরাও প্রস্তুত। আক্রমণ করব না, কিন্তু আক্রান্ত হলে কী ছেড়ে দেব? আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘মায়ানমারের সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো বৈরিতা নেই। আলাপ-আলোচনার দরজা খোলা আছে। আমরা কথা বলতে পারি। যতক্ষণ কথা বলা যাবে, আলাপ আলোচনা করা যাবে; আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা (সেন্ট মার্টিনে গুলি) সমাধানের চেষ্টা করছি এবং করে যাব। আমাদের যেন কোনো উসকানি না থাকে।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারে অভ্যন্তরীণ কিছু সংকট আছে। দেশটির নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী রয়েছে ৫৪টি। তাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। তবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা জেঁকে বসেছে। বিশ্ব আমাদের প্রশংসা করছে তাদের (রোহিঙ্গাদের) আশ্রয় দেওয়ার জন্য। কিন্তু এই রোহিঙ্গাদের জন্য যে সাহায্যের পরিমাণ ছিল, সেটি অনেক কমে গেছে।
চলমান বিশ্ব সংকটে (করোনা মহামারির পর আর্থিক সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসন) আমরা নিজেরাই সংকটে আছি জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, নিজেদেরই দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়ার কারণ নেই। সেখানে ১১-১২ লাখ রোহিঙ্গা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে আছে। সেতুমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দুনিয়ার বড় বড় দেশ যারা রোহিঙ্গা নিয়ে কথা বলে, তাদের লিপ সার্ভিসের দরকার নেই।
সড়কে যানজট নিয়ে সেতুমন্ত্রী বলেন, যানজটের জন্য রাস্তা কোনো সমস্যা নয়। ধীর গতির কোরবানির পশুবাহী গাড়ি, সড়কের পাশে পশুর হাট একটা সমস্যা। তারপরও ঈদ যাত্রায় কিছু কিছু জায়গায় যানজট হলেও কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়নি। আশা করি সামনের দিনগুলো ভালো যাবে। অবশ্য আজ (শনিবার) এবং আগামীকাল (রবিবার) গার্মেন্ট ছুটি হলে কোনো কোনো জায়গায় চাপটা বাড়তে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক ও সুজিত রায় নন্দী, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম প্রমুখ।
মায়ানমারকেও কিছু বলা যাচ্ছে না: মির্জা ফখরুল
মায়ানমার সীমান্ত থেকে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে নৌযান লক্ষ্য করে গুলির ঘটনার উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘মায়ানমারের মতো একটা দেশকেও আজ কিছু বলা যাচ্ছে না? এটা যে কতটা নতজানু, দাসসুলভ মনোভাব হতে পারে। সেন্ট মার্টিন ইস্যুতে সরকারের নীরবতা দাস সুলভ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।’
শনিবার (১৫ জুন) রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘সংবাদপত্রের কালো দিবস উপলক্ষে’ এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। আয়োজন করে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশ। অনুষ্ঠানে ধারণাপত্র পাঠ করেন, বিএফইউজের একাংশের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী। এতে আরও বক্তব্য রাখেন, নয়া দিগন্তের সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, বিএফইউজের সভাপতি রহুল আমিন গাজী, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, সৈয়দ আবদাল আহমেদ, সাংবাদিক আবদুল হাই শিকদার প্রমুখ।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সীমান্তে মানুষ মারছে। পানি দিচ্ছে না। অথচ সরকার একটা কথা বলে না। বাংলাদশকে পরনির্ভরশীল রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলেছে সরকার। চীন বিশ্বে একনায়কতন্ত্র চলছে- এমন দেশের দিকে ঝুঁকছে। সারা বিশ্বেই একনায়কতন্ত্র বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন প্রতিদিনই পুরো জাতির জন্যই কালো দিবস। বর্তমান সরকার ১৯৯৬ সালে এসেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ শুরু করেছে। কিছু সাংবাদিক সাহস করে কাজ করছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, বেনজীর, আজিজ, আনারের ঘটনা সাংবাদিকরাই তুলে এনেছেন।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘সেনাপ্রধান জালিয়াতি করবেন, পুলিশপ্রধান ডাকাতি করে দেশে সাম্রাজ্য গড়ে তুলবেন, কল্পনা করা যায়? বর্তমান সরকারের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। বেনজীর-আজিজ ও আনারের ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য গণমাধ্যমে উঠে আসতে শুরু করেছে। ভাইদের পাসপোর্ট জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠা সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের বিচারের তিনি দাবি করেন।’
সংবাদের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কিছু বাণী প্রচার করা হয়, তিনি তা শুনছিলেন উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘উনি বলছিলেন, যারা আজকে সম্পদ লুণ্ঠন করে পাচার করে নিয়ে যায়, তাদের এ দেশের মাটিতে জায়গা নেই।’ তিনি বলেন, ‘যারা এখন ক্ষমতায় আছে, তারা কি একবারও এ কথা শুনছে?’
বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে বিপ্লব করেছেন। আমাদেরও এটা সম্ভব। বলছি না যে এখান থেকেই করতে হবে। বাইরে যারা থাকেন, তারা করুক। দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অমুক–তমুক আইন, গুম করে দেওয়ার বিষয় আছে।’
ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনৈতিক অঙ্গনে বাম-ডান সবাইকে একটা জায়গায় নিয়ে এসেছি। সাংবাদিকরাও যদি এক প্ল্যাটফর্মে আসেন, তা হলে দেশে গণতন্ত্র ফিরবে।’
সার্বভৌমত্বে আঘাত হেনেছে: জি এম কাদের
মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নাইক্ষ্যংদিয়া থেকে নাফ নদের বাংলাদেশ সীমান্তে শাহপরীর দ্বীপে বাংলাদেশি নৌযান লক্ষ্য করে দফায় দফায় গুলির ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদের। শনিবার (১৫ জুন) দুপুরে রংপুর সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার আমাদের সেন্ট মার্টিনে মানুষকে ঢুকতে দেবে না। দীর্ঘদিন থেকে তারা এখানে হামলা করছে। তারা বিভিন্নভাবে আমাদের ভূখণ্ডে চলে আসতে চাচ্ছে। তারা আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা করছে।’
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, ‘সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী অনেক শক্তিশালী, অনেক কিছু আমরা শুনি। তাদের ভূমিকা আমরা দেখছি না। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এটা দুঃখজনক।’
রোহিঙ্গা সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এর আগে এক মিলিয়ন রোহিঙ্গাকে আমাদের দিকে ঠেলে দেওয়া হলো। তখন বিভিন্ন অজুহাতে আমরা মানবতাবাদী হয়ে গেলাম তাদের রক্ষা করতে গিয়ে। আমাদের ঘাড়ে তাদের বোঝাটা নিলাম। এখন তারা যদি আমাদের ভূখণ্ড দখল করে ফেলে, সেন্ট মার্টিন কন্ট্রোলে নিয়ে ফেলে সরকার কি করবে আমরা জানি না। এটা আবার কোনো মহত্ত্বের পরিচয় দিয়ে দেওয়া হবে কি না! সার্বভৌমত্ব বিষয়ে সরকারকে বক্তব্য দেওয়া উচিত কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, ওনারা কী করছেন। আমরা উৎকণ্ঠিত। জনগণ এর উত্তর চায়।’
এদিকে ঈদুল আজহায় দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে জি এম কাদের বলেন, ‘আজ আমরা ঈদুল আজহার শিক্ষার মধ্যে নেই। আজকে সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। আল্লাহর নির্দেশিত পথের বাইরে আমরা প্রতিযোগিতা করছি, সর্বশক্তি নিয়োগ করছি। ত্যাগের মহিমায় আমরা নিজেদের উদ্ভাসিত করতে পারছি না। সেই কারণে আমি মনে করি, ঈদুল আজহার দিনে এই শপথ নিতে হবে, পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি ও দুর্নীতির জন্য প্রতিযোগিতাও কোরবানি করব। ঈদুল আজহার শিক্ষা নিয়ে সকলকে এগিয়ে যেতে হবে। এটাই হোক আজকের দিনের প্রত্যয় ও শপথ।’
হামলা হলে ছাড় নয়: জেনারেল শফিউদ্দিন
বিদায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহম্মেদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো বহির্শত্রু আক্রমণ করতে চাইলে আমরা প্রতিহত করব। বর্তমানে যে বর্ডার ভায়োলেট হচ্ছে, সেখানে বর্ডার গার্ড রয়েছে, কোস্টগার্ড রয়েছে, নৌবাহিনী রয়েছে। তারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে কাজ করছে। এর চেয়ে বেশি খারাপ হলে বা আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা হলে আমরা কাউকে ছাড় দেব না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, আমরা শান্তি চাই। যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে।’
শনিবার (১৫ জুন) দুপুর সাড়ে ১২টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯ পদাতিক ডিভিশনের তত্ত্বাবধানে শেখ রাসেল সেনানিবাসে একটি ব্রিগেড সিগন্যাল কোম্পানির পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি এ কথা বলেন।
এস এম শফিউদ্দিন আহম্মেদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘ মিশনে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। বর্তমানে কুয়েত ও কাতারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। ভবিষ্যতে এসব দেশে সেনাসদস্য সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক কাজ করছে শেখ রাসেল সেনানিবাস।’
অনুষ্ঠানে জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, এসবিপি (বার), ওএসপি, এনডিইউ, পিএসসি, পিএইচডি প্রধান অতিথি হিসেবে নবগঠিত ইউনিটের পতাকা উত্তোলন করেন।
বিদায়ী সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমার দায়িত্বকালীন সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেবার মানসিকতা নিয়ে প্রদত্ত দায়িত্বসমূহ যথাযথভাবে পালন করতে পারায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত ও স্বাধীন ভূখণ্ড নিরাপদ রাখতে অর্পিত সব দায়িত্ব পালন করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অঙ্গীকারবদ্ধ। দেশের সংকটময় মুহূর্তসহ যেকোনো পরিস্থিতিতে অকুতোভয় দায়িত্ব পালনে সেনাবাহিনী সদা প্রস্তুত।’
এ সময় একজন সাংবাদিক বিদায়ী সেনাপ্রধানের অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি জানান, নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরে তিনি আত্মতৃপ্ত। তবে দীর্ঘদিনের পোশাক খুলতে কিছুটা কষ্ট হবে বলে জানান তিনি। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে বিদায়ী সেনাপ্রধান তার মূল্যবান বক্তব্যে সেনাবাহিনীর নতুন ইউনিটের সদস্যদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। এ সময় তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং সেই সব বীর শহিদদের যাদের আত্মত্যাগে অর্জিত হয়েছে দেশের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।’
তিনি বলেন, ‘‘১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় প্রণীত হয় ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’। আজকের এই পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ এর আরেক ধাপ বাস্তবায়িত হলো।’’
পতাকা উত্তোলন ও কেক কাটা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নতুন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, সেনা সদরের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারাসহ ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন শরীয়তপুর-২ (নড়িয়া-সখিপুর) আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম এনামুল হক শামীম, জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ ও পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুল আলম।